পানিই আশীর্বাদ, পানিই অভিশাপ
যেদিকেই চোখ যাবে, শুধু থৈ থৈ পানি। প্রথম প্রথম দেখলে যে কারো মনে হবে এ যেন এক জনমানবহীন পানির রাজ্য! নদীতে পানি, হাওরে পানি, রাস্তাঘাটে পানি, সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও পানি, ধর্মীয় উপাসনালয়, বাড়ির উঠানে পানি। এমনকি বাড়িঘরের ভেতরেও হাঁটুপানি। সর্বত্র শুধু পানি আর পানি।
প্রায় ৩০ লাখ জনগোষ্ঠীর ১৫৪টি ছোট-বড় হাওরবেষ্টিত জনপদের নাম সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জ জেলার জন্য এই পানিই আশীর্বাদ। হাওরপ্রধান হওয়ায় মাছের জন্য এই পানি আশীর্বাদ। আবার মৌসুমের একটি মাত্র বোরো ফসলের চাষাবাদের জন্যও এই পানি খুব প্রয়োজন। এই পানির জন্য প্রতিবছর জেলার টাঙ্গুয়ার হাওরসহ নানা দর্শনীয় স্থান দেখতে ছুটে আসে দেশ-বিদেশের লাখ লাখ পর্যটক। তাতে সচল থাকে জেলার অর্থনীতি।
জেলার জন্য এই পানি আশীর্বাদ হলেও এবার তা অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। কারণ, এক মাসে টানা তিন-তিনবার বন্যার কবলে পড়েছে সুনামগঞ্জের মানুষ। এতে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাচ্ছে জেলার চারটি পৌরশহরসহ প্রায় সব উপজেলার গ্রামগুলোও। ২০১৭ সালের মার্চের শেষ দিকে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজে ঠিকাদার ও পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্মকর্তাদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে জেলার শতভাগ ফসল আগাম বন্যার পানির নিচে তলিয়ে পচে নষ্ট হয়ে যায়। একই সঙ্গে পানির মধ্যে ধান পচে অ্যামোনিয়া গ্যাসের সৃষ্টি হয়ে সব নদী ও হাওরের মাছ মরে যায়। তখনো জেলাবাসীর জন্য এই পানিই অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছিল। একইভাবে গত এক মাস পানির মধ্যে ডুবে থেকে চরম অস্বস্তিতে পড়েছে সব ধরনের মানুষ। অন্য সময় বন্যা দেখা দেওয়ার সপ্তাহখানেক সময়ের মধ্যে পানি নেমে গেলেও এবার সেই পানি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্যমতে, আগামী আরো কয়েক দিন পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে এবং পানি নামতেও অনেক সময় লাগবে। এতে ভোগান্তি বাড়বে মানুষের।
এদিকে, টানা তিনবারের বন্যায় বিপর্যস্ত অসহায় মানুষ কিছুতেই কোনো কূলকিনারা করতে পারছে না। সেইসঙ্গে পাচ্ছে না সহায়তাও।
আর বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেওয়া মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গবাদিপশুসহ খেয়ে না-খেয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে খেটে খাওয়া মানুষ।
গত দুদিনে সুনামগঞ্জে বৃষ্টিপাত কিছুটা কম হলেও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার ১১ উপজেলায় তৃতীয়বারের মতো বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। বিকেলের পর থেকে বৃষ্টিপাত সুনামগঞ্জ অংশে কম হলেও ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে ভারি বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এতে সেখান থেকে আসা ঢলের কারণে সন্ধ্যার পর থেকে সুনামগঞ্জ পৌরশহরের তেঘরিয়া, বড়পাড়া, মধ্যবাজার, উকিলপাড়া, ষোলঘর, নবীনগর, নতুনপাড়াসহ বেশ কিছু জায়গার সড়ক ও বাসাবাড়িতে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। এতে আবারও অস্বস্তিতে পড়েছেন শহরবাসী।
একইভাবে জেলার সুনামগঞ্জ সদর, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, দিরাই, শাল্লা, ছাতক, বিশ্বম্ভরপুর, তাহিরপুর, ধর্মপাশা, জামালগঞ্জ জগন্নাথপুর ও দোয়ারাবাজার উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো চরম অবনতি হওয়ায় জনজীবন সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছে। প্রতিটি উপজেলার প্রায় সব ইউনিয়নেই বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। সর্বত্র পানি থাকায় রান্নাবান্নাও করতে পারছে না লোকজন। টানা তৃতীয়বার বন্যা আসায় দিশেহারা নিম্ন আয়ের মানুষ। পাশাপাশি গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি নিয়েও বিপাকে পড়েছে মানুষ।
‘হাওর বাঁচাও সুনামগঞ্জ বাঁচাও’ আন্দোলনের কার্যকরী সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান বলেন, ‘সুনামগঞ্জের জন্য এই পানি এখন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত এক মাসে এত পানি হয়েছে যে কোথাও গিয়ে আশ্রয় নেওয়ারও জায়গা নেই। জেলার সর্বত্র পানি থাকায় কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। তবে এই বন্যার পানি একদিকে যেমন প্রাকৃতিক, অন্যভাবে মানুষও দায়ী। হাওর ও নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে সামান্য বৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢলে বালি ও মাটি গিয়ে তলদেশ ভরাট হয়ে যায়। অথচ আমরা ভৈরব নদ থেকে শুরু করে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত খননের উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলেছিলাম। কিন্তু এই দাবি কেউ কর্ণপাত করেনি। যার কারণে মানুষ প্রতিবছর বন্যার পানিতে ডুবে থাকে। আর যাও কিছু কিছু কাজ হয়, যেখানেও সীমাহীন দুর্নীতি হয়। আমরা চাই, সুনামগঞ্জের কথা চিন্তা করে হাওর ও নদীর খনন করার সঠিক উদ্যোগ নেওয়া হোক। আর যদি উদ্যোগ না নেওয়া হয়, তাহলে ভোগান্তির শেষ থাকবে না। ভবিষ্যতে পাহাড়ে গিয়ে আশ্রয় নিতে হবে।’
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার লালপুর গ্রামের তৈয়ব মিয়া (৭০) জানান, ১৯৮৮ ও ২০০৪ সালেও বন্যা হয়েছে। কিন্তু এবারের মতো এত ভোগান্তি হয়নি। বন্যা হলে তা কয়েক দিন থেকে আবার পানি নেমে গেছে। কিন্তু এবার গত দুবারের পানিও ভালোমতো নামতে পারেনি; আবার রাস্তাঘাট ডুবে গেছে, ঘরের ভেতর পানি উঠে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য পানি আশীর্বাদ। কিন্তু এবার এই পানি আমাদের জন্য অভিশাপ।’
একই গ্রামের জয়তুন বিবি (৪৫) বলেন, ‘ঘরের মধ্যে পানি থাকায় সন্তানদের নিয়ে দিনরাত খাটের ওপরে বসে থাকি। আর ঘরে কিছু না থাকায় রান্নাবান্নাও করতে পারি না। আমার স্বামী কাজে গেলে সন্ধ্যায় কয়টা চাল আনে, পরে চুলা জ্বালাই। হাঁস-মুরগি ঘরে থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রেও যেতে পারি না।’
সুনামগঞ্জ জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট এনাম আহমদ বলেন, ‘পানি সুনামগঞ্জের জন্য আশীর্বাদ। কিন্তু কয়েক বছরে ধরে মানুষের লোভ-লালসা আর সীমাহীন দুর্নীতির জন্য সুনামগঞ্জে সামান্য পানিতেই ফসল তলিয়ে যায়, বন্যা দেখা দেয়। অথচ এত এত হাওর, নদী। সেই নদী ও হাওরে পানি ধরে না। অল্প পানিতেই সব লোকালয়ে প্রবেশ করে। এতে মানুষ সীমাহীন দুর্ভোগে পড়ছে। আমরা প্রথম থেকেই দাবি জানিয়ে এসেছি হাওর ও নদী খননের জন্য। যদি দুর্নীতি না করে হাওর ও নদী সঠিকভাবে, সুষ্ঠুভাবে খনন করা যায়, তাহলে বৃষ্টি ও ঢলের পানি সহজে লোকালয়ে প্রবেশ করবে না। সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক মিষ্টিপানি কাজে লাগিয়ে অনেক কিছু করা সম্ভব। সেইসঙ্গে সুনামগঞ্জ শহর রক্ষা বাঁধ দেওয়ারও দাবি জানাচ্ছি। সুরমা নদীতে অল্প পানি বাড়লেই পানি শহরে প্রবেশ করে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি করে। তাই দ্রুত নদী, হাওর-খাল খননের উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে জেলাবাসী আরো বড় ধরনের দুর্ভোগে পড়বে।’
অতিবৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে পরপর তৃতীয় দফায় সুনামগঞ্জে বন্যা দেখা দিয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ বলেন, ‘জেলা ও উপজেলা দুর্যোগ ত্রাণ সহায়তা নিবিড়ভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য সভা করা হয়েছে। বন্যায় আক্রান্ত এলাকা থেকে দুর্গতদের আশ্রয়কেন্দ্রে এনে কীভাবে নিরাপদে রাখা যায়, সেই প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এখন পর্যন্ত জেলায় দুই হাজার ৩০০টির মতো আশ্রয়কেন্দ্র খুলে দেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে তৈরি করা খাবার দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে জেলা প্রশাসন থেকে এক লাখ ৫৯ হাজার পরিবারকে বিশেষ ভিজিএফ কার্যক্রমের সহায়তার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে।’
টানা এক মাসের বেশি বন্যার পানি সড়কের ওপরে থাকায় জেলার সুনামগঞ্জ সদরের সঙ্গে তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, জামালগঞ্জ ও ছাতক উপজেলার সড়ক যোগাযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন রয়েছে।