বাবার লাশ রেখে পালিয়ে যাওয়া এবং আজকের করোনা
সারা দেশের মানুষ সেদিন গণমাধ্যমে চোখ রেখেছিল। ঘটনা ২০২০ সালের ৮ মার্চ। ওই দিন প্রথম বাংলাদেশে তিনজনের শরীরে করোনাভাইরাস (কোভিড-১৯) শনাক্ত হয়। এক শব্দের করোনাভাইরাস সেদিন দেশে নতুন উদ্বেগ ও আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। তত দিনে সারা পৃথিবী কাঁপছিল করোনা আতঙ্কে।
করোনা নামক এই সংক্রমক ভাইরাসটি এক ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছিল বিশ্বজুড়ে। সেই আতঙ্কে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিল পুরো বাংলাদেশ। এরপর একে একে দেশে করোনা সংক্রমণের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সেসময় থেকে জনসাধারণের চোখ আর প্রচারমাধ্যম থেকে সরেনি।
প্রতিদিন দুপুর থেকে বিকেলের মধ্যে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা নিয়মিত সংবাদ সম্মেলন করে করোনার হালনাগাদ তথ্য জানাতেন। এসব হালনাগাদ তথ্য জানার জন্য আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ ভিড় জমাতো টেলিভিশনের সামনে। এই আতঙ্ক আরো বাড়িয়ে দেয় চলতি বছরের ১৮ মার্চ। সেদিন দেশে ৭০ বছর বয়সী এক বৃদ্ধ করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রথম মৃত্যুবরণ করেন।
একই দিনে অর্থাৎ ১৮ মার্চ নতুন করে চারজনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। তত দিনে দেশে মোট আক্রান্ত ১৪ জন। তারপর থেকে করোনা আতঙ্ক যেন আরো জেঁকে বসে মানুষের মনে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, কোনো ব্যক্তি করোনায় আক্রান্ত হলে তাকেসহ পুরো পরিবারকেও ভিন্ন চোখে দেখা হতো, সামাজিকভাবে হেয় করা হতো, যেন করোনায় আক্রান্ত হওয়া মানেই অপরাধ করে বসা।
এই যখন অবস্থা, তখন সামাজিকভাবে হয়রানির শিকার হওয়া থেকে বাঁচতে করোনায় আক্রান্ত হলেও মানুষ তা গোপন করতে শুরু করে। শুধু তাই নয়, করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তি হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসকের কাছেও তথ্য লুকাত, যা করোনা পরিস্থিতিকে আরো ভয়ংকর রূপ দিতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট নানা মহল থেকে উদ্বেগ জানানো হয়েছিল সেসময়।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রথম ব্যক্তিকে দাফন করা হয়েছিল রাজধানীর খিলগাঁওয়ের তালতলা কবরস্থানে। কিন্তু দাফনের সময় মৃত ব্যক্তির কোনো স্বজন উপস্থিত ছিল না সেখানে। পরিস্থিতি এতটাই আতঙ্কের ছিল যে, তালতলা কবরস্থানে যখন করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া প্রথম ব্যক্তির লাশ দাফন করতে যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, তখন সেখানে বিক্ষোভ করেছিল স্থানীয়রা। এরপর যেন করোনা আতঙ্ক আরো জেঁকে বসে।
কোনো এক বাসায় করোনার রোগী পাওয়া গেলে ওই বাসাটিই পুরোপুরি লকডাউন করে দেওয়া হতো। সামান্য জ্বর আসার খবর জেনে বৃদ্ধা মাকে ঘর থেকে বের করে দেওয়ার মতো ঘটনারও সাক্ষী এই করোনাকাল। পরিস্থিতি আর মনোভাব এমন ছিল যে, করোনা আক্রান্ত বাবার লাশ হাসপাতালে রেখে পালিয়ে যেত সন্তানই, দাফন-কাফনে উপস্থিত থাকা তো দূরের কথা।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ৬৫ বছর বয়সী এক ব্যক্তির লাশ গত পয়লা এপ্রিলে তালতলা কবরস্থানে নেওয়া হয়। লাশটি নিয়ে যায় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আল মারকাজুল ইসলামীর চার ব্যক্তি। লাশটি দাফন করেন ওই কবরস্থানের চার গোরখোদকসহ মোট আটজন। করোনায় মারা যাওয়া রোগীর লাশ দাফন করা শুরু হলে ওই কবরস্থানের চারজন গোরখোদক পালিয়ে গ্রামে চলে যান।
৬৫ বছর বয়সী ওই ব্যক্তির দাফন শেষে আল মারকাজুল ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান মো. হামজা ইসলাম ঘটনাস্থলেই এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, ‘আমরা দুপুরের দিকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে যাই লাশটি আনতে। গিয়ে শুনতে পেলাম, লাশের সঙ্গে বৃদ্ধের ছেলে ছিলেন। কিন্তু লাশ কবরস্থানে আনা হবে—এমন খবর শুনে ওই বৃদ্ধের ছেলে হাসপাতাল থেকে পালিয়েছিলেন। আমরা তাঁকে আর খুঁজে পাইনি। ফোন করলেও তিনি আসেননি। অথচ মৃতের ছেলের জন্য আমরা এক ঘণ্টা হাসপাতালে অপেক্ষা করেছিলাম। পরে আমরা লাশ নিয়ে কবরস্থানে চলে এসেছি।’
এমনই এক প্রেক্ষাপটে করোনা পরিস্থিতি, বাস্তবতা ও করোনায় মনোভাব নিয়ে আলোচনার একপর্যায়ে জাতীয় টেকনিক্যাল পরামর্শক কমিটি ও সদস্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য (ভাইরোলজিস্ট) অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলছিলেন, রোগে আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা গেছেন হাসপাতালে। সেই খবর শোনার পর সন্তান হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়েছেন—এমন কথা করোনাকালের আগে কেউ শুনেছিল? যেন পৃথিবীর এক নতুন রূপ দেখছি আমরা।
তবে করোনাভাইরাস নিয়ে এখন মানুষের আতঙ্ক আগের মতো নেই, পাল্টেছে পরিস্থিতিও। করোনা আর কাজের সঙ্গে মানুষ মানিয়ে নিয়েছে। করোনায় আক্রান্ত মানুষ এখন বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন। কেউ আবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এখন করোনায় কেউ মারা গেলে তার পরিবার চাইলে লাশ নিজ এলাকাতেই দাফন করতে পারে। মানুষ জানাজাতেও অংশ নিচ্ছে। সব পরিবেশই স্বাভাবিক হয়ে উঠছে। স্বাভাবিক হয়নি শুধু প্রাণঘাতী করোনা। মানুষের প্রাণ কেড়েই চলেছে এই মারণ ভাইরাস।