রিফাত হত্যা মামলার অভিযোগপত্রে মিন্নিকে নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য
বরগুনার বহুল আলোচিত মো. শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফকে (২৬) হত্যার পর তাঁর স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি ছিলেন মামলার এক নম্বর সাক্ষী। প্রকাশ্যে এ নৃশংস হত্যার পর সারা দেশে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করে। রাজনৈতিক ইন্ধনে এ হত্যার কথা ধারণা করলেও সময়ের ব্যবধানে বেরিয়ে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। এ যেন বাংলা সিনেমাকেও হার মানিয়েছে। বেরিয়ে আসে মিন্নিই ছিলেন রিফাত শরীফ হত্যার মূল হোতা।
২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনে রিফাত শরীফকে হত্যার পরদিন তাঁর বাবা বাদী হয়ে একটি হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় মিন্নিকে এক নম্বর সাক্ষী করেন। মামলাটি তদন্ত করেন বরগুনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবির। প্রায় দুই মাস তদন্ত শেষে ১ সেপ্টেম্বর তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এই অভিযোগপত্রে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসে।
অভিযোগপত্রের ২০ ও ২৭ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়, গ্রেপ্তার হওয়া মিন্নির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তকালে দেখা যায়, রিফাত শরীফ বরগুনা থানা এলাকায় ডিশলাইনের ব্যবসা করতেন। ১ নম্বর আসামি মো. সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়নবন্ড ও রিফাত শরীফ একসঙ্গে বরগুনা জিলা স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। একসঙ্গে পড়ালেখার সুবাদে তাঁদের উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
২০১৭ সালে রিফাতের সঙ্গে আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির প্রেম হয়। পরে রিফাতের মাধ্যমে তাঁর বন্ধু নয়নবন্ডের সঙ্গে মিন্নির পরিচয় হয়। ২০১৮ সালে রিফাত শরীফ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দেড় মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময়ে নয়নবন্ডের সঙ্গে মিন্নির নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর নয়নবন্ডের বাড়িতে তাঁর সঙ্গে মিন্নির গোপনে বিয়ে হয়। সাক্ষী রায়হানুল ইসলামের মাধ্যমে কাজি আনিচুর রহমান পাঁচ লাখ টাকার দেনমোহরে তাঁদের বিয়ে সম্পাদন করেন। বিয়েতে নয়নবন্ডের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন আসামি রাকিবুল হাসনাত ফরাজী এবং মিন্নির পক্ষে সাক্ষী ছিলেন প্রতিবেশী ও বন্ধু মো. সাইফুল ইসলাম মুন্না। মিন্নি বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখেন এবং রিফাতের সঙ্গে পুরোনো প্রেমের সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। কিছুদিন পর আগের একটি মামলায় নয়নবন্ডকে কারাগারে পাঠান আদালত। তখন মিন্নি নয়নবন্ডকে তালাক না দিয়েই ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল রিফাতের সঙ্গে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, নয়নবন্ড কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেলে মিন্নি অত্যন্ত চতুরভাবে দুই স্বামীর সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি নয়নবন্ডের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন এবং তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখতেন। একপর্যায়ে রিফাত বিষয়টি জেনে যান এবং এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য ও ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়। তখন মিন্নি রিফাতের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদ (ডিভোর্স) চান এবং নয়নবন্ডের কাছে ফিরে যেতে চান।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, রিফাতের সঙ্গে বিয়ের আগে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নয়নবন্ড ইউটিডিসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তাঁর জন্মদিন পালন করেন। ওই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মিন্নি। সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও মোবাইল ফোনে ধারণ করেছিলেন নয়নবন্ডের বন্ধু হেলাল শিকদার। এ ভিডিওটি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। এটি দেখে রিফাত ২৪ জুন হেলাল শিকদারকে ডেকে নিয়ে ভিডিওটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তাঁর মোবাইল ফোনটি নিয়ে যান। পরে হেলাল বিষয়টি নয়নবন্ডকে জানান। নয়নবন্ড বিষয়টি রিফাত ফরাজীকে জানান। রিফাত ফরাজী মিন্নির স্বামী রিফাত শরীফের কাছে মোবাইল ফোনটি ফেরত চাইলে রিফাত তাঁকে গালাগাল করেন। বিষয়টি মিন্নিকে জানান নয়নবন্ড। এ নিয়ে মিন্নির সঙ্গে রিফাত শরীফের ঝগড়া হয় এবং একপর্যায়ে রিফাত শরীফ মিন্নির তলপেটে লাথি মারেন। এতে ক্ষুব্ধ মিন্নি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ফোনে ঘটনাটি নয়নবন্ডকে জানান এবং পরদিন ২৫ জুন কলেজে যাওয়ার নাম করে নয়নবন্ডের বাড়িতে যান। সেখানে মিন্নি পথের কাঁটা দূর করার জন্য নয়নবন্ডের সঙ্গে রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। নয়নবন্ড মিন্নির কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে ওই দিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের শহীদ মিনারে আসামিদের সঙ্গে বৈঠক করে রিফাত শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। একই সঙ্গে আসামিদের সকাল ৯টায় কলেজের সামনে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২৬ জুন সকালবেলা মিন্নি কলেজের সায়েন্স বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে আসামি রিফাত ফরাজী, রাব্বি আকন ও রিফাত হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করেন। আসামিদের খালি হাতে দেখে মিন্নি বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং রিফাত ফরাজীর কাছে জানতে চান, তাঁরা খালি হাতে কেন এবং রিফাত শরীফকে কী দিয়ে মারবে? ওই সময় মিন্নিকে নিতে কলেজের গেটে আসেন রিফাত শরীফ। তখন মিন্নি রিফাত শরীফের সঙ্গে কলেজের গেটের সামনে রাখা মোটরসাইকেলের কাছে যান। কিন্তু পূর্বপরিকল্পনামাফিক গেটের আশপাশে থাকা আসামিদের সুযোগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবং সময়ক্ষেপণ করার জন্য মিন্নি পুনরায় কলেজে ফিরে যান। এ সময় রিফাত শরীফ মিন্নিকে ফেরাতে পেছনে পেছনে কলেজের দিকে যান। তখন রিফাত শরীফের ওপর হামলা করার জন্য আসামিদের ইশারা দেন মিন্নি। আসামি রিফাত ফরাজীসহ অন্যরা মিন্নির স্বামীকে জাপটে ধরে মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে ক্যালিক্স একাডেমির সামনে নিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় মিন্নি স্বাভাবিকভাবে তাঁদের পেছনে হেঁটে যান।
অভিযোগপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, আসামি রিফাত ফরাজী দৌড়ে গিয়ে পূর্ব পাশের দেয়ালসংলগ্ন গলির মুখে জনৈক নুরুল হকের বারান্দার টিনের চালের ওপরে রাখা ব্যাগের মধ্য থেকে দুই হাতে দুটি বগি দা নিয়ে আসেন। একই সময় আসামি টিকটক হৃদয় ও রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার দৌড়ে গিয়ে দুটি লাঠি নিয়ে আসেন। আসামি রিফাত ফরাজী একটি দা রাস্তার ওপরে রেখে অন্যটি দিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এ সময় আসামি নয়নবন্ড আসামি রিফাত ফরাজীর হাত থেকে বগি দা নিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। আসামি রিফাত ফরাজী তখন রাস্তার ওপরে রাখা অন্য বগি দাটি নিয়ে পুনরায় রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। আসামি রিশান ফরাজী তখন রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে রাখেন। আসামি টিকটক হৃদয় ও রাকিবুল হাসান রিফাত হাওলাদার লাঠি হাতে হত্যাকাণ্ড নির্বিঘ্ন করার জন্য পাহারা দেন। ওই সময় আসামি মোহাইমিনুল ইসলাম, সিফাত, মো. নাজমুল হাসান, প্রিন্স মোল্লা, আবু আবদুল্লাহ রায়হান, আল কাইয়ুম রাব্বি আকন, নাঈম, অলি উল্লাহ অলি, রাকিবুল হাসান নিয়ামত, জয় চন্দ্র সরকার ওরফে চন্দন, মো. হাসান, মারুফ বিল্লাহ ওরফে মহিবুল্লাহ, মো. মুসা, মারুফ মল্লিক ও রাতুল সিকদার জয় পাহারা দেন। আসামি মিন্নি শুরুতে স্বাভাবিক থাকলেও পরে দায় এড়ানোর জন্য কৌশলে রিফাতকে বাঁচানোর অভিনয় করেন এবং শুধু নয়নবন্ডকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। এরপর লোকজন জড়ো হলে তাঁরা পালিয়ে যান।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মিন্নি ঘটনার দায় এড়াতে যেহেতু স্বামীকে বাঁচানোর অভিনয় করেন, এ কারণে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আসামিরা মিন্নিকে আঘাত করেননি। এ সময় রক্তাক্ত রিফাত শরীফ একাই রিকশায় করে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হলেও মিন্নিকে তখন রাস্তায় পড়ে থাকা তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগ ও জুতা কুড়াতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। পরে মিন্নি রিকশায় করে রিফাত শরীফের সঙ্গে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর মুমূর্ষু রিফাত শরীফকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বলেন চিকিৎসকেরা। তখন মিন্নি তাঁর জামাকাপড় রক্তে ভেজা, তাই বরিশাল যাওয়া সম্ভব নয়—এই অজুহাত দেখিয়ে নিজের বাবার বাড়িতে চলে যান এবং হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নয়নবন্ডকে মোবাইল ফোনে দ্রুত নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি মিন্নি, রিফাত ফরাজী, রাশিদুল হাসান রিশান, মো. হাসান, টিকটক হৃদয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া ১৬১ ধারায় রেকর্ড করা সাক্ষীদের জবানবন্দি, বস্তুগত প্রমাণ, সিসিটিভি ফুটেজ, সিডিআর এবং সার্বিকভাবে পারিপার্শ্বিক অবস্থাগত সাক্ষ্যে প্রাপ্ত তথ্যে আসামি মিন্নির বিরুদ্ধে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
রিফাত শরীফ হত্যা মামলার রায় কাল বুধবার। ২৪ আসামির মধ্যে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির রায় ঘোষণা করবেন বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান। মামলার প্রধান আসামি মো. সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়নবন্ড পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন এবং অন্য একজন আসামি মো. মুসা পলাতক।
এ মামলায় মোট ৭৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন বরগুনার সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ভুবন চন্দ্র হালদার। সঙ্গে ছিলেন প্যানেলভুক্ত আইনজীবী এ এম মুজিবুল হক কিসলু ও মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল। আসামিদের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মাহবুবুল বারী আসলাম, মো. শাহজাহান মিয়া, হুমায়ুন কবীর, অলি উল্ল্যাহ সবুজ ও আবদুর রহমান নান্টু।
রায়ের বিষয়ে আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির আইনজীবী মাহবুবুল বারী আসলাম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘মামলাটি করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও দ্রুতগতিতে শেষ হয়েছে। আমি আশা করি, আমার মক্কেল আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি খালাস পাবেন, কেননা মিন্নি জীবনবাজি রেখে রিফাতকে বাঁচাতে রামদার নিচে গিয়েছিলেন এবং আহত হওয়ার পর তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছেন।’
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী এ এম মুজিবুল হক কিসলু এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডের পেছনে সব ষড়যন্ত্রের মূল হোতা ছিলেন মিন্নি। নয়নবন্ডের সঙ্গে বিয়ে গোপন করে রিফাতকে বিয়ে করেন। আবার দুজনের সঙ্গেই শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখেন। একপর্যায়ে রিফাতকে পথের কাঁটা ভেবে সরিয়ে দিতে হত্যার পরিকল্পনা করেন। মিন্নির এবং সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি হবে বলে প্রত্যাশা করি।’
অন্যদিকে, গত ৮ জানুয়ারি রিফাত শরীফ হত্যা মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বরগুনার শিশু আদালত। অপ্রাপ্তবয়স্ক আট আসামি উচ্চ আদালত ও বরগুনার শিশু আদালতের আদেশে জামিনে রয়েছে।