রিফাত হত্যা মামলায় রায় পড়া শুরু
বরগুনার বহুল আলোচিত মো. শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফ (২৬) হত্যা মামলায় রায় পড়া শুরু হয়েছে। আজ বুধবার বরগুনা জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান আজ বুধবার দুপুর ১টা ২০ মিনিটের দিকে রায় পড়া শুরু করেন।
রায় ঘোষণা উপলক্ষে এর আগে আজ সকাল পৌনে ৯টায় মামলার অন্যতম আসামি ও নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি তাঁর বাবা মোজাম্মেল হোসেন কিশোরের সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে আদালতে আসেন। এ সময় আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি সাদা থ্রিপিস পরা ছিলেন। এরপরে বেলা ১১টা ৪৩ মিনিটে কারাগারে থাকা আট আসামিকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। পরে তাঁদের আদালতের গারদখানায় রাখা হয়। সেখান থেকে রায় উপলক্ষে কড়া পুলিশি পাহারায় তাঁদের আদালতের কাঠগড়ায় ওঠানো হয়। মামলার আরেক আসামি মো. মুসা ঘটনার পর থেকে পলাতক।
বেলা ১১টা ৪৩ মিনিটে মামলার প্রাপ্তবয়স্ক আট আসামিকে বরগুনা কারাগার থেকে বের করে আদালতে আনা হয়। আট আসামি হলেন—রাকিবুল হাসান রিফাত ওরফে রিফাত ফরাজী (২৩), আল কাইয়ুম ওরফে রাব্বি আকন (২১), মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত (১৯), মো. রেজওয়ান আলী খান হৃদয় ওরফে টিকটক হৃদয় (২২), মো. হাসান (১৯), রাফিউল ইসলাম রাব্বি (২০), মো. সাগর (১৯) ও কামরুল হাসান সাইমুন (২১)।
গত বছরের ২৬ জুন প্রকাশ্যে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয় রিফাত শরীফকে। মামলার ২৪ আসামির মধ্যে নিহত রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিসহ প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির রায় ঘোষণা করেন জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামান। মামলার প্রধান আসামি মো. সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়নবন্ড গত বছরের ২ জুলাই ভোররাতে পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। অন্য একজন আসামি মো. মুসা আগে থেকেই পলাতক।
এ মামলায় মোট ৭৬ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন বরগুনার সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ভুবন চন্দ্র হালদার। সঙ্গে ছিলেন প্যানেলভুক্ত আইনজীবী এ এম মুজিবুল হক কিসলু ও মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল। আসামিদের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মাহবুবুল বারী আসলাম, মো. শাহজাহান মিয়া, হুমায়ুন কবীর, অলি উল্ল্যাহ সবুজ ও আবদুর রহমান নান্টু।
কী ঘটেছিল সেদিন
রিফাত শরীফ বরগুনা জেলা শহরের উত্তর বড়লবণগোলা এলাকার বাসিন্দা মো. আবদুল হালিম দুলাল শরীফের ছেলে। তিনি জেলা শহরে ডিশলাইনের ব্যবসা করতেন। রিফাত ১ নম্বর আসামি নয়নবন্ডের সঙ্গে বরগুনা জিলা হাই স্কুলে পড়াশোনা করেছেন এবং এবং তাঁদের উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে কেন্দ্র করে তাঁদের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি হয়।
২০১৯ সালের ২৬ জুন বরগুনা সরকারি কলেজের সামনের সড়কে সকাল ১০টা ১০ মিনিটের দিকে প্রকাশ্যে নয়নবন্ড ও তাঁর সহযোগীরা রিফাতকে কুপিয়ে হত্যা করেন। হত্যাকাণ্ডের সময় রিফাতের স্ত্রী আয়শা সিদ্দিকা মিন্নি ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন। এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় পরদিন ২৭ জুন দুলাল শরীফ বাদী হয়ে ১২ জনের নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত আরো পাঁচ-ছয়জনকে আসামি করে সদর থানায় একটি হত্যা মামলা (নম্বর ৩১, তাং-২৭/৬/১৯) করেন। মামলায় উল্লেখ করা ১২ আসামি হলেন—সাব্বির আহম্মেদ নয়ন, মো. রিফাত ফরাজী, মো. রিশান ফরাজী, চন্দন, মো. মুসা, মো. রাব্বি আকন, মোহাইমিনুল ইসলাম সিফাত, রায়হান, মো. হাসান, রিফাত, অলি ও টিকটক হৃদয়।
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘আসামিরা এলাকার চিহ্নিত সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারী। আমার ছেলে মো. শাহনেওয়াজ রিফাত শরীফের সঙ্গে তিন মাস আগে বরগুনা পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের পুলিশ লাইন মাইঠা গ্রামের মো. কিশোরের মেয়ে আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির বিয়ে হয়। বিয়ের আগে মিন্নির সঙ্গে ১ নম্বর আসামি মো. সাব্বির আহম্মেদ নয়ন ওরফে নয়নবন্ডের (২৫) প্রেমের সম্পর্ক ছিল বলে নয়ন দাবি করে। রিফাতের সঙ্গে মিন্নির বিয়ের খবর জানার পর থেকেই নয়ন ও তার সহযোগী অন্য আসামিরা রিফাতকে বিভিন্ন সময় হত্যাসহ নানা রকম ভয়ভীতি ও হুমকি দিতে থাকে। মিন্নি বরগুনা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে লেখাপড়া করে।’
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ২৬ জুন ঘটনার দিন মিন্নি কলেজে যান। আনুমানিক সকাল ১০টা ১০ মিনিটে রিফাত তাঁর স্ত্রী মিন্নির সঙ্গে দেখা করতে বরগুনা সরকারি কলেজের গেটের সামনে যান। সেখানে ওত পেতে থাকা সব আসামি খুনের এক ও অভিন্ন উদ্দেশ্যে রিফাতকে ঘিরে ফেলে এবং অতর্কিতে ১ নম্বর আসামি নয়ন তাঁর হাতে থাকা ধারালো বগি দা (রামদা) দিয়ে রিফাতকে হত্যার উদ্দেশ্যে ঘাড় লক্ষ্য করে কোপ দেন। এতে রিফাতে গলার ডান পাশের হাড় ও রগ কাটা পড়ে রক্তাক্ত জখম হয়। ওই সময় ২ নম্বর আসামি রিফাত ফরাজী তাঁর হাতে থাকা ধারালো দা দিয়ে কোপ দেন এবং সেই কোপ রিফাতের বুকের ডান পাশে পড়লে হাড় কাটা পড়ে জখম হয়। একই সময়ে ৩ নম্বর আসামি রিশান ফরাজী তাঁর হাতে থাকা দা দিয়ে রিফাতের মাথায় কোপ দেন এবং এতে তিনি গুরুতর জখম হন। তখন অন্য আসামিরা রিফাতের শরীরের বিভিন্ন স্থানে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে রাস্তায় ফেলে চলে যান। পরে স্থানীয় কিছু লোকের সহায়তায় রিফাতকে রিকশায় করে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে যান মিন্নি। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেন।
বাদী ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এজাহারে আরো উল্লেখ করেন, টেলিফোনে খবর পেয়ে তিনি হাসপাতালে ছুটে যান এবং ছেলের মুখে ঘটনার বিবরণ শুনতে পান। পরে রিফাতের অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে বরিশাল শেরেবাংলা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ঘটনার দিন বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে রিফাত মারা যান।
মামলায় সাক্ষী হিসেবে রিফাতের স্ত্রী মিন্নি, আবদুস সালাম, আ. আজিজ শরীফ, মো. মনজুরুল আলম জন, মো. লিটন, আনোয়ার হোসেন মৃধা, মো. জাকারিয়া বাবু, মো. হারুন, আ. হাই আল হাদি, মো. সজলের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, মামলায় আরো সাক্ষী আছে।
নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। চারদিকে শুরু হয় প্রতিবাদ। পুলিশ পরে গত বছরের ১৯ জুলাই পর্যন্ত এজাহারভুক্ত ছয় আসামিসহ ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে। তবে প্রধান আসামি নয়নবন্ড পুলিশের অভিযানের সময় ২ জুলাই রাত সোয়া ৪টার দিকে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন।
এদিকে, হত্যাকাণ্ডের একাধিক ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ এবং মিন্নির সঙ্গে মামলার ১ নম্বর আসামি নয়নবন্ডের একাধিক ফোনালাপের খবর ফাঁস হলে ঘটনা নাটকীয় মোড় নেয়। মিন্নিও হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত বলে অভিযোগ ওঠে। এ ঘটনায় রিফাতের বাবা আবদুল হালিম দুলাল শরীফ ১৩ জুলাই বরগুনা প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে মিন্নির গ্রেপ্তার দাবি জানান। পরদিন ১৪ জুলাই মিন্নি তাঁর বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে বলেন, “যারা বরগুনায় ‘বন্ড ০০৭’ সন্ত্রাসী গ্রুপ করেছিল, তারা খুবই ক্ষমতাবান ও বিত্তশালী। তারাই মামলাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে আমার শ্বশুরকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করিয়েছে।”
১৬ জুলাই আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের হেফাজতে নিয়ে মিন্নিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে মিন্নিকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়।
তদন্তে মোড়, বেরিয়ে আসে মিন্নির গোপন তথ্য
এ মামলা তদন্ত করেন বরগুনা সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. হুমায়ুন কবির। প্রায় দুই মাস তদন্ত শেষে গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এই অভিযোগপত্রে হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য বেরিয়ে আসে।
অভিযোগপত্রের ২০ ও ২৭ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়, গ্রেপ্তার হওয়া মিন্নির বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তকালে দেখা যায়, রিফাত বরগুনা থানা এলাকায় ডিশলাইনের ব্যবসা করতেন। ১ নম্বর আসামি নয়নবন্ড ও রিফাত শরীফ একসঙ্গে বরগুনা জিলা স্কুলে পড়ালেখা করেছেন। একসঙ্গে পড়ালেখার সুবাদে তাঁদের উভয়ের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
২০১৭ সালে রিফাতের সঙ্গে আয়শা সিদ্দিকা মিন্নির প্রেম হয়। পরে রিফাতের মাধ্যমে তাঁর বন্ধু নয়নবন্ডের সঙ্গে মিন্নির পরিচয় হয়। ২০১৮ সালে রিফাত শরীফ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত হয়ে দেড় মাস চিকিৎসাধীন ছিলেন। এ সময়ে নয়নবন্ডের সঙ্গে মিন্নির নতুন প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ২০১৮ সালের ১৫ অক্টোবর নয়নবন্ডের বাড়িতে নয়নবন্ডের সঙ্গে মিন্নির গোপনে বিয়ে হয়। সাক্ষী রায়হানুল ইসলামের মাধ্যমে কাজী আনিচুর রহমান পাঁচ লাখ টাকার দেনমোহরে তাঁদের বিয়ে সম্পাদন করেন। বিয়েতে নয়নবন্ডের পক্ষে সাক্ষী ছিলেন আসামি রাকিবুল হাসনাত ফরাজী এবং মিন্নির পক্ষে সাক্ষী ছিলেন প্রতিবেশী ও বন্ধু মো. সাইফুল ইসলাম মুন্না। মিন্নি বিয়ের বিষয়টি গোপন রাখেন এবং রিফাতের সঙ্গে পুরোনো প্রেমের সম্পর্ক অব্যাহত রাখেন। কিছুদিন পর আগের একটি মামলায় নয়নবন্ডকে কারাগারে পাঠান আদালত। তখন মিন্নি নয়নবন্ডকে তালাক না দিয়েই ২০১৯ সালের ২৬ এপ্রিল রিফাতের সঙ্গে পুনরায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, নয়নবন্ড কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পেলে মিন্নি অত্যন্ত চতুরভাবে দুই স্বামীর সঙ্গেই সম্পর্ক বজায় রাখতেন। তিনি নয়নবন্ডের বাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন এবং তাঁর সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক বজায় রাখতেন। একপর্যায়ে রিফাত বিষয়টি জেনে যান এবং এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য ও ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়। তখন মিন্নি রিফাতের কাছে বিবাহ বিচ্ছেদ (ডিভোর্স) চান এবং নয়নবন্ডের কাছে ফিরে যেতে চান।
অভিযোগপত্রে আরো বলা হয়, রিফাতের সঙ্গে বিয়ের আগে ২০১৯ সালের মার্চ মাসে নয়নবন্ড ইউটিডিসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে তাঁর জন্মদিন পালন করেন। ওই জন্মদিনের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন মিন্নি। সেই অনুষ্ঠানের ভিডিও মেবাইল ফোনে ধারণ করেছিল নয়নবন্ডের বন্ধু হেলাল শিকদার। এ ভিডিওটি তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন। এটি দেখে রিফাত ২৪ জুন হেলাল শিকদারকে ডেকে নিয়ে ভিডিওটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং তাঁর মোবাইল ফোনটি নিয়ে যান। পরে হেলাল বিষয়টি নয়নবন্ডকে জানান। নয়নবন্ড বিষয়টি রিফাত ফরাজীকে জানান। পরে রিফাত ফরাজী মিন্নির স্বামী রিফাতের কাছে মোবাইল ফোনটি ফেরত চাইলে রিফাত তাঁকে গালাগাল করেন। বিষয়টি মিন্নিকে জানান নয়নবন্ড। এ নিয়ে মিন্নির সঙ্গে রিফাতের ঝগড়া হয় এবং একপর্যায়ে রিফাত মিন্নির তলপেটে লাথি মারেন। এতে ক্ষুব্ধ মিন্নি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে ফোনে ঘটনাটি নয়নবন্ডকে জানান এবং পরদিন ২৫ জুন কলেজে যাওয়ার নাম করে নয়নবন্ডের বাড়িতে যান। সেখানে মিন্নি পথের কাঁটা দূর করার জন্য নয়নবন্ডের সঙ্গে রিফাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেন।
নয়নবন্ড মিন্নির কাছ থেকে প্রস্তাব পেয়ে ওই দিন বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে বরগুনা সরকারি কলেজের শহীদ মিনারে আসামিদের সঙ্গে বৈঠক করে রিফাতকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। একই সঙ্গে আসামিদের সকাল ৯টায় কলেজের সামনে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা দিয়ে অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, ২৬ জুন সকালবেলা মিন্নি কলেজের সায়েন্স বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়ে আসামি রিফাত ফরাজী, রাব্বি আকন, রিফাত হাওলাদারের সঙ্গে দেখা করেন। আসামিদের খালি হাতে দেখে মিন্নি বিস্ময় প্রকাশ করেন এবং রিফাত ফরাজীর কাছে জানতে চান, তারা খালি হাতে কেন এবং রিফাতকে কী দিয়ে মারবে? ওই সময় মিন্নিকে নিতে কলেজের গেটে আসেন রিফাত। তখন মিন্নি রিফাতের সঙ্গে কলেজের গেটের সামনে রাখা মোটরসাইকেলের কাছে যান। কিন্তু পূর্বপরিকল্পনামাফিক গেটের আশপাশে থাকা আসামিদের সুযোগ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে এবং সময়ক্ষেপণ করার জন্য মিন্নি পুনরায় কলেজে ফিরে যান। এ সময় রিফাত মিন্নিকে ফেরাতে পেছনে পেছনে কলেজের দিকে যান। তখন রিফাতকে হামলা করার জন্য আসামিদের ইশারা দেন মিন্নি। তখন আসামি রিফাত ফরাজীসহ অন্যরা মিন্নির স্বামীকে জাপটে ধরে মারতে মারতে টেনেহিঁচড়ে ক্যালিক্স একাডেমির সামনে নিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় মিন্নি স্বাভাবিকভাবে তাঁদের পেছনে হেঁটে যান।
অভিযোগপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়, আসামি রিফাত ফরাজী দৌড়ে গিয়ে পূর্ব পাশের দেয়ালসংলগ্ন গলির মুখে জনৈক নুরুল হকের বারান্দার টিনের চালের ওপরে রাখা ব্যাগের মধ্য থেকে দুই হাতে দুটি বগি দা নিয়ে আসেন। একই সময় আসামি টিকটক হৃদয় ও রিফাত হাওলাদার দৌড়ে গিয়ে দুটি লাঠি নিয়ে আসেন। আসামি রিফাত ফরাজী একটি দা রাস্তার ওপরে রেখে অন্যটি দিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এ সময় আসামি নয়নবন্ড আসামি রিফাত ফরাজীর হাত থেকে বগি দা নিয়ে রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। আসামি রিফাত ফরাজী তখন রাস্তার ওপরে রাখা অন্য বগি দাটি নিয়ে পুনরায় রিফাত শরীফকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। আসামি রিশান ফরাজী তখনো রিফাত শরীফকে জাপটে ধরে রাখেন। আসামি টিকটক হৃদয় ও রাকিবুল হাসান রিফাত লাঠি হাতে হত্যাকাণ্ড নির্বিঘ্ন করার জন্য পাহারা দেন। ওই সময় আসামি মোহাইমিনুল ইসলাম, সিফাত, মো. নাজমুল হাসান, প্রিন্স মোল্লা, আবু আবদুল্লাহ রায়হান, আল কাইয়ুম রাব্বি আকন, নাঈম, অলি উল্লাহ অলি, রাকিবুল হাসান নিয়ামত, জয় চন্দ্র সরকার ওরফে চন্দন, মো. হাসান, মারুফ বিল্লাহ ওরফে মহিবুল্লাহ, মো. মুসা, মারুফ মল্লিক ও রাতুল সিকদার জয় পাহারা দেন। আসামি মিন্নি শুরুতে স্বাভাবিক থাকলেও পরে দায় এড়ানোর জন্য কৌশলে রিফাতকে বাঁচানোর অভিনয় করেন এবং শুধু নয়নবন্ডকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। এরপর লোকজন জড়ো হলে তাঁরা পালিয়ে যান।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, মিন্নি ঘটনার দায় এড়াতে যেহেতু স্বামীকে বাঁচানোর অভিনয় করেন, এ কারণে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আসামিরা মিন্নিকে আঘাত করেনি। এ সময় রক্তাক্ত রিফাত শরীফ একাই রিকশাযোগে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন। মিন্নিকে তখন রাস্তায় পড়ে থাকা তাঁর ভ্যানিটি ব্যাগ ও জুতা কুড়াতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায়। পরে মিন্নি রিকশায় করে রিফাত শরীফের সঙ্গে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসার পর মুমূর্ষু রিফাতকে বরিশাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করতে বলেন চিকিৎসকেরা। তখন মিন্নি তাঁর জামাকাপড় রক্তে ভেজা, তাই বরিশাল যাওয়া সম্ভব নয়—এই অজুহাত দেখিয়ে নিজের বাবার বাড়িতে চলে যান এবং হত্যাকাণ্ডের প্রধান আসামি নয়নবন্ডকে মোবাইল ফোনে দ্রুত নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, আসামি মিন্নি, রিফাত ফরাজী, রাশিদুল হাসান রিশান, মো. হাসান ও টিকটক হৃদয় ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। এ ছাড়া ১৬১ ধারায় রেকর্ড করা সাক্ষীদের জবানবন্দি, বস্তুগত প্রমাণ, সিসিটিভি ফুটেজ, সিডিআর এবং সার্বিকভাবে পারিপার্শ্বিক অবস্থাগত সাক্ষ্যে প্রাপ্ত তথ্যে আসামি মিন্নির বিরুদ্ধে রিফাত শরীফ হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার বিষয়টি প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে।
নয়নবন্ডকে অব্যাহতি
অভিযোগপত্রে শেষ পাতায় তদন্ত কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, আসামিদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ জন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ জন। তার মধ্যে প্রধান আসামি নয়নবন্ড ২০১৯ সালের ২ জুলাই পুলিশের সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হন। এ কারণে তাঁকে মামলা থেকে অব্যাহতিদানের প্রার্থনা করলাম। অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার সত্যতা প্রাথমিকভাবে পাওয়া গেছে।
বিচার শুরু
ওই বছরের ৬ নভেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচারের জন্য মামলাটি জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠান সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। চলতি বছরের ১ জানুয়ারি জেলা ও দায়রা জজ মো. আছাদুজ্জামানের আদালতে প্রাপ্তবয়স্ক ১০ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু হয়। ৮ জানুয়ারি থেকে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু করেন আদালত। এরপর মোট ৭৬ সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়। সব আসামির পক্ষে-বিপক্ষে আদালতে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা। গত ১৬ সেপ্টেম্বর যুক্তি খণ্ডন শেষে আজ ৩০ সেপ্টেম্বর রায়ের দিন ধার্য করেন আদালত।
অন্যদিকে, গত ৮ জানুয়ারি রিফাত হত্যা মামলার অপ্রাপ্তবয়স্ক ১৪ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন বরগুনার শিশু আদালত। অপ্রাপ্তবয়স্ক আট আসামি উচ্চ আদালত ও বরগুনার শিশু আদালতের আদেশে জামিনে রয়েছে।