‘সিমেন্ট ছাড়াই’ স্কুল নির্মাণ, ভেঙে পড়ল সিঁড়ি!
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় স্কুলভবন নির্মাণের দুই সপ্তাহের মাথায় ভেঙে পড়েছে সিঁড়ি। এতে এক নির্মাণ শ্রমিক আহত হন। অভিযোগ উঠেছে, ইট-বালুর সঙ্গে সামান্য সিমেন্ট দিয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে।
আজ শনিবার উপজেলার কাথুলী ইউনিয়নের নবীনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি ভেঙে পড়ে। এতে মোক্তার আলী নামের এক নির্মাণশ্রমিক আহত হন। তিনি কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার পান্টি গ্রামের শরিফুল ইসলামের ছেলে।
সিঁড়ি ভেঙে পড়ার ঘটনায় ওই ভবন নির্মাণকারী ঠিকাদার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
স্কুলটির শিক্ষক ও স্থানীয়রা জানান, পিইডিপি-৩ প্রকল্পের আওতায় ৬৩ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে গত বছরের মে মাসে নবীনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ শুরু করে তামান্না এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজটি কিনে নেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ খালেক ও তাঁর ব্যবসায়িক সহযোগী মোনায়েম হোসেন মুলাক।
ভবন নির্মাণকাজের প্রথম থেকে সিমেন্ট কম দেওয়া, দুর্বল ইট ব্যবহার করাসহ নানা অনিয়ম করলেও ঠিকাদার প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা কথা বলার সাহস পাননি। স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিক ও শিক্ষক এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে কয়েকজন শ্রমিককে কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়। এমনকি তাঁদের কয়েক দিনের পারিশ্রমিকও পরিশোধ করা হয়নি। শিক্ষকরা প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁদের সঙ্গে ঠিকাদার পক্ষের লোকজনের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
এদিকে, আজ নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাইয়ের জন্য সাটারিংয়ের কাজ শেষে নামতে গিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে পড়ে যান শ্রমিক মোক্তার আলী। এতে তিনি আহত হন। অথচ গত ২২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি ঢালাইয়ের কাজ করা হয়। দুই সপ্তাহের মাথায় সিঁড়ি ভেঙে পড়ার সময় বিদ্যালয়ের পুরাতন টিনশেড ভবনে ক্লাস চলছিল। সিঁড়ি ভেঙে পড়ার শব্দে স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে এদিক-ওদিক পালাতে থাকেন।
খবর পেয়ে গাংনী উপজেলা এলজিইডির প্রকৌশলী মাহবুবুল হক ঘটনাস্থলে যান। সেখানে তিনি এলাকাবাসীর তোপের মুখে পড়েন। এ সময় তিনি ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে স্থানীয়রা শান্ত হন।
বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র রাব্বি হোসেন জানায়, ‘আমরা ক্লাসে ছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দ হয়। প্রথমে মনে হয়েছিল বোধহয় ভূমিকম্প হচ্ছে। কিন্তু পরে দেখি স্কুলের সিঁড়ি ভেঙে পড়েছে।’
মো. সাইফ হোসেন নামে একই শ্রেণির অপর শিক্ষার্থী জানায়, ‘স্কুলেই আমাদের নিরাপত্তা নেই। বিল্ডিং হওয়ার আগেই সিঁড়ি ভেঙে গেল। পরে যে কি হয়!’
জাহিদুর রহমান নামের এক অভিভাবক বলেন, ‘ইঞ্জিনিয়াররা টাকা খেয়ে এ বিল্ডিং বানাচ্ছে। শিশুরা কোনো পাপ করেনি। তাই বিল্ডিং চালু হওয়ার আগেই এটা ভেঙে ভেঙে পড়ল। স্কুলের ভবন নতুন করে ভালোভাবে তৈরি করা না হলে আমাদের সন্তানদের আর স্কুলে পাঠাব না।’
নবীনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নুরুন নাহার শেলী বলেন, ‘ঠিকাদার ঠিকমতো সিমেন্ট, রড ও ভালো ইট না দেওয়ায় ঢালাইয়ের দুই সপ্তাহ পরেই সিঁড়িটি ভেঙে গেল। এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গেলে ঠিকাদার এম এ খালেকের লোকজন শিক্ষকদের নানা রকম হুমকি দিতেন।’
বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সাবেক সভাপতি জাবের আলী বলেন, ‘আমি এই স্কুলে জমি দান করেছিলাম। স্কুলের ভবন তৈরি করার সময় দরপত্রের শিডিউল অনুযায়ী কাজ না করায় আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। কাজ ঠিকমতো দেখে নেওয়ার জন্য ব্যক্তিগত খরচে দুজন শ্রমিকও রেখেছিলাম। তারপরও আমার কথা না মেনে তারা উল্টো ভয়-ভীতি দেখাতে শুরু করে। তাই একপর্যায়ে তাদের চাপে আমি স্কুলের সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়াই।’
বিদ্যালয়ের নতুন সভাপতি সুমন আলী বলেন, ‘অনিয়ম করে ভবন করা হয়েছে। এ ভবন পুনরায় নতুন করে নির্মাণ করতে হবে। তা না হলে স্থানীয় অভিভাবকরা তাঁদের সন্তানদের এখানে লেখাপড়া করতে পাঠাবেন না।’
এলজিইডির গাংনী উপজেলা প্রকৌশলী মাহবুবুল হক বলেন, ‘শিডিউল অনুযায়ী যে পরিমাণ সিমেন্ট দেওয়ার কথা ছিল তার থেকে অনেক কম দেওয়া হয়েছে। তাই বালু, সিমেন্ট ও খোয়া জমাট বাঁধতে পারেনি। যে কারণে সিঁড়ি ধসে পড়েছে।’
প্রকৌশলী আরো বলেন, ‘দ্বিতীয় তলার সিঁড়িটি ঢালাইয়ের সময় আমাদের কাউকে ডাকা হয়নি। ফলে ওই কাজে সিমেন্টে যথেষ্ট ফাঁকি দেওয়া হয়েছে। এ ধরনের অনিয়মের ফলে ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
ওই ভবন নির্মাণকাজের ঠিকাদার ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেক বলেন, ‘আমি এ বিষয়ে কিছু জানি না। তামান্না এন্টারপ্রাইজের চারটি কাজের মধ্যে নবীনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনসহ দুটি কাজ করছেন ঠিকাদার মোনায়েম হোসেন মুলাক।’
ঠিকাদার মোনায়েম হোসেন মুলাক বলেন, ‘রাজমিস্ত্রিদের (শ্রমিকদের) ভুলে সিঁড়ি ভেঙে গেছে। শ্রমিকরা সিমেন্ট বিক্রি করে খেয়েছে। তাই তারা কম সিমেন্ট দিয়েছে।’
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) পরিমল সিংহ বলেন, ‘আমি এখনো বিষয়টি সম্পর্কে কিছু জানি না। বিষয়টি সত্য হলে খতিয়ে দেখে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’