‘সিমেন্ট ছাড়াই’ স্কুল, শুধু শ্রমিকপ্রধানের নামে জিডি!
মেহেরপুরের গাংনী উপজেলায় নির্মাণাধীন স্কুলভবনের সিঁড়িধসের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে বাদ দিয়ে শুধু একজনের নামে থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়েছে। গতকাল শনিবার রাতেই উপজেলা এলজিইডি প্রকৌশলী কার্যালয় থেকে গাংনী থানায় স্কুলভবন নির্মাণশ্রমিকের প্রধান রফিকুল ইসলামের নামে জিডি করা হয়।
গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আনোয়ার হোসেন জিডির বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
তবে অভিযোগ উঠেছে, ইট-বালুর সঙ্গে সামান্য সিমেন্ট দিয়ে ভবনটি তৈরি করা হয়েছে। যে কারণে নির্মাণের দুই সপ্তাহের মাথায় ধসে পড়েছে ভবনের সিঁড়ি। ঠিকাদার আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হওয়ায় তাঁকে বাদ দিয়ে নির্মাণশ্রমিকের নামে জিডি করা হয়েছে।
স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) গাংনী উপজেলা প্রকৌশলী মাহবুবুল হক বলেন, ‘ঘটনার দিন রাতেই নির্মাণাধীন ভবনের প্রধান নির্মাণশ্রমিকের নামে গাংনী থানায় জিডি করা হয়েছে।’ ঠিকাদারকে বাদ দিয়ে শ্রমিকের নামে জিডি করার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে শ্রমিকের নামে জিডি করা হয়েছে।’
শ্রমিকদের দলনেতা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘ঠিকাদার যেভাবে কাজ করতে বলেছে আমরা সেভাবেই করেছি। থানায় জিডি বা অভিযোগের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।’
এদিকে, আজ রোববার উপজেলার নবীনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলার সিঁড়িধসের ঘটনায় এলজিইডির উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এ সময় মেহেরপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আজিম উদ্দিন সরদার, গাংনী উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আরিফুজ্জামান ও গাংনী উপজেলা প্রকৌশলী মাহবুবুল হক সেখানে ছিলেন। তাঁরা স্কুলভবন নির্মাণে নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রীর সঙ্গে কংক্রিট ও সিমেন্ট কম দেওয়ার বিষয়ে সত্যতা পান।
আজ দুপুরে যশোর এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শফিউল আলমের নেতৃত্বে তিন সদস্যের অপর একটি দল নির্মাণাধীন ভবন পরিদর্শন করেন। এ সময় সেখানে যশোর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী বিজন কুমার দাস ও মেহেরপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আজিম উদ্দিন সরদারও ছিলেন।
এই দলটি নির্মাণাধীন ভবনের ধসে পড়া সিঁড়িসহ ভবনটি ঘুরে দেখেন। ভবনটি পরীক্ষার পর নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে সিঁড়ি নির্মাণের বিষয়টি নিশ্চিত করেন। ধসে পড়া সিঁড়িটি পুরো ভেঙে ফেলে শিডিউল মোতাবেক উন্নতমানের নির্মাণসামগ্রী দিয়ে পুনরায় সিঁড়ি নির্মাণের নির্দেশ দেন। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ধসে পড়া সিঁড়ির কংক্রিটের নমুনাও সংগ্রহ করে নিয়ে যায় এই পর্যবেক্ষকদলটি।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, সিঁড়ি ধসে পড়ার পর থেকে ঠিকাদার পক্ষের কেউ ঘটনাস্থলে যায়নি। পর্যবেক্ষকদলটি নির্মাণাধীন ভবন দেখতে গেলে স্থানীয়রা ভবনটির ঠিকাদার জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ খালেকের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন। পুরো ভবনটি নতুন করে নির্মাণের দাবিও জানান তাঁরা। ভবন পুনরায় নির্মাণ না করলে সন্তানদের স্কুলে পাঠাবেন না বলে জানান অভিভাবকরা।
নবীনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি সুমন আলী বলেন, ‘এলজিইডির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ধসে পড়া সিঁড়ির কংক্রিটের (মসলা) নমুনা নিয়ে গেছেন। পরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে তাঁরা আমাদের জানাবেন। তবে ভবনটি শিডিউল মোতাবেক নির্মাণ করা না হলে অভিভাবকদের মধ্যে থেকে আতঙ্ক কাটছে না। এমনটি চললে তারা সন্তানদেরও স্কুলে পাঠাবেন না।’
মেহেরপুর এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আজিম উদ্দিন সরদার বলেন, ‘ভবনের ধসে পড়া সিঁড়িটি পুরো ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ তবে ভবনের অন্য অংশগুলো মানসম্মত আছে বলে দাবি করেন তিনি।
এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী আরো বলেন, ‘প্রকৌশলীকে না জানিয়ে স্কুলভবনের ঢালাই করায় ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’
স্কুলটির শিক্ষক ও স্থানীয়রা জানান, পিইডিপি-৩ প্রকল্পের আওতায় ৬৩ লাখ ৫২ হাজার ৫০০ টাকা ব্যয়ে গত বছরের মে মাসে নবীনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নির্মাণকাজ শুরু করে তামান্না এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কাজটি কিনে নেন আওয়ামী লীগ নেতা এম এ খালেক ও তাঁর ব্যবসায়িক সহযোগী মোনায়েম হোসেন মুলাক।
ভবন নির্মাণকাজের প্রথম থেকে সিমেন্ট কম দেওয়া, দুর্বল ইট ব্যবহার করাসহ নানা অনিয়ম করলেও ঠিকাদার প্রভাবশালী হওয়ায় তাঁদের বিরুদ্ধে স্থানীয়রা কথা বলার সাহস পাননি। স্থানীয় কয়েকজন শ্রমিক ও শিক্ষক এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে কয়েকজন শ্রমিককে কাজ থেকে বাদ দেওয়া হয়। এমনকি তাঁদের কয়েক দিনের পারিশ্রমিকও পরিশোধ করা হয়নি। শিক্ষকরা প্রতিবাদ করতে গেলে তাঁদের সঙ্গে ঠিকাদার পক্ষের লোকজনের হাতাহাতির ঘটনা ঘটে।
গতকাল শনিবার নির্মাণাধীন ভবনের দ্বিতীয় তলার ছাদ ঢালাইয়ের জন্য সাটারিংয়ের কাজ শেষে নামতে গিয়ে সিঁড়ি ভেঙে নিচে পড়ে যান শ্রমিক মোক্তার আলী। এতে তিনি আহত হন। অথচ গত ২২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় তলার সিঁড়ি ঢালাইয়ের কাজ করা হয়। দুই সপ্তাহের মাথায় সিঁড়ি ভেঙে পড়ার সময় বিদ্যালয়ের পুরাতন টিনশেড ভবনে ক্লাস চলছিল। সিঁড়ি ভেঙে পড়ার শব্দে স্কুলের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা আতঙ্কে এদিক-ওদিক পালাতে থাকেন।