প্রশাসনের কাছে সবার মৃত্যুর অনুমতি চেয়েছেন তোফাজ্জল!
সন্তানসহ পরিবারের সদস্যদের মৃত্যুর অনুমতি চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছেন মেহেরপুরের এক বাবা। তাঁর দুই সন্তান ও এক নাতি দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত। দেশে-বিদেশে তাদের চিকিৎসা করিয়ে বাঁচানোর কোনো পথ পাননি।
জেলা শহরের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের বেড়পাড়া গ্রামে ফল ব্যবসায়ী তোফাজ্জেলের দুই ছেলে সবুর, রায়হানুল ও মেয়ের ছেলে (নাতি) সৌরভ ডুশেন মাসকুলার ডিসট্রোফি (ডিএমডি-Duchenne Muscular Dystrophy) রোগে আক্রান্ত। এই রোগের ওষুধ আজও আবিষ্কার হয়নি বলে অনেকে দাবি করেছেন। শিশুদের চিকিৎসা করতে গিয়ে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বিক্রি করে দিয়েছেন তোফাজ্জেল।
তিলে তিলে চোখের সামনে সন্তানদের মৃত্যু দেখা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তোফাজ্জেলের। কাঁধের ওপর থেকে নিকটাত্মীরা হাত সরিয়ে নিয়েছে।
দিন যতই যাচ্ছে, ততই মৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করছে বড় সন্তানটি। একমাত্র মেয়ের সন্তানটির শরীরেও একই রোগ বাসা বেঁধেছে। তোফাজ্জেলের স্ত্রীও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী। এ অবস্থায় তোফাজ্জল চোখে অন্ধকার দেখছেন। চিকিৎসার ব্যয়ভার মেটাতে জেলা প্রশাসকের কাছে তোফাজ্জেল আবেদন করেন, ‘হয় আমার সন্তানের চিকিৎসাভার নেওয়া হোক অথবা মৃত্যুর অনুমতি দেওয়া হোক।’
আবেদনপত্র পেয়ে রোগাক্রান্ত পরিবারের কাছে গিয়ে সহযোগিতার আশ্বাস দেন দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক খায়রুল হাসান।
আবদুস সবুর চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত লেখা পড়া করেছে। সে সময় তার রোগটি শনাক্ত করা হয়। ফলে তার আর স্কুলে যাওয়া হয়নি। মেহেরপুর জেনারেল হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. মাহাবুবুল আলম রোগটি শনাক্ত করেছিলেন। ভারতের কেয়ার হাসপাতালের শিশু বিশেষজ্ঞ গৌরাঙ্গ মণ্ডল, তপন কুমার বিশ্বাস, ভারতের কোঠারি মেডিকেল সেন্টারের শিশু বিশেষজ্ঞ ড. স্বপন মুখার্জিও সবুরের মল-মূত্র, রক্ত, কফ পরীক্ষা করে নিশ্চিত হন ‘ডিএমডি’ রোগ।
তোফাজ্জেল হোসেন তাঁর সন্তানের চিকিৎসার সাহায্যে দেশের বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, দূতাবাসেও ছুটে গেছেন। ঢাকায় ফ্রান্স দূতাবাস সহযোগিতা দিতে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশ্বের চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের কাছে রোগের ওষুধ কী জানতে চেয়ে অনুরোধ করেন। এই অনুরোধের উত্তরে তোফাজ্জেল হতাশ হয়ে পড়েন। শত শত চিকিৎসক ইন্টারনেটে জানিয়েছেন, এখনো এই রোগের কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। এই রোগটি ক্যানসারের চেয়েও ভয়াবহ বলে একজন শিশু বিশেষজ্ঞ জানিয়েছেন।
আক্রান্তের শরীরে সব অংশের মাংসপেশি আস্তে আস্তে জমাট বেঁধে যাবে। চলাফেরা বন্ধের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলার শক্তিও হারিয়ে যাবে। মাংস জমাট হওয়ার কারণে এবং কোনো ওষুধ আবিষ্কার না হওয়ায় এ রোগমুক্ত করা সম্ভব নয়। চিকিৎসায় কোনো সুফল মিলবে না। বাড়বে শুধুই যন্ত্রণা। আক্রান্তের কয়েক বছরের মধ্যেই রোগী মারা যাবে।
শিশু বিশেষজ্ঞরা এও জানিয়েছেন, বাবা-মায়ের জেনেটিক ডিসঅর্ডারের (জিনগত ব্যাধি) কারণে সন্তানদের মধ্যে সাধারণত এই রোগ দেখা দেয়।
তবে তোফাজ্জেল হোসেনকে আশার বাণী শুনিয়েছেন ভারতের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব হোমিওপ্যাথি হাসপাতালের চিকিৎসকরা। তাঁরা জানিয়েছেন, দীর্ঘ মেয়াদের চিকিৎসায় এ রোগ সারিয়ে তোলা সম্ভব। যদি সেখানে ভর্তি করা যায়। একটু আশার পথ দেখলেও অর্থসংকটের কারণে সন্তানদের চিকিৎসার পথ না পেয়ে বাধ্য হয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে তোফাজ্জেলের আবেদন হয় আক্রান্ত ছেলেদের মৃত্যুর অনুমতি অথবা চিকিৎসার দায়িত্ব নেওয়া হোক।
ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক খায়রুল হাসান বলেন, ‘বিষয়টি অত্যন্ত মানবিক। আবেদনটি পড়ে চোখে পানি ধরে রাখতে পারিনি। আমরা বিভিন্নভাবে তাঁকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে চাই। আমরাও চাই তাঁর তিন শিশু বেঁচে উঠুক। সুস্থ থাকুক।’