নরসিংদীতে এক মাইক্রোবাসেই নিভে গেল ১২ জনের প্রাণ
গ্রামের ফাগুনমেলা দেখতে মাইক্রোবাসে করে ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জ যাচ্ছিলেন তাঁরা। পথে যাত্রীবাহী বাসের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে লাশ হয়ে গ্রামে ফিরতে হয়েছে তাঁদের। উৎসবের গ্রামে এখন সারি সারি লাশ।
আজ রোববার সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নরসিংদীর বেলাবো উপজেলার দড়িকান্দি এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এতে কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ছাতির চর গ্রামের তিন পরিবারের ১১ জনসহ ১২ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছে চার পথচারীসহ আরো অন্তত ১০ জন।
নিহত ব্যক্তিরা হলেন ছাতিরচর গ্রামের কালু মিয়ার ছেলে মানিক মিয়া (৫৫), তাঁর স্ত্রী মাফিয়া খাতুন (৪৫) ও ছেলে অন্তর আলম (১২); একই গ্রামের হাসান মিয়া (৪০), তাঁর স্ত্রী হালিমা খাতুন (৩০) ও ছেলে ঈশান (১০); বাচ্চু মিয়ার মেয়ে ঝুমা আক্তার (১৫), মরম আলীর মেয়ে সাধনা খাতুন ( ৪০) ও তাঁর ভাই নাজমুল হোসেন (৩০), সব্দর আলীর ছেলে হীরা মিয়া (৪৫), নূরে আলমের স্ত্রী শারমিন আক্তার (২২) ও মাইক্রোবাসের চালক আবু সাঈদ আহম্মেদ। চালক ছাড়া নিহত সবাই একই গ্রামের বাসিন্দা এবং মাইক্রোবাসের যাত্রী ছিলেন।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, ফাগুনমেলা দেখতে আজ সকালে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর থেকে পৃথক দুটি মাইক্রোবাসে কয়েকটি পরিবারের ৩২ জন সদস্য কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার ছাতিরচর গ্রামে যাচ্ছিলেন। পথে বেলাবো দড়িকান্দি বাজারে বিপরীত দিক থেকে আসা অগ্রদূত পরিবহনের একটি যাত্রীবাহী বাস অপর একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশাকে ওভারটেক করে। এ সময় মাইক্রোবাসের সঙ্গে বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। মাইক্রোবাসটি দুমড়ে মুচড়ে রাস্তার পাশে ছিটকে পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই দুই শিশু ও চার নারীসহ ১১ জন নিহত হন। এ ঘটনায় আরো অন্তত ১০ জন আহত হয়।
খবর পেয়ে পুলিশ, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য ও স্থানীয়রা আহতদের উদ্ধার করে ভৈরবসহ আশপাশের হাসপাতালে পাঠায়। গুরুতর আহত অবস্থায় মাইক্রোবাসের তিন যাত্রীকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর শারমিন আক্তার নামে আরো একজন মারা যান।
আহতদের মধ্যে তিনজন মাইক্রোবাসের যাত্রী, তিনজন বাসের আরোহী ও চারজন পথচারী। তাদের ঢাকায় ও স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
এদিকে, দুর্ঘটনার পর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে প্রায় এক ঘণ্টা যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। পরে দুর্ঘটনা কবলিত বাসটিকে সরিয়ে নিলে যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
খবর পেয়ে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. মোজ্জাম্মেল হক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে হাবিবা, বেলাবো থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বদরু আলম খান, ভৈরব হাইওয়ে পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমানসহ স্থানীয় প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
এদিকে, এক সঙ্গে একই গ্রামের এত মানুষ নিহতের খবরে ছাতিরচর গ্রামে শোকের ছায়া নেমে আসে। গ্রামজুড়ে কান্নার রোল পড়ে যায়।
স্বজনদের মরদেহ নিতে নিকলী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, স্থানীয় আওয়ামী লীগের সভাপতি ইয়ার খানের নেতৃত্বে শতাধিক গ্রামবাসী দল বেধে ভৈরব হাইওয়ে ফাঁড়িতে আসে। এ সময় নিহত ব্যক্তিদের লাশ দেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে স্বজনরা। তাদের আর্তনাদে এলাকার পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে।
বাবা, মা ও ছোট ভাইয়ের লাশ নিতে আসেন নিহত মানিক মিয়ার ছেলে নূরুন নবী। এক সঙ্গে মা-বাবা ও ভাইয়ের লাশ দেখে হতবিহ্ববল হয়ে যান তিনি। এ সময় ‘আনন্দ উল্লাস করে মেলা দেখা হলো না আমার বাবা-মার’ বলেই, তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
লাশ নিতে নূরন নবীর সঙ্গে আসেন তাঁর বন্ধু তৌহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর আমাদের গ্রামে ফাগুনের প্রথম দিন থেকেই সপ্তাহব্যাপী ফাগুনমেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলাকে ঘিরে গ্রামের সব লোকজন একত্রিত হয়। মেলায় আনন্দ উল্লাস আর ভুড়িভোজনও হয়। মেলাকে কেন্দ্র করে পুরো গ্রামে উৎসবের সৃষ্টি হয়। এই রীতি দীর্ঘদিনের। তাঁরা মেলার জন্যই ঢাকা থেকে গ্রামে আসছিলেন।’
ছাতিরচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি এয়ারখান বলেন, ‘গ্রামের ঐতিহ্যবাহী মেলায় যোগ দিতেই ঢাকায় বসবাসরত আমাদের ছাতিরচর গ্রামের প্রায় ৩২ জন লোক দুটি গাড়ি নিয়ে গ্রামে আসছিলেন। কিন্তু গ্রামে ফিরলেন লাশ হয়ে। উৎসবের গ্রামে এখন ১১টি লাশ। নিহতদের মধ্যে পোশাক কারখানার কর্মী, সবজি বিক্রেতা, রিকশাচালকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ রয়েছেন।’
ভৈরব হাইওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মিজানুর রহমান বলেন, নিহতের স্বজনদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে দুপুরে ১১জনের মরদেহ ময়নাতদন্ত ছাড়াই স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাস ও মাইক্রোবাসটিকে জব্দ করা হয়েছে। তবে বাসের চালক ও তাঁর সহকারী পালিয়েছে। এ ঘটনায় বেলাবো থানায় মামলা হয়েছে।
নরসিংদী অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোজাম্মেল হক বলেন, দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এরই মধ্যেই একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে নিহতের মরদেহ দাফনের জন্য জনপ্রতি পাঁচ হাজার টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়েছে।