স্বপ্ন ডুবছে হাওরের কৃষকদের
বছরের জমানো সব টাকা দিয়ে প্রায় আট একর জমিতে বোরো ধান লাগিয়েছিলেন মছদ্দর আলী (৭০)। সঙ্গে শ্রম দিয়েছিলেন পরিবারের সবাই। স্বপ্ন দেখেছিলেন কয়েক মাস পর নতুন ধান ঘরে তুলবেন। কিন্তু গত কয়েক দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে মছদ্দর আলীর সেই স্বপ্ন এখন ডুবছে কয়েক ফুট পানির নিচে।
মছদ্দর আলীর বাড়ি সুনামগঞ্জের হাওর এলাকা রাধানগর গ্রামে। শুধু তিনিই নন, সুনামগঞ্জের এ রকম শত শত কৃষকের স্বপ্ন এখন ডুবছে পানির নিচে।
গত কয়েক দিনের ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে সুনামগঞ্জের নদী ও হাওরের পানি বৃদ্ধি পেয়ে প্রতিদিনই নতুন নতুন হাওরের বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে। প্রথম দফা বৃষ্টির পানিতেই জেলার ১১ উপজেলার সবকটি হাওরেই পানি বিপৎসীমার কয়েক সেন্টিমিটার ওপরে অবস্থান করছে। জেলার একমাত্র বোরো ফসল কয়েক দিন ধরে পানির নিচে থাকায় হুমকিতে রয়েছে ২৪ লাখ মানুষের কয়েক লাখ হেক্টর জমির বোরো ধান। এমন পরিস্থিতিতে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাঁধ এলাকায় মাটিভর্তি বস্তা ফেলে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কৃষক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ, বাঁধ নির্মাণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে এবং সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির জন্য এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টির পানি ও পাহাড়ি ঢলে ধান ডুবে যাওয়া শঙ্কার মধ্যে রয়েছেন মছদ্দর আলী। তিনি বলেন, কোনো কিছুতেই যেন হিসাব মিলছে না। কী করবেন? কী করে সারা বছর কাটবে? কয়েক দিন ধরে মাঝেমধ্যেই জমির ধারে বসে এই কথাগুলোই ভাবছেন তিনি।
মছদ্দর আলী বলেন, ‘সব তো নিয়ে গেল। আর মাটি ফেলে কী করবে? আমরা ধানগাছ তো আর ফিরত পাব না। মাটি ফেলে আর আমাদের সঙ্গে তামাশা করার কী আছে? আমাদের এত কষ্টের ধান যাদের জন্য গেল, তাদের বিচার আল্লায় করবে।’
রাধানগর গ্রামের কমলজান (৬৫) বলেন, ‘আমার সব ধান হাওরে। আমি এখন বাচ্চ-কাচ্চা নিয়ে কী করে সংসার চালাব? কে দেবে আমার এই ক্ষতিপূরণ? আমরা তো কোনো দিশা পাচ্ছি না।’
বাহাদুরপুরের কৃষক বরুণ (৪০) বলেন, ‘এই সময়ে এসে মাটি ফেলানো আর না ফেলানো সমান কথা, যা ক্ষতি হবার তো হয়ে গেছে। এখন মাটি ফেলে কী করবে? না নদীর পানি আটকাবে, না বৃষ্টির পানি, না হাওরের ফসল বাঁচবে। এইটা এখন তামাশা ছাড়া আর কিছুই না।’
এদিকে, ফসল রক্ষায় রাত-দিন হাওরের বেড়িবাঁধে কাজ করছেন দিশেহারা কৃষক ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তারপরও শেষ রক্ষা হচ্ছে না। কয়েক দিনের বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার খরচার হাওর, জগন্নাথপুরের নলুয়ার হাওর দিরাই উপজেলার বারাম হাওর ও তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরসহ জেলার ছোট-বড় সব হাওরের বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়েছে হাওরে।
স্থানীয় পলাশ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবদুল কাইয়ূম বলেন, ‘আজকে সকালেও পানি উন্নয়ন বোর্ডের এক কর্মকর্তাকে পেয়েছিলাম। ওই সময় সব মানুষ উত্তেজিত হয়ে পড়ে। পরে আমরা অনেক চেষ্টা করে পরিস্থিতি শান্ত করেছি। এই বছরও আমাদের সোনার ফসল তলিয়ে গেছে।’
আবদুল কাইয়ূম আরো বলেন, ‘গত বছরও আমাদের ফসল শুধু পানি উন্নয়ন বোর্ডের কিছু অসৎ লোকের জন্য নষ্ট হয়ে গেছে। তবে সামনের বছর যদি এমন হয়, কাজে যদি কোনো গাফিলতি থাকে তাহলে, সে যে-ই হোক তাদের বিরুদ্ধে আমরা নিজেরাই ব্যবস্থা নেব।’
বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হারুন অর রশীদ বলেন, ‘উপজেলার সব বাঁধের কাজ করার জন্য আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বারবার তাগাদা দিচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের কথা কেউ শোনে না। কয়েক দিন থেকে হাওরে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা রাত-দিন হাওরের কাজ করছি।’
হারুন অর রশীদ আরো বলেন, ‘পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। উপজেলার অনেক জায়গা আছে, হাওরে পানি ঢোকার পরে মাটি ফেলা হচ্ছে। কারণ, লাখ লাখ মানুষ অনিশ্চয়তার মধ্যে আছি। বর্তমানে আমরা আল্লাহর দিকে চেয়ে আছি।’
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম জানান, হাওরের পানি বিপৎসীমার অনেক ওপরে অবস্থান করছে। এখন পর্যন্ত জেলার অনেক বড় হাওরের বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢুকে গেছে। এ পর্যন্ত সাত হাজার হেক্টর বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
জেলা প্রশাসক অভিযোগ করেন, পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা সঠিক সময়ে কাজ করলে এমন পরিস্থিতি হতো না। বৃষ্টিপাত যদি অব্যাহত থাকে, তাহলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হবে বলে তিনি জানান। প্রতিটি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে বলে শেখ রফিকুল ইসলাম জানান।
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘আমি নিজে প্রতিদিন হাওরগুলো পরিদর্শন করছি। সেই সঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকদেরও দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। পানি নেমে গেলে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুনামগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান নির্বাহী প্রকৌশলী আফসার উদ্দিন বলেন, কোনো হাওর-ই এখনো সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কিছু কিছু হাওরে আংশিক ক্ষতি হয়েছে। এ সময় তিনি কৃষক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের অভিযোগ অস্বীকার করেন।
আফসার উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের কাজের অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য হাওরের পানি বাড়েনি। বরং নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় হাওরের পানি বেড়েছে। আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টার ফলে পরিস্থিতি ভালো আছে।’