সুনামগঞ্জে ফসলডুবির প্রভাব পোশাকের বাজারে
আর মাত্র দুদিন। এর পরেই বাংলাদেশিরা পালন করবে সবচেয়ে বড় উৎসব বাংলা নববর্ষ। এই উৎসবকে কেন্দ্র করে লোকজন যে যার সাধ্যমতো নতুন ও বাহারি রঙের কাপড় পরে। এ জন্য বৈশাখ আসার কয়েক দিন আগে থেকেই এক দোকান থেকে আরেক দোকানে ক্রেতারা পছন্দমতো কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করেন।
অন্যান্য বছর এই সময়ে ক্রেতাদের সঙ্গে যেখানে দরদাম করে ব্যস্ত সময় পার করার কথা ছিল, এ বছর তেমনটা লক্ষ করা যাচ্ছে না, প্রায় প্রতিটি দোকানেই অনেকটা অলস সময় পার করছেন বিক্রেতারা। শহরের কোনো মার্কেটেই নেই জাঁকজমকপূর্ণ দৃষ্টিনন্দন গেট, লাইটিং কিংবা আয়োজন।
শহরের বড় বড় বিপণিবিতানে গিয়ে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর জেলার একমাত্র বোরো ফসল আগাম বৃষ্টি এবং পাউবোর দুর্বল বাঁধ ভেঙে পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় মার্কেটগুলোতে এমন অবস্থা। হাওরপারের কৃষকের একমাত্র ফসল পানির নিচে তলিয়ে গিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রভাব পড়েছে পয়লা বৈশাখের বাজারে।
সুনামগঞ্জ শহরের পৌর বিপণি মার্কেটের কাপড়ের দোকান মধ্যবিত্তের মালিক মানবেন্দ্র কর বলেন, ‘আমরা অন্যান্য বছর পহেলা বৈশাখ আসার অনেক আগে থেকেই দোকানে সাজসজ্জা করাতাম। ক্রেতাদের আকর্ষণ করানোর জন্য বিচিত্র রঙের ও বাহারি ডিজাইনের সমারোহ করতাম। কিন্তু এ বছর তেমনটা করা হয়নি। সারা জেলার ফসল যেখানে চলে গেছে, সেখানে এমনটা করা ঠিক হবে না।’
মানবেন্দ্র কর বলেন, ‘আমরা দোকানদার হলেও মানুষ, প্লাস্টিক তো আর না। সারা জেলার কৃষকেরা একমুঠো ভাতের জন্য যেখানে হাহাকার করছে, সেখানে আমরা বিকিকিনি হওয়া নিয়ে চিন্তা করছি না। উৎসব হলে সবাইকে নিয়ে, না হলে কেউই করব না। অন্য বছরগুলোতে এই সময় কেনাবেচার ধুম থাকত। এখন তেমন কিছুই নেই। তবে কিছু মানুষ তাদের শিশুসন্তানের জন্য সামান্য কেনাকাটা করছেন।’
ময়ূরী ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের মালিক ফখরুল ইসলাম মাসুম বলেন, ‘এবার বৈশাখের জন্য আমাদের দোকানে আলাদা কোনো আয়োজন নেই। যেখানে জেলার প্রায় শতভাগ ফসল চলে গেছে, সেখানে আমাদের পয়লা বৈশাখ নিয়ে আয়োজন থাকাটাও অমানবিক।’
ক্রেতারা কেনাকাটা করতে আসেন কি না জানতে চাইলে ফখরুল ইসলাম জানান, আসে তবে খুবই সামান্য সংখ্যায়।
লন্ডন প্লাজার বিশ্ব রং শো-রুমের ব্যবস্থাপক পানু দেব বলেন, ‘যদি বিকিকিনি ভালো হতো তাহলে আপনার সাথে কথা বলারও সময় হতো না। কিন্তু এ বছর তেমন কিছুই নেই। ক্রেতাশূন্যই বলা চলে।’
বিশ্ব রং-এর স্বত্বাধিকারী লিটন চৌধুরী বলেন, ‘যেহেতু এই শোরুম বাইরে। তাই রং-এর বৈশাখ উপলক্ষে বাহারি আয়োজন ছিল। কিন্তু ক্রেতা নেই, তাই আমাদের বিক্রিও নেই।’ জেলা সার্বিক পরিস্থিতির জন্যই এমন হয়েছে বলে জানান তিনি।
এদিকে দোজা প্লাজার শাওন ডিপার্টমেন্টের স্বত্বাধিকারী মহিবুর আলম শাওন বলেন, ‘আমি এক মাস আগে থেকে এবং বৃষ্টিপাত হওয়ার ১৫ দিন আগে ঢাকা থেকে বৈশাখের জন্য বিশেষ জামা-কাপড় কিনে এনেছিলাম। কিন্তু সুনামগঞ্জের বাজারের অবস্থা খুবই খারাপ। ক্রেতা নেই বললেই চলে। এমনকি নারী-শিশু কেউই কোনো কেনাকাটা করছেন না।’
‘হাওরে ফসলডুবির প্রভাব আমাদের বৈশাখের বাজারের ওপর পড়েছে। তবে আমরা কী পরিমাণ ক্ষতির সম্মুখীন হব তা বড় কথা নয়, কথা হলো জেলার বেশির ভাগ কৃষকের একমাত্র ফসল চলে গেছে। এর চেয়ে খারাপ কী হবে। এক বছর না হয়, না-ই বিক্রি করলাম। এবারেরটা অন্যবার পুষিয়ে নেব। কিন্তু কৃষকদের যে ক্ষতি হয়েছে, আল্লাহ যেন তাদের এই ক্ষতি থেকে উত্তরণের শক্তি দেন।’
শুধু যে শহরের বিপণিবিতানগুলোর এমন অবস্থা তা কিন্তু নয়। নিম্ন আয়ের মানুষের ফুটপাতের দোকানগুলোরও একই অবস্থা।
নিউ শারা ফ্যাশনের ব্যবসায়ী জোবায়ের খান বলেন, ‘আমাদের দোকানে নিম্ন আয়ের মানুষই মূল ক্রেতা। হাওরের ফসলের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বেচাকেনাও পানিতে তলিয়ে গেছে। গত বছর পয়লা বৈশাখে শুধু সাদা রঙের কাজ করা বৈশাখের গেঞ্জি তুলেছিলাম এক হাজার পিস। আর অন্যান্য কাপড়চোপড় তো ছিলই। এ বছর মাত্র ১২০ পিস গেঞ্জি তুলেছি। তার মধ্যে ৫০ পিস রয়ে গেছে। আর বাকি কাপড়চোপড় তো যা তুলেছি সবই রয়ে গেছে।’
জোবায়ের খান বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ ক্রেতা কৃষক শ্রেণির। যেহেতু কৃষকদের সারা বছরের ফসল চলে গেছে, তাই তাদের কেউ-ই কোনো কেনাকাটাই করেননি। আমরা এই বছর মালামাল কিনে ধরা খেয়েছি।’
গত ১৫ দিনের টানা ভারি বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জের ৯০ ভাগ ফসল তলিয়ে গেছে।