‘পুলিশ কোনো গোষ্ঠীকে রক্ষা করতে গল্প তৈরি করছে’
খুলনায় বিএনপি নেতা সরদার আলাউদ্দিন মিঠু হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশের বক্তব্যকে প্রত্যাখ্যান করেছেন বিএনপি নেতারা। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক ও খুলনা মহানগর বিএনপির সভাপতি নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেছেন, পুলিশ কাউকে বা কোনো গোষ্ঠীকে রক্ষা করতে এমন গল্প তৈরি করছে। খুলনায় বিএনপির মধ্যে দলের অন্য নেতাকে হত্যা করার এমন সংস্কৃতি নেই।
আজ বুধবার নগরীর কে ডি ঘোষ রোডে দলীয় কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি এস এম শফিকুল আলম মনা ও খুলনা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুজ্জামান মনি।
নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘দলের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা ও বিরোধ থাকলেও হত্যা করার সংস্কৃতি নেই।’ তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ ও নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে পুলিশের খুলনা বিভাগীয় প্রধানের বক্তব্যে রহস্য উদঘাটন হবে বলে আমার আশা করেছিলাম। কিন্তু সেখানে মিঠুর হত্যাকারীদের আড়াল করে সম্পূর্ণ দায়ভার বিএনপির ওপর চাপানো হয়েছে। মিঠুর পরিবার এরই মধ্যে এই বক্তব্য নাকচ করেছে।’
গত ২৫ মে বৃহস্পতিবার রাতে ফুলতলা উপজেলার নিজ কার্যালয়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে খুন হন খুলনা জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ফুলতলা উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান সরদার আলাউদ্দিন মিঠু ও তাঁর দেহরক্ষী নওশের গাজী।
এ নিয়ে গতকাল মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের খুলনা রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক(ডিআইজি) মো. দিদার আহমেদ দাবি করেন ওই হত্যাকাণ্ডে অন্য এক বিএনপি নেতার সংশ্লিষ্টতা আছে। তিনি দাবি করেন, মামুন রহমান নামের এক লন্ডনপ্রবাসী বিএনপি নেতা ওই হত্যাকাণ্ডের জন্য অর্থ খরচ করেন। ওই হত্যা মামলায় আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার আছেন ফুলতলা থানা বিএনপির সদস্য সচিব হাসনাত রিজভী মার্শাল। এ ছাড়া আরো তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে ডিআইজি দিদার আহমেদ জানান।
মামুন রহমান প্রসঙ্গে
নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘মামুন লন্ডনপ্রবাসী একজন ভদ্র, সজ্জন মানুষ। তিনি উচ্চশিক্ষিত একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট। তিনি মিঠুকে হত্যার জন্য ৩০ লাখ টাকা দিয়েছেন এটি অবিশ্বাস্য ও যুক্তিযুক্ত নয়। পুলিশ খুনিদের রক্ষা করতে আষাঢ়ে গল্প ফেঁদেছে। মামুন সাহেব মিডিয়াকে বলেছেন, দেশে তাঁর কোনো অ্যাকাউন্ট থেকে এত টাকা লেনদেন হয়েছে পুলিশ প্রমাণ করতে পারলে তিনি দেশে এসে আত্মসমর্পণ করবেন।’
নজরুল ইসলাম জানান, মামুন রহমান বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও ফুলতলার জামিরা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান।
সাবেক সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘খুলনা-৫ আসনটি (ফুলতলা-ডুমুরিয়া) বিগত ২০০১ সাল থেকে ২০ দলীয় জোটের শরীক জামায়াতে ইসলামী নির্বাচন করে আসছে। সেখানে বিএনপির প্রার্থী থাকে না। তা ছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি যে পর্যায়ে রয়েছে তাতে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি না, তা নিয়েই সন্দেহ আছে। সেখানে মনোনয়নের জন্য অপর নেতা মিঠুকে হত্যা করবেন-এটা রীতিমতো আষাঢ়ে গল্প।’
রিজভী মার্শালের জবানবন্দিতে ‘হতবাক’
বিএনপি নেতা হাসনাত রিজভী মার্শালের ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রসঙ্গে নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, ‘তাঁকে আইন শৃঙ্খলারক্ষা বাহিনী গ্রেপ্তারের পর তিনদিন কোনো সন্ধান মেলেনি। এরপর অজ্ঞাত স্থান থেকে বেদম মারপিটে গুরুতর আহত অবস্থায় নিয়ে এসে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেখানোতে আমরা হতবাক হয়েছি। পত্রিকার মাধ্যমে জানলাম, ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে মার্শালের কাছ থেকে স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়েছে। সেই জবানবন্দিতে প্রকৃত অর্থে কী বলা আছে তা আমরা জানি না।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘একই সময়ে কিরণ নামের এক ছাত্রদলকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছিল। সে পুলিশের কাছে আছে। তার কথা এখনো স্বীকার করেনি পুলিশ।’
ডিআইজির সংবাদ সম্মেলনে প্রদর্শিত ‘পাইপগান’-এর মতো অস্ত্রটি ওই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়নি বলে দাবি করেন নজরুল ইসলাম মঞ্জু। তিনি বলেন, ‘খুনিরা যেভাবে গুলি করেছে তা অত্যাধুনিক অস্ত্র দিয়ে করেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের মনে হয়েছে। উদ্ধারকৃত এই অস্ত্রের ব্যালাস্টিক পরীক্ষা ছাড়াই পুলিশ বলে দিল এটি হত্যায় ব্যবহার হয়েছে। এমনকি যে তিনজনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তারাও ওই হত্যায় জড়িত নয় বলে আমরা মনে করি। মিঠুর পরিবারও পুলিশের এসব দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মিঠুকে ব্রাশ ফায়ারের মতো হত্যা করা হয়েছে। অথচ পুলিশ একটি ভাঙা পাইপগান উদ্ধার করে সেটি হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত হয়েছে বলে দাবি করেছে। যা হাস্যকর।’
‘তিনটি ঘটনাই ঘটেছে আওয়ামী লীগ আমলে’
নজরুল ইসলাম মঞ্জু বলেন, আলাউদ্দিন মিঠুর বাবা সরদার আবুল কাশেম, বড় ভাই আবু সাঈদ বাদল এবং সর্বশেষ মিঠুর হত্যাকারীরা একই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। মিঠুকে একাধিকবার হত্যার উদ্দেশ্যে তারাই হামলা চালিয়েছিল। তিনটি ঘটনাই ঘটেছে আওয়ামী লীগ শাসনামলে।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ঘটনার গভীরে গিয়ে আগের তিনটি মামলার বিষয়ে তদন্ত করতে হবে। কিন্তু আশ্চর্য বিষয় হলো পুলিশ সেদিকে যাচ্ছে না।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘উপজেলা নির্বাচন নিয়ে সরকার দলীয় প্রার্থী শেখ আকরাম হোসেনের সঙ্গে মিঠুর বিরোধ ছিল। আকরাম হোসেন এখন ওই উপজেলার চেয়ারম্যান। এ ছাড়া খুলনা তথা দেশের এক সময়ের নিষিদ্ধ ঘোষিত চরমপন্থী দল পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টির বিভাগীয় প্রধান শিমুল ভূঁইয়ার ভাই শিপলু ভূঁইয়া বর্তমানে আওয়ামী লীগ নেতা ও মিঠুর ইউনিয়নের (দামোদর) চেয়ারম্যান। ওই দুই চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মিঠু হত্যা প্রচেষ্টার মামলা ছিল। পুলিশ তাদেরকে কোনো জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। তাঁদের সঙ্গে সরদার পরিবারের বিরোধ ছিল। কিন্তু পুলিশ এসব বিষয়ে তদন্ত করছে না।’
বিএনপিনেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জু আরো বলেন, ‘মিঠুর বাবা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সরদার আবুল কাশেম, তাঁর বড় ভাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরদার আবু সাইদ বাদল হত্যা এবং আলাউদ্দিন মিঠুকে হত্যা প্রচেষ্টার জন্য দায়ের করা মামলার আসামিদের পুলিশ কোনো দিন আটক বা জিজ্ঞাসাবাদ করেনি। বরং তড়িঘড়ি করে ওই হত্যাকাণ্ডে বিএনপি নেতাদের গ্রেপ্তার করে মামলার প্রকৃত খুনিদের আড়াল করা হচ্ছে এবং জনমনে বিষয়টি বিভ্রান্ত সৃষ্টি করা হচ্ছে।’
নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ফুলতলার দামোদর ইউনিয়নটি বিএনপি তথা সরদার আলাউদ্দিন মিঠুর পরিবারের ঘাঁটি। তাঁর বাবা আবুল কাশেম দীর্ঘ দিন ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁকে পরাজিত করতে না পারায় ১৯৯৮ সালের ১৮ আগস্ট সন্ত্রাসীরা তাঁকে হত্যা করে। এর পর মিঠুর বড় ভাই সরদার আবু সাইদ বাদল প্রায় ১২ বছর টানা চেয়ারম্যান ছিলেন। তাঁকেও ২০১০ সালের ১৬ আগস্ট হত্যা করা হয়। বাদল হত্যাকাণ্ডের পর বাদলের স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা চেয়ারম্যান ছিলেন। কিন্তু ২০১৬ সালের নির্বাচনে চরমপন্থী নেতা শিমুলের ছোট ভাই আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়। ওই নির্বাচনে প্রচার করতে গিয়ে দেখি এক রাতে মিঠুর ভাবীর ১৬টি নির্বাচনী ক্যাম্প ভাঙে এবং আগুন দেয় প্রতিপক্ষরা। বিষয়টি প্রশাসনকে জানিয়েও লাভ হয়নি। উল্টো সব কেন্দ্র দখল করে কারচুপির মাধ্যমে মিঠুর ভাবীকে পরাজিত করা হয়।’
সংবাদ সম্মেলনের সময় উপস্থিত ছিলেন সাহারুজ্জামান মোর্ত্তজা, আমীর এজাজ খান, সিরাজুল ইসলাম, জলিল খান কালাম, স ম আব্দুর রহমান, ফখরুল আলম, অধ্যক্ষ তারিকুল ইসলাম, মনিরুল হাসান বাপ্পী, শেখ আব্দুর রশিদ, মাহবুব কায়সার, শেখ হাফিজুর রহমান, মুজিবর রহমান, এহতেশামুল হক শাওন, শামসুজ্জামান চঞ্চল, শামীম কবীর, ইবাদুল হক রুবায়েদ, আব্দুল্লাহ হেল কাফি সখা প্রমুখ।