আঁধার সরিয়ে ‘আমার সোনার বাংলা’
রাত ১২টা এক মিনিট। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলার উত্তর গোতামারী এলাকায় জ্বললো ৬৮টি মোমবাতি। মোমের আলোয় সরে গেল আঁধার। আর তখনই কারা যেন গাইতে শুরু করলো, ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।’ আর কেউ বসে রইলো না। নারী, শিশুরাতো বটেই, ভালোবাসার আর প্রাণের এ সুরে গলা মেলালেন বৃদ্ধরাও। আমাদের জাতীয় সংগীত এত সুন্দর!
মিনিট খানেক আগেও এসব এলাকার বাসিন্দারা ছিল ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কোচবিহার জেলার শিতলকুচি থানার অধীনে। এখন ঠিকানা বাংলাদেশ।
জাতীয় সংগীতের আওয়াজ ক্রমেই বাড়ছিল। যেন তা সীমান্তের ওপাড়ে গিয়ে প্রতিবেশী দেশের মানুষ কে জানান দিচ্ছে, দেখ আমরা বাংলাদেশি তাই প্রাণভরে গাইছি, আমার সোনার বাংলা।
চলছে গান। জ্বলছে মোমের আলো। আর এ আলোই যেন সদ্য সাবেক হওয়া ভারতীয়দের ছয় দশক ধরে অন্ধকার জগৎ থেকে আলোতে ফিরিয়ে আনলো।
সেই ১৯৪৭ সাল থেকে শুরু অন্ধকার জীবনের। যার সমাপ্তি ১ আগস্ট ২০১৫-তে। মাঝখানে ৭৪-এর ইন্দ্রিরা-মুজিব চুক্তিটি প্রতিবেশি দেশটির সংসদে ঢুকতে যেন প্রায় ৪২ বছর ধরে নিভৃতে কেঁদেছে। ১৯৯২ সালে খালেদা-রাও চুক্তির ফলে তিনবিঘা-বেরুবাড়ি করিডরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায় ছিটমহল বিনিময় প্রক্রিয়া। এরপর ২০১১ সাল পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে এ সমস্যা সমাধানে তেমন কোন অগ্রগতি হয়নি। প্রায় দুই দশকের ওই সময়টাতে যখন অবরুদ্ধ মানুষগুলোর কষ্ট একপ্রকার চাপা পড়ে যাচ্ছিল ঠিক তখন থেকেই যেন কাঁটাতারের দুই পাড় থেকে নিজেদের লাঞ্চনা-বঞ্চনার কথা ভারত-বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকসহ বিশ্ব বিবেকের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। শুধু সেটাই নয়। একসময় তাঁরা শুরু করেন রক্তপাতহীন লড়াই। আর এই লড়াইয়ের মাধ্যমে বিজয়ের পথে একেকটি ধাপ পেরোতে থাকেন ‘রাষ্ট্রহীন’ সেসব মানুষ। যার চুড়ান্ত বিজয় হচ্ছে ছিটমহল বিনিময়। আর তাঁদের এই ‘যুদ্ধের’ নেতৃত্ব দেয় একটি ভারতীয় পরিবার, গঠন করে ‘ভারত-বাংলাদেশ ছিটমহল বিনিময় সমন্বয় কমিটি(বিবিইইসিসি)’। ওই পরিবারটির সাথে জড়িয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস। আছে বিট্রিশবিরোধী আন্দোলন থেকে রাজতন্ত্র অবসানেরও ইতিহাস। উভয় দেশের ছিটমহলবাসীরাই মনে করেন ওই পরিবার এবং তাঁদের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা আন্দোলনটা ভারতে শুরু না হলে ‘কখনওই শেষ হতো না ছিটমহল সমস্যার’। তাঁদের আন্দোলন দুই দেশের বিভিন্ন সরকারের ভুমিকার পরই বিশ্ব গতরাতে দেখলো একটি ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
ছিটমহলের ৭০ বছর বয়সী বৃদ্ধ ছকবর আলীর হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়ে ছিটমহলবাসীদের বাংলাদেশি হিসেবে বরণ করে নেন হাতীবান্ধা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত হোসেন বাচ্চু, কালীগঞ্জ অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক খুরশীদুজ্জামান আহমেদ ও লালমনিরহাটের সংবাদকর্মীদের সংগঠন প্রেসফোরের সদস্য সচিব মিজানুর রহমান দুলাল। এরপর উপস্থিত সকলকে মিষ্টিমুখ করানো হয়।
উত্তর গোতামারী ছিটমহলের মধ্যরাতের এ আয়োজনটি করে প্রেসফোর ও কালীগঞ্জের অন্বেষা সাংস্কৃতিক গোষ্ঠি। এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন হাতীবান্ধার টংভাঙ্গা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সেলিম হোসেন, হাতীবান্ধা প্রেসক্লাবের সভাপতি ইলিয়াস বসুনীয়া পবন, সাধারণ সম্পাদক নুরুল হক, কালীগঞ্জ কেইউপি ডিগ্রী কলেজের সহকারী অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সংস্কৃতিকর্মী নিরঞ্জন রায়, যৌথ জরিপে অংশ নেওয়া রোকনুজ্জামান সোহেল ও আনোয়ার হোসেন এবং প্রেসফোরের আহবায়ক হায়দার আলী বাবু। পরে রাত ব্যাপি উত্তর গোতামারী ছিটমহলে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।