এমপির বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ স্কুলশিক্ষকের
ময়মনসিংহের গৌরীপুরে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মজিবুর রহমান ফকিরের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী বরাবর নালিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া গৌরীপুর থানায় সংসদ সদস্যের কয়েকজন সমর্থককে আসামি করে একটি মামলাও করেছেন গৌরীপুরের স্কুলশিক্ষক এ কে এম মাজহারুল আনোয়ার ফেরদৌস। তিনি মজিবুর রহমান ফকিরের বিরুদ্ধে সবজি দোকান থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী-চিকিৎসক-শিক্ষক সবার কাছ থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগ করেছেন। এ ছাড়া কলতাপাড়ায় ‘সেবালয়’ নামক জায়গায় নিয়ে বাথরুমে আটকে রেখে নির্যাতন, মোটা অঙ্কের চাঁদা দাবি করে মোবাইল ফোন ও মোটরসাইকেল রেখে দেওয়ার অভিযোগ করা হয়েছে সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে। গত ৩ আগস্ট উল্লিখিত এসব অভিযোগ লিখিত আকারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরাবর পাঠিয়েছেন মাজহারুল আনোয়ার।
লিখিত অভিযোগ থেকে জানা যায়, উপজেলার ধুরুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এ কে এম মাজহারুল আনোয়ার ফেরদৌস গত ৩১ মার্চে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সুপারিশে শূন্য পদে বদলি হয়ে আসেন গৌরীপুর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। একই স্কুলে শিক্ষকতা করেন তাঁর স্ত্রী রোজী সুলতানা। চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে তাঁদের ছেলে মুতাসিম মাহির রাফিদ। সংসদ সদস্যের বিরোধিতার মুখে আজ পর্যন্ত তিনি নতুন কর্মস্থলে যোগদান করতে পারেননি। একই কারণে ছেলে রাফিদকে টিসি দিয়ে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এর পর থেকে মজিবুর রহমান ফকিরের অলিখিত নিষেধাজ্ঞার কারণে রাফিদকে গৌরীপুরের বিদ্যালয়েই ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। এর পর পৌরসভার সূর্যবালা পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করতে গেলে প্রধান শিক্ষক আমজাদ হোসেন ও শেখ লেবু পৌর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আম্বিয়া আকতারও অপারগতা প্রকাশ করেন। ফলে রাফিদকে এখনো কোনো স্কুলে ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। সে দ্বিতীয় সাময়িক পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেনি।
মাজহারুল আনোয়ার জানান, গত ১৬ এপ্রিল স্থানীয় সংসদ সদস্যের এপিএস শাহাবুল আলম শিক্ষক সমিতির অফিসের চাবি চাইলে তিনি দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এতে ক্ষিপ্ত হন এমপির অনুগতরা। এর পর তাঁর ছেলেকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়া হয়। গত ৫ জুন শ্যামগঞ্জে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহাম্মদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করে ফেরার পথে উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন, লিটন, মনিরুজ্জামান বিপ্লব, পৌর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেনসহ ১০/১২ জন তাঁর গতিরোধ করেন। গৌরীপুর উপজেলার শ্যামগঞ্জ বাজারে গৌরীপুর-শ্যামগঞ্জ সড়কে তাঁর ওপর হামলা চালিয়ে রক্তাক্ত জখম করে। এ সময় তাঁর দুটি মোবাইল, মোটরসাইকেলসহ নগদ পাঁচ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় তারা।
আনোয়ার জানান, একপর্যায়ে তাঁকে মোটরবাইকে উঠিয়ে সেখান থেকে কলতাপাড়ায় এমপির ‘সেবালয়ে’ নিয়ে তিন ঘণ্টা বাথরুমে আটকে রাখা হয়। এর পর শিক্ষক সমিতির অফিসে নিয়ে এমপি নিজেও তাঁকে মারধর করেন। এ সময় তাঁর কাছে দুটি এসি দাবি করা হয়। এসি প্রদানের প্রতিশ্রুত দিয়ে তিনি রক্ষা পান। গত ৭ জুলাই ময়মনসিংহের জুবলীঘাট ওয়ালটন শোরুম থেকে ৬৬ হাজার ৫০০ টাকায় দুটি এসি কিনে দিতে বাধ্য হন তিনি। এমপির লোকজন এসি দুটি শিক্ষক সমিতির কার্যালয়ে লাগিয়ে তাদের ব্যক্তিগত কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করছে এবং তাঁকে সমিতির কার্যালয় থেকে বের করে দিয়েছে।
এ বিষয়ে গৌরীপুর উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি হেলাল উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা তিনি সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলতে বলেন। পরে সাধারণ সম্পাদক বিধুভূষণ দাসের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি অ্যাডভোকেট নাজিম উদ্দিন আহাম্মদ বলেন, ‘একজন জনপ্রতিনিধি এসব ব্যাপারে নিয়মনীতি অনুসরণ করে কার্যকর পদক্ষেপ নেবেন বলে জনগণ আশা করে। উনি তো স্বেচ্ছাচারিতামূলক আচরণ করছেন। জনগণ একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে তাঁর কাছে এ ধরনের কাজ আশা করে না।’
জেলা আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক হোসাইন জাহাঙ্গীর বাবু বলেন, ‘কী বলব, ওই শিক্ষক তো প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন, পত্রিকা দেখে জানতে পারলাম। একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবে এ ধরনের কাজ ন্যক্কারজনক। আমি এ ধরনের কাজ থেকে উনাকে বিরত থাকার আহ্বান জানাই, নিন্দা জানাই।’
গৌরীপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আলী শেখ বলেন, ‘মামলার পর আমরা দুই আসামিকে গ্রেপ্তার করেছি। আসামিদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছি মোটরসাইকেল। বাকিদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।’
শেখ লেবু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা আম্বিয়া আকতার বলেন, ‘আনোয়ার সাহেব তাঁর ছেলেকে ভর্তির জন্য আমার কাছে এসেছিলেন। আমি বলেছি, পরে জানাব। আমি আর কিছু বলতে চাই না।’ এর পর তিনি ফোন কেটে দেন।
স্কুলশিক্ষককে মারধর ও তাঁর ছেলেকে স্কুল থেকে বের করে দেওয়ার বিষয়ে গৌরীপুর সহকারী থানা শিক্ষা অফিসার জহির উদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষককে মারধরের ও তাঁর ছেলেকে ভর্তি নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা তাঁকে কেউ জানায়নি। তিনি জানেন না।’
এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক ফেরদৌস আলম এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘একজন শিশু শিক্ষার্থীকে কারণ ছাড়া টিসি দিয়ে বের করে দেওয়া, অন্য স্কুলে ভর্তি হতে না দেওয়া শিশু নির্যাতনের শামিল। এর ফলে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এর বিচার হওয়া উচিত।’ তিনি অভিযোগ করেন, শুধু শিক্ষক ফেরদৌস নন, এর আগে ডৌহাখোলা গ্রামের হাই স্কুল শিক্ষক মোজাম্মেল হোসেনসহ বেশ কয়েকজন এমপির হয়রানি ও নির্যাতনের শিকার হন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মুস্তাকিম বিল্লাহ ফারুকী এনটিভি অনলাইনকে অভিযোগ পাওয়ার বিষয়টি কথা স্বীকার করে বলেন, ‘এরই মধ্যে মামলা হয়েছে। দুজন আসামিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। বিষয়টি অন্যভাবে দেখা হচ্ছে, দেখছি।’