কেন্দ্রদখল, সংঘর্ষের পর দুই প্রার্থীর নির্বাচন প্রত্যাখ্যান
সুনামগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে ভোট কারচুপি, কেন্দ্রদখল ও এজেন্টদের কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ এনে দুই প্রার্থী নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন। এঁরা হলেন বিএনপিদলীয় মেয়র প্রার্থী দেওয়ান সাজাউর রাজা সুমন ও স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়ান গনিউল সালাদিন।
গনিউল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পুনরায় নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। আর সুমনের পক্ষে জেলা বিএনপিও পুনরায় নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।
আজ বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় সংবাদ সম্মেলন করে গনিউল সালাদিন বলেন, ‘সকাল ১০টার পর থেকেই বিভিন্ন কেন্দ্রের ব্যালট পেপার ছিনতাই, কেন্দ্রদখল ও নির্বাচনী প্রশাসনকে জিম্মি করে জাল ভোট প্রদান শুরু হয়। এ অবস্থায় পৌরসভার ভোটার ও জনগণের জানমালের নিরাপত্তার স্বার্থে আমি নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি দুঃখের সাথে জানাচ্ছি, প্রশাসনকে জানানোর পরও তারা কোনো কেন্দ্রেই কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি।’
বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পুরাতন বাসস্ট্যান্ড এলাকায় বিএনপির কার্যালয়ে সংবাদ করে নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেয় জেলা বিএনপি। এ সময় উপস্থিত ছিলেন জেলা বিএনপির সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য কলিম উদ্দিন আহমেদ মিলন, বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপদেষ্টা ও সাবেক হুইপ অ্যাডভোকেট ফজলুল হক আছপিয়া, জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নুরু, জেলা বিএনপির সাবেক সহসভাপতি নাদের আহমেদ, জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল প্রমুখ।
যোগাযোগ করা হলে বিএনপিদলীয় মেয়র পদপ্রার্থী দেওয়ান সাজাউর রাজা সুমন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, নির্বাচন বর্জনে দলের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তিনি একমত। তিনি সকাল থেকে বিভিন্ন ভোটকেন্দ্র ঘুরে দেখেছেন, আওয়ামী লীগের প্রার্থীর লোকজন ভোট ছিনতাই করেছে, জাল ভোট দিয়েছে।
স্বতন্ত্র মেয়র পদপ্রার্থী দেওয়ান গনিউল সালাদিন বলেন, দুপুর ২টায় পৌরসভার উত্তর আরপিননগর পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগদলীয় প্রার্থীর সমর্থকরা কেন্দ্র দখল করতে আসেন। তখন তাঁর লোকজন বাধা দিলে দুইপক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।
এ সময় পুরো এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এতে পুলিশ ও দুই প্রার্থীর সমর্থকদের ঘণ্টাব্যাপী ত্রিমুখী সংঘর্ষ চলে। সংঘর্ষে পুলিশসহ উভয়পক্ষের ২০ জন আহত হয়েছেন। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কয়েকটি কাঁদানে গ্যাসের শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে।
আজ সকাল ৮টায় ভোট শুরুর পর সাড়ে ১০টার দিকে উত্তর আরপিননগর পৌর প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্র থেকে ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটে।
ভোটকেন্দ্রের প্রিসাইডিং অফিসার মো. শফিকুল ইসলাম খন্দকার ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ‘কে বা কারা এসে ৪০ পৃষ্ঠার একটি ব্যালট বই ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। বইটি উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।’
তবে স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী দেওয়ান গনিউল সালাদিন অভিযোগ করে বলেছেন, ‘৪০ পৃষ্ঠার নয়, ১০০ পৃষ্ঠার পুরো বইটি ছিনতাই হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী নাদের বখতের তিনজন সমর্থক এসে বই ছিনতাই করে নিয়ে গেছেন।’
সরকার সমর্থকরা কেন্দ্র দখলের চেষ্টা করছেন এবং ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখাচ্ছেন বলেও অভিযোগ করেন এই প্রার্থী। তিনি আরো অভিযোগ করেন, পৌরসভার ২৩টি ভোটকেন্দ্রর মধ্যে বেশিরভাগ ভোটকেন্দ্র সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকরা প্রভাব খাটিয়ে তাঁর ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেননি।
এ ছাড়া দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে শহরের আরপিননগর কে বি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভোটকেন্দ্রে ব্যালট পেপার না থাকায় ভোট স্থগিত করতে বাধ্য হন নির্বাচন কর্মকর্তারা। এর আগে জাল ভোট দেওয়া নিয়ে বিএনপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশ ও নির্বাচন কমিশনের কর্মকর্তাদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডার ঘট্না ঘটে। ফলে ওই কেন্দ্রে উত্তেজনা দেখা দেয়।
এ ব্যাপারে পৌরসভা উপনির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল মোতালেবকে জিজ্ঞাসা করা হলেও তিনি এনটিভির ক্যামেরার সামনে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। ভোটকেন্দ্র কেন স্থগিত করা হয়েছে, তারও কোনো উত্তর দেননি।
আরপিননগর কে বি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা ইনসান মিয়া এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘ব্যালট পেপার না থাকার বিষয়টি আমরা রিটার্নিং কর্মকর্তাকে জানিয়েছি। তিনি ভোট স্থগিতের নির্দেশ দিয়েছেন। এ ব্যাপারে আর কিছু জানি না।’
পৌরসভার বাসিন্দা ও সাংবাদিক দেওয়ান গিয়াস চৌধুরী তাঁর নিজ কেন্দ্র আরপিননগর কে বি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভোট দিতে গিয়ে দেখেন, তাঁর ভোট আগেই কে দিয়ে দিয়েছে। তিনি বিষয়টি নিয়ে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে অভিযোগ করলেও এর কোনো সমাধান মেলেনি। তিনি ভোট না দিয়ে ফিরে আসেন।
এরপর সেখানে ভোট দিতে যান বিএনপির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল ইসলাম নুরু ও ধানের শীষ প্রতীকের তাঁর সমর্থকরা। তাঁরাও গিয়ে দেখেন, তাঁদের ভোট আগেই দেওয়া হয়ে গেছে। পরে তাঁরা প্রিসাইডিং কর্মকর্তার কাছে অভিযোগ দেন।
এ ব্যাপারে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম নুরু এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘আমি ও আমার সমর্থকরা ভোট দিতে গিয়ে দেখি, ভোট কে বা কারা আগেই দিয়ে দিয়েছেন। এটা স্পষ্টতই সরকারি দল আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর সমর্থকদের কাজ। তাঁরা সকাল থেকে কেন্দ্রে জাল ভোট দেওয়া, ব্যালট ছিনতাই, ভোটারদের ভয়-ভীতি দেখাচ্ছে। ভোটের নামে এসব হচ্ছে।’
সকাল ৮টা থেকে ভোট শুরু হলেও বৈরী আবহাওয়া থাকায় সকালে ভোটারের উপস্থিতি কম ছিল। তবে বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়ে।
সুনামগঞ্জ পৌরসভার উপনির্বাচনে মোট ভোটারের সংখ্যা ৪২ হাজার ৩২২ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ২১ হাজার ১৪৯ জন এবং নারী ভোটার ২১ হাজার ১৭৩ জন।
উপনির্বাচনে তিনজন মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। আওয়ামী লীগ থেকে নাদের বখত, বিএনপির দেওয়ান সাজাউর রাজা সুমন এবং স্বতন্ত্র প্রাথী হিসেবে দেওয়ান গনিউল সালাদিন লড়াই করেন।
সুষ্ঠুভাবে ভোট গ্রহণের জন্য ১১ জন নির্বাহী হাকিম, দুই প্লাটুন বিজিবি, র্যাবের তিনটি টিমসহ পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সদস্য দিয়ে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয় বলে জানিয়েছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা আবদুল মোতালেব।
গত ১ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আয়ুব বখত জগলুল হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়ায় এই উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে।
আজ সারা দেশে একযোগে ১৩১টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) ও নয়টি পৌরসভাসহ চট্টগ্রাম ও খুলনা সিটি করপোরেশনের দুটি ওয়ার্ড ও একটি উপজেলায় ভোটগ্রহণ হয়।