বিশ্বে সবচেয়ে কম বিচারক বাংলাদেশে : প্রধান বিচারপতি
প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘জনসংখ্যার তুলনায় পৃথিবীর সবচেয়ে কম বিচারক বাংলাদেশে। অথচ বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি মামলা রয়েছে।’
গতকাল সোমবার রাতে সাতক্ষীরা সার্কিট হাউসে অনুষ্ঠিত বিচার বিভাগীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তৃতাকালে এ তথ্য জানান প্রধান বিচারপতি।
প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বাংলাদেশে বর্তমানে ৩০ থেকে ৩১ লাখ মামলা যানজটের মতো পড়ে আছে, অনেক মামলা ডেডলক হয়ে পড়েছে। এসব মামলা নিষ্পত্তির প্রক্রিয়া বর্তমানে যেভাবে চলছে, তাতে এর একাংশের কাজ শেষ করতেই আরো দুই-তিন বছর লাগবে। তার পরও বিচারকরা আইনজীবী, পুলিশসহ অন্যদের সহায়তা নিয়ে মামলা নিষ্পত্তির কাজ করে যাচ্ছেন।’
বাংলাদেশ ফৌজদারি আইন-১৮৬০-এর উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘ঔপনিবেশিক আমলের আইন দিয়ে বর্তমান সময়ের কল্যাণ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।’
এ প্রসঙ্গে আইন কমিশনের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘অচিরেই আইন সংস্কারের বিষয়টি নিষ্পত্তি হতে পারে। বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের একটি কমিটি তৈরি করা হয়েছে। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা যাবে।’
ফৌজদারি মামলা প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘একটি কল্যাণকর রাষ্ট্র হতে হলে বিদেশে যেমন ফরেনসিক ইউনিভার্সিটি করা হয়েছে, তেমনি বাংলাদেশের সিআইডিকে একটি ল্যাবরেটরি করে দেওয়া প্রয়োজন। তাহলে তারা তাড়াতাড়ি ফরেনসিক রিপোর্ট দিতে পারবেন।’
এ বিষয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে আলোচনা করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
এ ছাড়া প্রশাসনিক কারণে মামলার জট বেড়ে যাচ্ছে—এমন মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষকদের এমপিওভুক্তির দুই-এক মাস পর তা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এসব প্রতিষ্ঠানে ম্যানেজিং কমিটি তৈরি করা নিয়ে সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে। সেখানে নানা কারণে নির্বাচন হচ্ছে না। বারবার অ্যাডহক কমিটি তৈরি করা হচ্ছে। এতে প্রায়ই মামলা বাড়ছে।’ এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসককে এমপিওভুক্তি এবং প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি গঠনের ওপর নজরদারি বাড়ানোর আহ্বান জানান তিনি।
এ সময় আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সবার সহযোগিতা প্রয়োজন উল্লেখ করে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব কেবল বিচার বিভাগের ওপর বর্তায় না। এই দায়িত্ব প্রত্যেক নাগরিকের। এ জন্য দরকার আইনজীবীর প্রতি যথাযথ নির্দেশনা এবং তাঁদের সচেতনতা। এর পাশাপাশি পুলিশের সহযোগিতাও প্রয়োজন।’ তিনি বলেন, ‘বিচারপ্রার্থী সব সময় একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিচার প্রত্যাশা করে থাকেন। এই প্রত্যাশা পূরণ না হলে তখন দায়দায়িত্ব বিচার বিভাগের ওপর পড়ে।’
এ ক্ষেত্রে বিচারকদের ভূমিকার কথা উল্লেখ করে সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেন, ‘জেলার আইন অভিভাবক জজ যদি নিজের সময় মেনে চলেন, তাহলে অন্য সবাই তাঁকে অনুসরণ করবেন। নির্ধারিত সময়ে আদালতে ওঠা এবং নির্ধারিত সময়ে আদালত থেকে নামা এমন নিয়ম চালু করলে বিচারকাজ নিষ্পন্ন করা সহজতর হয়ে ওঠে।’
পুলিশের দায়ের করা মামলার প্রসঙ্গ টেনে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘পুলিশ যখন মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করে, তখন সচরাচর তাতে লেখা থাকে—আমি ঘটনাস্থল পরিদর্শন করলাম, আলামত গ্রহণ করলাম। পর্যালোচনা করে চার্জশিট প্রদান করলাম। অথচ এফআইআরে আসামির নাম থাকে না। এতে আইনজীবীরা সমস্যায় পড়েন।’
তাই অভিযোগপত্র দাখিলের সময় তদন্তকারী কর্মকর্তা কী কী প্রমাণ বা আলামত পেয়েছেন, তা সুনির্দিষ্ট করে উল্লেখ করার কথা বলেন বিচারপতি।
জেলা ও দায়রা জজ জোয়ার্দার আমিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিচার বিভাগের এ সম্মেলনে আরো বক্তব্য রাখেন গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ফ্রান্সিস ডি কস্টা, সিভিল সার্জন ডা. সালেহ আহমেদ, সরকারি কৌঁসুলি অ্যাডভোকেট গাজী লুৎফর রহমান, পাবলিক প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট ওসমান গণি ও জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন।
সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন হাইকোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন, স্পেশাল অফিসার হোসনেয়ারা আখতার, অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার সাব্বির ফয়েজ, ডেপুটি রেজিস্ট্রার ডা. কামাল হোসেন শিকদার ও ডেপুটি রেজিস্ট্রার ফারজানা ইয়াসমিন।