বিপ্লবী মির্জা মোরাদুজ্জামানের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ
বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য, সিরাজগঞ্জ-২ সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি মির্জা মোরাদুজ্জামানের ২১তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ সোমবার ১৮ জুলাই।
এ উপলক্ষে মরহুম মির্জা মোরাদুজ্জামান স্মৃতি সংসদ সিরাজগঞ্জ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সোমবার সকাল ৮টায় মালশাপাড়া কবরস্থানে পবিত্র কোরআনখানি, মরহুমের কবর জিয়ারত ও বাদ আসর মরহুমের ধানবান্ধির বাসভবনে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে মরহুমের আত্ময়ীস্বজন, শুভাকাঙ্ক্ষীদের উপস্থিত থাকার জন্য মিসেস মোরাদুজ্জামান ও মরহুমের জ্যেষ্ঠ ছেলে মির্জা মোস্তফা জামান আহ্বান জানিয়েছেন।
সিরাজগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক মির্জা মোরাদুজ্জামান বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের মধ্যদিয়ে রাজনীতিতে প্রবেশ করেন। তৎকালীন ছাত্র ফেডারেশন, ছাত্র ইউনিয়ন থেকে ১৯৫৭ সালে মাওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিতে যোগ দেন। সিরাজগঞ্জ মহকুমা ন্যাপের সম্পাদকের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিড়ি-শ্রমিকদের সংগঠন ও রিকশা-টমটম গাড়ি শ্রমিকদের সংগঠিত করে দুটি সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানি সামরিক শাসক আইয়ুব খানের আমলে বিড়ি শ্রমিকদের সংগঠিত করে তাদের বাঁচার দাবি পাট-সমৃদ্ধ সিরাজগঞ্জে জুটমিল প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন শুরু করেন। আন্দোলনের তীব্রতা দেখে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল আজম খান সিরাজগঞ্জে আসেন এবং নেতাদের সাথে আলোচনার পর জুট মিল প্রতিষ্ঠা করেন। এতে সিরাজগঞ্জের বহু দরিদ্র বিড়ি শ্রমিক ওই মিলে চাকরি পান।
১৯৬৩ সালে কওমি জুট মিল শ্রমিকদের সংগঠিত করে কওমি মজদুর ইউনিয়নও গঠন করেন। ১৯৬৪ সালে কওমি শ্রমিক নেতারা কারাগারে গেলে মির্জা মোরাদুজ্জামান ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বগ্রহণ করেন। এভাবেই তিনি সিরাজগঞ্জের খেটে খাওয়া মেহনতি মানুষের নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পান। এ সময় সম্মিলিত বিরোধীদলের প্রার্থী হিসেবে সিরাজগঞ্জ পৌরসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে আইয়ুব খান এবং পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানবিরোধী শ্রমিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে মির্জা মোরাদুজ্জামানসহ ১৭ জন নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হন। দীর্ঘ ১১ মাস কারাভোগ করে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি আবারও রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
মির্জা মোরাদুজ্জামান বাঙালির অকুতোভয় জাতীয় নেতা মওলানা ভাসানীর রাজনীতিকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে তাঁর আদর্শের অনুসারী হিসেবে কাজ শুরু করেন। পরে তিনি মওলানা ভাসানী প্রতিষ্ঠিত ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) সিরাজগঞ্জ মহুকুমা শাখার সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালো রাতে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী নিরীহ বাঙালিদের ওপর নির্মম হত্যাযজ্ঞে মেতে ওঠে। পাকিস্তানি বর্বরতার বিরুদ্ধে মির্জা মোরাদুজ্জামান মওলানা ভাসানীর সঙ্গে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বহির্বিশ্বে স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টির জন্য ভারতে চলে যান। ১৯৭৬ সালে মওলানা ভাসানীর মৃত্যুর পর এবং রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বিএনপি গঠনের উদ্যোগ নিলে মির্জা মোরাদুজ্জামান বিএনপি গঠনে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে পড়েন এবং বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন জাতীয় নির্বাহী আহ্বায়ক কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি সিরাজগঞ্জ মহুকুমা বিএনপির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে সিরাজগঞ্জ জেলা ঘোষণা করা হলে তিনি সিরাজগঞ্জ জেলা বিএনপির সভাপতি পদে দায়িত্ব পালন করেন।
মির্জা মোরাদুজ্জামান ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি মনোনীত প্রার্থী হিসেবে সিরাজগঞ্জ-২ সদর আসন থেকে বিপুল ভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। পরে তিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প বিষয়ক সম্পাদক, আন্তর্জাতিক তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সংসদ সদস্য থাকাকালে মির্জা মোরাদুজ্জামান মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট্রি বোর্ডের সদস্য, শ্রম ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের পরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
জনপ্রতিনিধি হিসেবে মির্জা মেরাদুজ্জামান অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের চাইতে আলাদা বৈশিষ্ট্যমন্ডিত ছিলেন। তিনি সৎ, দায়িত্ববান এবং নির্ভরযোগ্য ব্যক্তি আর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতায় বিশ্বাসী ছিলেন। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষসহ আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা তাঁর কাছে অবাধে যেতেন এবং তাদের মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা, সমস্যার কথা অকপটে বলতেন। যে কারণে তিনি সিরাজগঞ্জের দলমত নির্বিশেষে সবার প্রিয় ‘মুরাদ ভাই’ হিসেবে পরিচিত পেয়েছিলেন।
মির্জা মোরাদুজ্জামান তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সহযোগিতায় সিরাজগঞ্জ সরকারি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে রূপান্তর, অনার্স-মাস্টার্স কোর্স চালু, বাণিজ্য ভবন, ছাত্রছাত্রীদের জন্য হোস্টেল নির্মাণ, ভাসানী ডিগ্রি কলেজ, যমুনা ডিগ্রি কলেজ, শিমলা ডিগ্রি কলেজ, বাগবাটি ডিগ্রি কলেজ এমপিওভুক্ত করেন, শহীদ শামসুদ্দিন স্টেডিয়াম, সদর হাসপাতাল আধুনিকীকরণ, নার্সিং ট্রেনিং ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা, সিরাজগঞ্জ বার ভবন ও বহুমুখী সেতু নির্মাণে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তাঁর আমলে নির্মিত স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, কবরস্থান, মন্দির, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মরহুম মির্জা মোরাদুজ্জামানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তাঁর সম্মানে সিরাজগঞ্জ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাণিজ্য ভবনকে মির্জা মেরাদুজ্জামান ভবন, সিরাজগঞ্জ সদর হাসপাতালে সম্প্রসারিত ভবনকে মির্জা মোরাদুজ্জামান ভবন, সিরাজগঞ্জ আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালকে মির্জা মোরাদুজ্জামান বাস টার্মিনাল, সিরাজগঞ্জ পৌরসভা ও ইউনিয়নের দুটি রাস্তা ‘মির্জা মোরাদুজ্জামান সড়ক’ হিসেবে নামকরণ করা হয়।
সিরাজগঞ্জের সর্বজন শ্রদ্ধেয় নেতা মির্জা মোরাদুজ্জামান মরণব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯৯৫ সালের ১৮ জুলাই ভোরে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন।