বিপ্লবী রেবতী মোহন বর্মণের আজ ৬৩তম মৃত্যুবার্ষিকী
শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার আজীবন বিপ্লবী রেবতী মোহন বর্মণের আজ বুধবার ৬৩তম মৃত্যুবার্ষিকী। ভৈরবে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। জাগরণী সংঘ নামে একটি স্থানীয় সংগঠন আজ বিকেলে শিমুলকান্দি হাই স্কুল মাঠে আলোচনা সভার আয়োজন করেছে।
১৯৫২ সালের ৬ মে মৃত্যুর পর থেকে তাঁর জন্ম-মৃত্যু, জীবনবোধ ও জীবনচর্চার কালোত্তীর্ণ ইতিহাস জানত না নতুন প্রজন্মের অনেকেই। সম্প্রতি তাঁর বইয়ের নতুন নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে। তাঁর কর্ম নিয়ে গবেষণা শুরু হয়েছে; শুধু বাংলাদেশে নয়, ভারতেও। সে ধারাবাহিকতায় তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্রতম ও নানা সংকটে জর্জরিত বাংলাদেশে বিজ্ঞানমনস্ক, সাম্প্রদায়িকতা ও কুসংস্কারমুক্ত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয়ে তাঁর কর্মকে নতুন করে আবিষ্কারের তাগিদ অনুভব করছেন আজ অনেক রাজনীতিবিদ, গবেষক। এমনটি ধারণা সাবেক এমপি, লেখক, গবেষক মো. শফিকুল ইসলামের।
‘শ্রেণিসংগ্রামের তত্ত্বই সমাজ বিবর্তনের সূত্র’—এ সূত্রে বিশ্বাসী মার্ক্সীয় তাত্ত্বিক পুরুষ রেবতী ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সেই ঐতিহাসিক ক্ষণে ভৈরব উপজেলার শিমুলকান্দি গ্রামে বর্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা হরনাথ বর্মণ ছিলেন একজন প্রথিতযশা আইনজীবী। তিনি ‘রায়’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে চতুর্থ রেবতী মোহন বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সরাইল উপজেলার চুন্টা গ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন। ছাত্রাবস্থায় ইংরেজদের বিরুদ্ধে অসহযোগ ও স্বদেশী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ায় হুলিয়া জারির কারণে বিভিন্ন স্কুল পরিবর্তনের পর ১৯২২ সালে কিশোরগঞ্জের আজিমুদ্দিন হাই স্কুলের ছাত্র হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। একই বছর কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়ে ১৯২৮ সালে কৃতিত্বের সঙ্গে এমএ পাস করেন। এর পর তিনি ‘রেণু’ নামক একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনার দায়িত্ব নেন।
বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ মহারাজের জীবনাদর্শে প্রভাবিত রেবতী বর্মণের রাজনীতি শুরু স্কুলজীবন থেকেই। তিনি মার্ক্সীয়তত্ত্বে আকৃষ্ট হয়ে ঢাকার শ্রীসংঘের সদস্য হিসেবে কলকাতা, বাকুড়া ও বীরভূমের বিভিন্ন অঞ্চলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যান। ১৯৩০ সালে রাজপুতনায় ব্রিটিশ সরকার তাঁকে গ্রেপ্তার করে। ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত তিনি কারাবন্দী ছিলেন। জেলে থাকাকালীন তিনি সমাজ বিবর্তনমূলক অসংখ্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি রচনা করেন। সেসব পাণ্ডুলিপি থেকে পরে ১৭টি বই আকারে প্রকাশ করা হয়, যা বর্তমানে অত্যন্ত মূল্যবান গ্রন্থ হিসেবে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়ে সারা বিশ্বে পঠিত হচ্ছে।
জেলে থাকাকালে ব্রিটিশ সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে এই বিপ্লবী নেতার দেহে কুষ্ঠের জীবাণুর অনুপ্রবেশ ঘটালে তিনি ঘাতকব্যাধি কুষ্ঠে আক্রান্ত হন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। ১৯৪৯ সালে তিনি নিজ জন্মভূমি ভৈরবে চলে আসেন। সে সময় তিনি কুষ্ঠ রোগাক্রান্ত পচন ধরা আঙুলের সঙ্গে রশি দিয়ে কলম বেঁধে রচনা করেন তাঁর অমর গ্রন্থ ‘সমাজ ও সভ্যতার ক্রমবিকাশ’। ১৯৩৮ সালে তাঁর পরিবারের পক্ষ থেকে এলাকার শিশুদের শিক্ষিত করে তুলতে স্থাপন করা হয় একটি প্রাইমারি স্কুল, যা পরে শিমুলকান্দি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় হিসেবে পরিগণিত হয়। কুষ্ঠ আক্রান্ত রেবতী মোহন ভৈরবে আসার পর শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ঘরের বেড়ার (পার্টিশনের) আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে অপর পাশ থেকে ছাত্র পড়াতেন।
১৯৪৭ সালে সাম্প্রদায়িক চেতনায় বিভক্ত ভারতবর্ষের পাকিস্তান অংশে অসাম্প্রদায়িক সমাজ-সংস্কারক রেবতীর বিরুদ্ধে ধর্মান্ধগোষ্ঠী এলাকাবাসীকে ক্ষেপিয়ে তোলে। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি ১৯৫০ সালে প্রিয় জন্মভূমি ভৈরব ছেড়ে ভারতের আগরতলায় চলে যেতে বাধ্য হন। সেখানে ১৯৫২ সালের ৬ মে আত্মীয়স্বজন, পরিবার-পরিজনবিহীন নিঃসঙ্গ অবস্থায় একটি খড়ের ঘরে ৪৭ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন কালোত্তীর্ণ এ মহাপুরুষ।
তবে খুব বেশি দেরি হলেও ভৈরবের নতুন প্রজন্ম কালোত্তীর্ণ রেবতী মোহন বর্মণকে নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে বলে এনটিভি অনলাইনকে জানিয়েছেন লেখক ও শিশু সংগঠক অধ্যক্ষ শরীফ আহমেদ, সত্যজিৎ দাস ধ্রুবর মতো তাঁর দর্শন-ভক্তরা। সে ভাবনার ফল হিসেবে প্রগতি কেন্দ্র নামে একটি স্থানীয় সংগঠন এরই মধ্যে রেবতী মোহন স্মারকগ্রন্থ ‘কালোত্তীর্ণ রেবতী মোহন বর্মণ’ নামে একটি বই প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ভৈরবের শিমুলকান্দি হাই স্কুলের সামনে একটি স্মৃতিফলকও নির্মাণ করা হয়েছে। প্রতিবছর মৃত্যুবার্ষিকী পালনে ভৈরবে নেওয়া হয় নানা কর্মসূচি।
ক্যাপশন : কমরেড রেবতী মোহন বর্মণ।