৬৩-তেও অদম্য, পিএসসি দেবেন বাসিরন
সাদা চুল। কুঁচকে গেছে শরীরের চামড়া। চোখে ঠিকমত দেখতেও পান না। এমনই এক বৃদ্ধা বই খাতা নিয়ে গ্রামের মেঠোপথ পাড়ি দিয়ে যাচ্ছেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দিকে। সাথে দুজন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। প্রথম দেখাতে মনে হতে পারে নাতি-নাতনিদের স্কুলে পৌঁছে দিতে দাদি বা নানি যাচ্ছেন তাদের সাথে।
অথচ বাস্তব ঘটনাটি তার উল্টো। নিজেই লেখাপড়া করতে স্কুলে যাচ্ছেন এই বৃদ্ধা। আর যাদের সাথে যাচ্ছে তারা তার সহপাঠী। তিনিও পঞ্চম শ্রেণির নিয়মিত শিক্ষার্থী। আগামী ২০ নভেম্বর থেকে সারা দেশে একযোগে শুরু হতে যাওয়া প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় (পিএসসি) অংশ নেবেন এই বৃদ্ধাও।
এ বছরের পিএসসি পরীক্ষার্থী এই বৃদ্ধার নাম বাসিরন খাতুন। বয়স ৬৩ বছর। মেহেরপুর জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দুরে গাংনী উপজেলার হোগলবাড়িয়া গ্রামের মাঠপাড়ায় তাঁর বাড়ি। ৩৫ বছর আগে হারিয়েছেন স্বামী রহিল উদ্দিনকে। এরপর মানুষ করেছেন এক ছেলে ও দুই মেয়েকে।
এখন একমাত্র ছেলে মহির উদ্দিনের সাথে থাকেন বাসিরন। বড় হয়েছে তাঁর নাতি-নাতনিরাও। তাঁরাও এখন বিভিন্ন কলেজে ও বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেন।
লেখাপড়ার প্রচণ্ড আগ্রহ থেকে এই বয়সে এসে আবার শুরু করেন বাসিরন। বাড়ি থেকে প্রতিদিন এক কিলোমিটার মেঠোপথ হেঁটে বিদ্যালয়ে যান তিনি। এমনকি স্কুলের টিফিন বিরতিতে সহপাঠীদের সাথে নানারকম খেলাধুলায়ও অংশ নেন বাসিরন। কখনো এক্কা দোক্কা, কখনো কপাল টোক্কা খেলতে পছন্দ করেন তিনি। দাদির বয়সী এই সহপাঠীকে পেয়ে খুশি অন্য শিক্ষার্থীরাও।
হোগলবাড়িয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বাঁশের বেড়া দেওয়া ছোট ছোট চারটি কক্ষের একটিতে সহপাঠিদের সাথে লেখাপড়ায় ব্যস্ত বাসিরন। বাংলা বইটি চোখের খুব কাছে নিয়ে আপন খেয়ালে বইয়ের পাতায় আঙ্গুল দিয়ে পড়ে যাচ্ছেন বাসিরন। পড়ার সময় ঘন ঘন চোখের পলক ফেলছেন। বাসিরনের প্রবল আগ্রহের কারণে শিক্ষকরাও বেশ গুরুত্বের সাথে তাঁর লেখাপড়ার খেয়াল রাখেন।
জীবনের প্রায় শেষ সময়ে এসে লেখাপড়া শুরুর কারণ জানতে চাইলে বাসিরন খাতুন জানান, ছোটবেলা থেকেই তাঁর লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক ছিল। কিন্তু অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার কারণে সংসার সন্তান নিয়ে লেখাপড়া করা হয়নি তাঁর। সন্তানদের তিনি চেষ্টা করেছিলেন তাঁরা যেন উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত হন। এর মধ্যেই মারা যান স্বামী। ফলে সন্তানরা লেখাপড়াতে বেশি দূর যেতে পারেননি। এরপর যখন নাতি-নাতনিরা লেখাপড়া শুরু করে তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন যে এবার তিনিও লেখাপড়া শুরু করবেন। এ জন্য ছয় বছর আগে স্কুলে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেসময় স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ভর্তি করতে রাজি হয়নি। অবশ্য তাঁর আগ্রহ দেখে পরের বছর ভর্তি করা হয় বাসিরনকে।
বাসিরন বলেন, ‘আমি তো মানুষ। সব মানুষে যদি লেখাপড়া করতে পারে তাহলে আমি পারব না কেন। হয়তো আমি একটু কম পারব। কিন্তু পারব তো।’
লেখাপড়া শিখে কী করার ইচ্ছে এমন প্রশ্নের জবাবে বাসিরন জানান, পিএসসি পাস করার পর গ্রামের গার্লস স্কুলে (মাধ্যমিক বালিকা) ভর্তি হতে চান তিনি। এরপর নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি গ্রামের গরিব ছেলেমেয়েদের বিনাপয়সায় লেখাপড়া শেখাতে চান।
বাসিরনের বিষয়ে কথা হয় হোগলবাড়িয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিনের সাথে। তিনি বলেন, বাসিরন খাতুন ২০১০ সালে স্কুলে ভর্তি হওয়ার জন্য কয়েকবার এসেছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, বয়স্ক মানুষ মনের খেয়ালে ভর্তি হতে এসেছেন। পরে ক্লাস করবেন কি না তাঁর নিশ্চয়তা নেই। সে কারণে সে বছর তাঁকে ভর্তি করানো হয়নি। পরে যখন তিনি আবার আসেন তখন ২০১১ সালে তাঁকে ভর্তি করা হয়। ভর্তি হওয়ার পর বাসিরনের লেখাপড়ার আগ্রহ দেখে অবাক হয়েছেন বলে জানান প্রধান শিক্ষক।
হেলাল উদ্দিন জানান, প্রতিদিন নিয়ম করে স্কুলে আসেন বাসিরন। এমন কী বৃষ্টির দিনেও অনুপস্থিত থাকেন না তিনি। গত বছরই তাঁর পিএসসি পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তাঁকে পরীক্ষা দিতে দেওয়া হবে কি না তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধায় ছিল স্কুল কর্তৃপক্ষ। এ বছর উপজেলার শিক্ষা কর্মকর্তাদের কাছে বাসিরনের আগ্রহের কথা জানালে তাঁরা পরীক্ষা দেওয়ার অনুমতি দেন। পিএসসি পরীক্ষায় বাসিরন পাস করবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন এই শিক্ষক।
প্রতিদিনই ক্লাসের অন্য শিক্ষার্থীদের মতো বাসিরনকে পড়া ধরতে হয়। তা না ধরলে তিনি রাগ করেন বলে জানান বিদ্যালয়টির সহকারী শিক্ষিকা আনার কলি। তিনি জানান, বাসিরনের ক্লাস শুরু হয় সাড়ে ১১টায়। কিন্তু তিনি স্কুলে চলে আসেন ১০টার মধ্যে। এরপর বিভিন্ন সমস্যাগুলো বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। কোনো উত্তর ভুল হলে সেটি কেটে দিলে বেশ মন খারাপ হয় বাসিরনের। তখন সঠিকটা জেনে নিয়ে আবার লিখে দেন বলে জানান তাঁর শিক্ষিকা।
দাদির বয়সী বাসিরনের নিয়মিত স্কুলে আসা দেখে তাঁর সহপাঠীরাও অনুপ্রাণিত। সহপাঠী মৌ জানায়, বাসিরন তার দাদির বয়সী হলেও তাঁকে বান্ধবীর মতো করে দেখতে হয়। লেখাপড়া নিয়ে কোনো সমস্যা মনে হলে একে অন্যকে সহযোগিতা করেন।
সংসারে বাসিরন কেমন শাশুড়ি? জানতে চাইলে তাঁর একমাত্র ছেলের স্ত্রী জাহানারা বেগম বলেন, তাঁর আর দুটি সন্তানের মতো শাশুড়িও লেখাপড়া করে। তাঁর আগ্রহের কারণে যতটুকু সম্ভব সাহায্য করেন বলেও জানান তিনি। বেশিরভাগ সময় লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও প্রয়োজনে সংসারের কাজেও সহযোগিতা করেন তিনি।
আর নিজের বৌমাকে নিয়ে খুশি বাসিরনও। জানান, তাঁর দুটি মেয়ে পরের বাড়িতে গেছে। আর পরের বাড়ি থেকে একটি মেয়ে তাঁর বাড়িতে এসেছে। সেই মেয়েটিকে দেখে রাখা তাঁর দায়িত্ব বলেও মন্তব্য করেন বাসিরন।
বাসিরনের নাতি জসিম উদ্দিন বলেন, পরিবারের সবাইকে অবাক করে দিয়ে তাঁর নানি এই বয়সে পিএসসি পরীক্ষায় অংশ নিচ্ছেন। নানির আগ্রহ আর নিষ্ঠা দেখে তিনি বিশ্বাস করেন যে এ বছর পরীক্ষায় তিনি অবশ্যই পাস করবেন।
প্রতিবেশী কোরবান আলী পেশায় একজন গৃহশিক্ষক। তাঁর ছোট বোনও এবার পিএসসি পরীক্ষা দিবে। বাসিরন অনেক সময় বই খাতা নিয়ে তাঁর বোনের কাছে পড়তে আসেন জানিয়ে কোরবান আলী বলেন, এ সময় কোনো সমস্যা হলে বাসিরন তাঁর সাথে কথা বলে সমাধান করে নেন। বাংলা-অঙ্কসহ অন্যান্য বিষয়গুলো ভালোভাবে আয়ত্ব করতে পারলেও ইংরেজিতে বাসিরনের একটু সমস্যা হয় বলে জানান তিনি।
মটমুড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান (ইউপি) সোহেল আহমেদ বলেন, বাসিরনের লেখাপড়ার খবর পেয়ে তাঁর বাড়িতে ছুটে গিয়েছিলেন তিনি। বাসিরনের বয়স তাঁর আগ্রহের কাছে হার মেনেছে। সারা দেশের বয়স্ক মানুষদের জন্য বাসিরন উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন বলে মনে করেন ইউপি চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, তাঁকে দেখে অনেকেই অনুপ্রাণিত হবে। এই ইউনিয়ন এলাকায় বয়স্ক কেউ লেখাপড়া করতে চাইলে তাঁকে পরিষদের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতা করা হবে বলেও জানান তিনি।
৬৩ বছর বয়সী কেউ পিএসসি পরীক্ষা দেবে শুনে আনন্দিত গাংনী উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা আকবর আলী। তিনি বলেন, বাসিরনকে দেখে অন্য বয়স্ক মানুষরা লেখাপড়ায় আগ্রহী হবেন। এর ফলে সরকারের দেশকে নিরক্ষরতা মুক্ত করার লক্ষ্য বাস্তবায়ন সহজ হবে।