গাছের সাথে বেঁধে ‘সাহায্য’ আদায়
নাম তাঁর ববিতা খাতুন। বয়স ২৮ থেকে ৩০ বছর। আছে ছোট দুই ছেলে ও স্বামী। কিছুদিন আগেও তিনি সুস্থ ছিলেন। এখন তাঁকে পাগল বলা হচ্ছে। চিকিৎসার কথা বলে বাঁধা হয়েছে গাছের সঙ্গে। আদায় করা হচ্ছে চাঁদা। ঘটনাটি মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার বামুন্দি ইউনিয়নের নিশিপুর গ্রামের।
গত শনিবার নিশিপুর গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ব্যস্ততম সড়কের পাশে শিশুসহ নানা বয়সী লোকজনের ভিড়। একটি গাছের সাথে ববিতার হাত বাঁধা। বসেছিলেন মাটিতে। ধুলোয় পরনের জামায় ময়লার ছাপ। ববিতার সামনে রাখা ছিল বেগুনি রঙের একটি প্লাস্টিকের গামলা। সেখানে ছিল কিছু টাকা ও মুদ্রা।
পাশেই নিশিপুর যুব উন্নয়ন ক্লাবের কয়েকজন তরুণ সদস্য ছোটাছুটি করছিলেন। সাহায্য চাচ্ছিলেন রাস্তায় চলা যানবাহন ও পথচারীদের কাছে। টাকা পেলে তাঁরা রাখছিলেন ওই গামলায়।
নিশিপুর গ্রামের লোকজন জানান, ববিতাদের বাড়ি বামুন্দীর দেবীপুর গ্রামে। তাঁর বাবা-মা বেঁচে নেই। বিয়ের পর তাঁর দুই ছেলে হয়। একপর্যায়ে স্বামী তালাক দেন। এরপর ছোট দুই ছেলেকে নিয়ে বামুন্দী সদরে চলে আসেন ববিতা।
বিভিন্ন বাড়িতে কাজ করা শুরু করেন তিনি। এ সময় বামুন্দির মোল্লাপাড়ার ব্যবসায়ী মিনা মিয়ার সাথে ববিতার পরিচয় হয়। একপর্যায়ে মিনা মিয়া ও ববিতার বিয়ে হয়। বিয়ের পর বামুন্দিতে একটি ভাড়া বাড়িতে বসবাত করতেন তাঁরা। কিছুদিন আগে ববিতাকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যান মিনা। সেখানে মিনার প্রথম স্ত্রী ও বাড়ির লোকজন ববিতাকে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। এ নিয়ে কয়েকদিন ঝগড়া-বিবাদ চলছিল। এর মধ্যে ববিতা হঠাৎ ‘মানসিক ভারসাম্য’ হারিয়ে ফেললে তাঁর খালা রিজিয়া খাতুনের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। তার পর থেকেই তাঁর কোনো খোঁজখবর নেননি মিনা মিয়া।
রিজিয়া খাতুন অভিযোগ করেন, ‘মিনা মিয়া যখন ববিতাকে তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান, তখন ববিতা সম্পূর্ণ সুস্থ ছিল। ববিতাকে ওই বাড়ি থেকে তাড়ানোর জন্য কিছু খাইয়ে পাগল বানানো হয়েছে। মিনা মিয়া ওর চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা না করে আমার এখানে রেখে গেছে। এরপর আর কোনো খোঁজখবর নেয়নি। আমার আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় পাড়ার ছেলেরা চিকিৎসার টাকা তোলার উদ্যোগ নিয়েছে।’
ববিতাকে গাছের সঙ্গে বাঁধা প্রসঙ্গে রিজিয়া খাতুন বলেন, ‘শরীরের সব কাপড়চোপড় খুলে ফেলার চেষ্টা করছে ববিতা। মাথার চুল টেনে টেনে ছিঁড়ছিল। এ কারণে চুল কেটে খাটো করা হয়েছে। হাত বেঁধে রাখা ছাড়া কোনো উপায় নেই।’
ববিতার এই অবস্থার জন্য তাঁর স্বামী মিনা মিয়া ও তাঁর প্রথম স্ত্রীকে দায়ী করেছেন এলাকার লোকজন। তাঁরা এই ঘটনার বিচার চেয়েছেন। সেই সঙ্গে ববিতার সুষ্ঠু চিকিৎসার জন্য সমাজের বিত্তবান ব্যক্তি ও প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন।
এ ব্যাপারে মিনা মিয়ার মুঠোফোনে আজ রোববার বিকেল থেকে একাধিকবার ফোন দিলেও তিনি ধরেননি। একপর্যায়ে তিনি ফোন বন্ধ করে রাখেন।
চাঁদা আদায় প্রসঙ্গে নিশিপুর যুব উন্নয়ন ক্লাবের সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান লাল্টু জানান, প্রতিদিন প্রায় এক হাজার টাকা আদায় হচ্ছে। গত কয়েকদিন যা আদায় হয়েছে তা চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট নয়। টাকা জোগাড় হলে ববিতাকে পাবনায় মানসিক হাসপাতালে নেওয়া হবে। ববিতার পাশে দাঁড়াতে তিনি সমাজের সবার প্রতি আহ্বান জানান।
যোগাযোগ করা হলে গাংনীর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবুল আমিন বলেন, ‘বিষয়টি অমানবিক। প্রতিটি মানুষ সহযোগিতা পাওয়ার অধিকার রাখে। কিন্তু তার উল্টোটি হচ্ছে। গাছের সাথে বেঁধে রেখে নারীর অসহায়ত্ব দেখিয়ে চিকিৎসার টাকা তুলতে হচ্ছে। ওই নারীর স্বামীর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
বিষয়টি নজরে পড়েছে পুলিশেরও। গাংনী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আকরাম হোসেন জানান, গৃহবধূর চিকিৎসায় সহযোগিতা ছাড়াও স্বামী মিনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।