মাস্টারপ্ল্যানে চলছে মোংলা বন্দরের উন্নয়ন, বাড়বে সক্ষমতা
মোংলা বন্দরে আউটার ও ইনারবার ড্রেজিংয়ের পর এবার ‘পশুর চ্যানেলে সংরক্ষণ ড্রেজিং’ নামে একটি বড় প্রকল্প গ্রহণ করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। গত ৮ জানুয়ারি একনেকের সভায় অনুমোদন হওয়া ১০টি উন্নয়ন প্রকল্পের মধ্যে মোংলা বন্দরের এ প্রকল্পটিও রয়েছে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৫৩৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এরই মধ্যে বঙ্গোপসাগর মোহনা হিরণ পয়েন্ট দিয়ে হারবাড়িয়া পর্যন্ত আউটারবার ড্রেজিং সম্পন্ন হয়েছে। আর বর্তমানে ইনারবার ড্রেজিং চলমান।
বর্তমানে বন্দর চ্যানেলের ইনারবার ড্রেজিং শেষ হলে ৯ দশমিক ৫০ মিটার থেকে ১০ মিটার ড্রাফটের জাহাজ মোংলা বন্দর জেটিতে সরাসরি প্রবেশ করতে পারবে। আর বন্দরের চ্যানেলের ড্রাফ ধরে রাখতে ‘পশুর চ্যানেলে সংরক্ষণ ড্রেজিং’ নামের এ প্রকল্পটি গ্রহণ করেছে কর্তৃপক্ষ।
বন্দর সূত্র জানায়, নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে ২০০২ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত মৃতপ্রায় বন্দরে পরিণত হয়েছিল এই সমুদ্রবন্দরটি। সে সময় বন্দরটি অচল হয়ে পড়ার মূল কারণ ছিল—বন্দরের আউটার ও ইনারবার চ্যানেলে ড্রেজিং না করা। যে কারণে ওই সময়ে চরম নাব্যসংকট দেখা দেওয়ায় জাহাজ ভিড়তে পারত না বন্দরে। মাসের পর মাস জাহাজ শূন্য হয়ে অচলাবস্থা ছিল বন্দরজুড়ে।
এ ছাড়া বন্দরের আউটারবার (বর্হিনোঙ্গর) ও ইনারবারে (অভ্যন্তরীণ) নাব্য সংকটের কারণে কনটেইনারবাহী ৯ দশমিক ৫০ মিটার গভীরতা সম্পন্ন জাহাজ মোংলা বন্দরে সরাসরি প্রবেশ করতে না পারায় কনটেইনারাইজড মালামাল আমদানি-রপ্তানিতে ব্যবসায়ীরা নিরুৎসাহিত হয়ে পড়েন। ২০২০ সালে ৭১২ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৪ কিলোমিটার আউটারবার ড্রেজিংয়ের কাজ শেষ হয়। এখন আউটারবার চ্যানেল দিয়ে বর্তমানে ৯ মিটার ড্রাফটের জাহাজ অনায়াসে আসা যাওয়া করছে। পরে বন্দর জেটিতে স্বাভাবিক জোয়ারে ৯ দশমিক ৫০ মিটারের অধিক গভীরতা সম্পন্ন জাহাজ আনার জন্য পশুর চ্যানেলের জয়মনিরঘোল হতে বন্দর জেটি পর্যন্ত প্রায় ২৩ কিলোমিটার নৌপথ খননের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সেই প্রকল্পের ইনারবারে ২১৬ দশমিক শূন্য ৯ লাখ ঘন মিটার ড্রেজিং করার উদ্যোগ নেয় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
এর আগে গত ২০২১ সালের ১৩ মার্চ মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের প্রায় ২৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার নদীপথের ইনারবার (অভ্যন্তরীণ চ্যানেল) ড্রেজিং শুরু হয়। এই প্রকল্পের কাজ ২০২২ সালের জুনে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও সময় বৃদ্ধি করে তা এখনও চলমান। সেই সময় প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছিল ৭৯৩ কোটি ৭২ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এই প্রকল্প দিয়ে ২১৬ দশমিক ৯ লাখ ঘনমিটার বালু ড্রেজিং করা হবে।
চীনা কোম্পানি জেএইচসিইসি ও সিসিইসিসি ঠিকাদার হিসেবে জয়েন্ট ভেঞ্চারে এই ড্রেজিং কাজ করছে। ইনারবার ড্রেজিংয়ের উত্তোলিত পলিমাটি ও বালু ফেলার জন্য ১ হাজার ৫০০ একর জমির বরাদ্দ নেওয়ার কথা থাকলেও তা চলমান রয়েছে।
এদিকে নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ করতে না পারায় প্রকল্প ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯৯২ কোটি টাকায়, যা গত বছরের ৪ এপ্রিল একনেক সভায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। বন্দরকে সচল রাখতে পরপর তিনটি প্রকল্প গ্রহণ করে কর্তৃপক্ষ। তার মধ্যে আউটারবার ড্রেজিং শেষ হয়েছে, এখন ইনারবার ড্রেজিং কাজ চলমান।
গত বুধবার মোংলা বন্দরের জন্য ‘পশুর চ্যানেলে সংরক্ষণ ড্রেজিং’ নামের একটি বড় প্রকল্প অনুমোদন হয়েছে একনেকে। এ প্রকল্পটির মোট ব্যয় হবে ১ হাজার ৫৩৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৮৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে এবং ১৫৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল থেকে দেওয়া হবে বলেও জানা গেছে। প্রকল্পটি চলতি বছরের (২০২৫) সালে জানুয়ারি থেকে ২০২৯ সালের ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ সমাপ্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
মোংলা বন্দরে ‘পশুর চ্যানেলে সংরক্ষণ ড্রেজিং’ প্রকল্পও পরিকল্পনায় রয়েছে। এটিও জানুয়ারি ২০২৫ থেকে ডিসেম্বর ২০২৯ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পটির মোট ব্যয় ১ হাজার ৫৩৮ কোটি ১৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ১ হাজার ৩৮৪ কোটি ৩৭ লাখ টাকা সরকারি তহবিল থেকে এবং ১৫৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব অর্থায়নে হবে।
‘মোংলা বন্দরের জন্য সহায়ক জলযান সংগ্রহ (১ম সংশোধিত)’ প্রকল্পটি ৭৬৭ কোটি ২৫ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৯৩৬ কোটি ৫৬ লাখ টাকা হবে। এটি বাস্তবায়ন করছে মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষ এবং মেয়াদকাল ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত।
এ ছাড়া ‘গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম এবং ইন্টিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’ প্রকল্পটি ১১৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা থেকে বেড়ে ৯৩২ কোটি ৬০ লাখ টাকা হয়েছে, যা নৌপরিবহণ অধিদপ্তর বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পটি ২০১৪ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাস্তবায়িত হবে।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল শাহীন রহমান জানান, দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্র বন্দর বাঁচিয়ে রাখার স্বার্থে নিয়মিত পশুর চ্যানেল ড্রেজিংয়ের বিকল্প নেই। প্রথম আউটারবার ড্রেজিং শেষ করে ২০২১ সালের ১৩ মার্চ ইনারবার ড্রেজিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে মোংলা বন্দর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রায় বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। এরই মধ্যে আমরা সেটা প্রমাণ করতে পেরেছি। দেশের তিনটি বড় মেগা প্রকল্প রূপপুর পাওয়ার প্ল্যান্ট, রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র ও মেট্রোরেল প্রকল্পের সব ইকুইপমেন্টসহ দেশের বড় বড় প্রকল্পের মালামাল এই বন্দর দিয়ে আনলোড হচ্ছে। এ বছর বন্দরে রেকর্ড সংখ্যক জাহাজের আগামন-নির্গমনসহ রাজস্বও বৃদ্ধি পেয়েছে।
শাহীন রহমান বলেন, বন্দরকে আরও গতিশীল ও আধুনিক করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। এর মধ্যে কিছু প্রকল্প শেষ হয়েছে এবং কিছু চলমান।
মোংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান বলেন, বর্তমানে মোংলা বন্দরের পশুর চ্যানেলের ইনারবার বা অভ্যন্তরীণ চ্যানেল ড্রেজিংয়ের কাজ চলছে এবং পশুর চ্যানেল সংরক্ষণ ড্রেজিং শুরু করতে যাচ্ছি। গুরুত্বপূর্ণ এই কর্মযজ্ঞ শেষ হলে মোংলা বন্দরের নাব্যসংকট নিরসনসহ গতিধারা ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম মোংলা সমুদ্রবন্দরের সক্ষমতা কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে বলেও আশা করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।
বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান আরও বলেন, একটি বন্দরকে এগিয়ে নিতে দরকার মাস্টারপ্ল্যান। আমরা বন্দরকে নতুন রূপে সাজাতে একটি বড় মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়েছি।