লাখপতির গল্প
সংসার সামলে সফল উদ্যোক্তা জান্নাত মিষ্টি
এ যেন মুক্ত আকাশে পাখির মতো উড়ে চলা এক জীবন। কোনো বাধাই তাঁকে ফেরাতে পারেনি। শত কষ্ট ও বাধা পেরিয়ে অন্যের পেছনে না ঘুরে নিজের ঘরে গড়েছেন প্রতিষ্ঠান। নাম দিয়েছেন ‘আরওয়া’, যার অর্থ সবচেয়ে সুন্দর। ব্যস, নামের সার্থকতা রেখেছেন। সুন্দর করেই চালাচ্ছেন নিজের প্রতিষ্ঠান। যাঁর পণ্য ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি, সালোয়ার কামিজ, পাঞ্জাবি পিস, জুম শাড়ির ফিউশন, জুম ওড়না ইত্যাদি। হ্যাঁ, বলা হচ্ছে জান্নাত মিষ্টির কথা।
জান্নাত মিষ্টির আদুরে মেয়ের নাম আরওয়া। মেয়ের নামেই করা তাঁর অনলাইন পেজ। ২০১৮ সালের ১৩ মে এ উদ্যোগ শুরু করেন। এক বড় বোনের আগ্রহ ও প্রেরণায় প্রথম পদক্ষেপ নেওয়া। মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে শুরু ছিল তাঁর উদ্যোগ। সংসার-সন্তান সবকিছু সামলে কাজ করাটাই ছিল চ্যালেঞ্জ। তবে দমে যাননি মিষ্টি। পরিশ্রম আর অধ্যবসায় দিয়ে হয়েছেন লাখপতি।
২০১৯ সালের ১৩ অক্টোবর নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় ফেসবুক প্ল্যাটফর্ম উই-এ (উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম—উই) যোগ দেন। তারপর পাল্টে যায় জান্নাত মিষ্টির জীবন। এনটিভি অনলাইনকে তিনি বলেন, ‘উই-এ জয়েন করেছিলাম আর দশটা গ্রুপ ভেবেই। কিন্তু উই-এর অ্যাক্টিভিটি দেখে নড়েচড়ে বসেছিলাম। উই-এর অ্যাডভাইজার রাজিব আহমেদ স্যারের অ্যাক্টিভিটি ছিল একদম আলাদা। কাকলী আপুকে দেখতে লাগলাম, আপু জামদানি শাড়ি নিয়ে জানা-অজানা সব লিখে যাচ্ছেন। এক অদ্ভুত আকর্ষণে পড়ে যাই উই-এর। তবে সুপার অ্যাক্টিভ হই ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে। একটা কথা না বললেই নয়, নারী উদ্যোক্তাদের স্বপ্ন পূরণের কারখানা উই।’
আর কারণটা জানাও খুব জরুরি। জান্নাত মিষ্টি বললেন, শুধু উই থেকে তাঁর আট মাসে পণ্য বিক্রি হয়েছে ছয় লাখ ৪০ হাজার টাকা।
জান্নাত মিষ্টির একটি কথা এখন অন্তর্জালবাসীর মুখে মুখে ফেরে। বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তাদের। তিনি বলেছিলেন, ‘শখের ব্যবসায়ী না হয়ে হয়ে উঠুন উদ্যোক্তা।’ মিষ্টির মুখেই শুনুন, ‘হ্যাঁ, কথাটি আমার! আমরা যারা উদ্যোক্তা, তারা বুঝে-শুনে-দেখে নিজের কাজের পাশাপাশি আরো দশ জনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকি। আর অনেকেই সময় অতিবাহিত করার জন্য শখ করে ব্যবসা করে থাকে। এসব শখের ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে হাজারো নারী উদ্যোক্তা, যাদের মাথার ওপর অনেক দায়িত্ব। শখের ব্যবসায়ীরা আসলে ব্যবসায়ী থেকে যায়, উদ্যোক্তা হয়ে উঠতে পারে না! উদ্যোক্তা হয়ে আমার একটা কথাই বারবার মনে হয়, আমি পাখির মতো মুক্ত। নিজের যোগ্যতায় কাজ করে আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।’
তো, পরিবার থেকে কেমন সাড়া পাচ্ছেন? মিষ্টি বলেন, ‘আলহামদুলিল্লাহ। আমার সবচেয়ে বড় সাপোর্ট হলো আমার পরিবার। আমার উদ্যোক্তা-জীবনের শুরুটাই আমার মা-বাবা আর ভাইয়ের অনুপ্রেরণায়। আর এখন তো পরিচিত সবাই আছেন আমাকে সাপোর্ট করার জন্য। আসলে নারীদের পরিবারের লোকজন উদ্যোক্তা হওয়াটা তেমন সাপোর্ট করে না। কিন্তু আমার পরিবারের চিত্রটা একদম ভিন্ন। আমার শ্বশুরবাড়ির প্রতিটি সদস্য থেকে শুরু করে আমার বাবার বাড়ির সবাই আমাকে অনেক বেশি সাপোর্ট করে।’
এবার জান্নাত মিষ্টির পণ্যের মানের কথায় আসা যাক। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে যেকোনো পণ্যের কোয়ালিটিটা সবার আগে। সব সময় একটা জিনিস মাথায় রেখে কাজ করি, যা আমি ব্যবহার করতে পারব না, তা কাউকে ব্যবহার করতে দেব না। কোনো পণ্যের মান আর সার্ভিস ভালো থাকলে একজন কাস্টমার রিপিট কাস্টমারে পরিণত হবে, সাথে আরো কাস্টমার আনবে। আমি পণ্যের মানের সঙ্গে কোনো কম্প্রোমাইজ করি না।’
জান্নাত মিষ্টির একটাই স্বপ্ন, আরওয়া দেশের মাটি ছাড়িয়ে পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ুক। বলেন, ‘এক্সপোর্ট করার জন্য কাজ করছি আমরা। আরওয়াকে একটা ব্র্যান্ড হিসেবে দেখতে চাই। আরওয়ার মাধ্যমে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান হোক, বিশেষ করে নারীদের; এই স্বপ্ন দেখি আমি। চাই সবাইকে নিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যেতে। সবার মুখে শুনতে ইচ্ছে করে—আমরাই নারী, আমরাই পারি!’
উদ্যোক্তাদের প্রতি মিষ্টির পরামর্শ একটাই, কাজের কোনো বয়স নেই, সব বয়সে সব পরিস্থিতিতে কাজ করার মানসিকতা থাকতে হবে। কেউ কারো জন্য পথ তৈরি করে দেবে না, নিজেকেই পথ তৈরি করে নিতে হবে। আর কোনো কাজকে ছোট করে দেখা যাবে না। মনে রাখতে হবে, ছোট থেকেই সব বড় হয়। শুধু স্বপ্নটাকে বাস্তবায়ন করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা থাকতে হবে। তাহলেই জীবনে সাফল্য আসবে।