কীভাবে ফেসবুকে চাকরি পেলেন জুলফিকার?
আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে অনেকেই বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন। তেমনি জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে চাকরি পেয়েছেন আসিফ জুলফিকার। সেখানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেওয়ার কথা রয়েছে তাঁর। তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইআইটি) বিভাগের ৪২ ব্যাচের শিক্ষার্থী। কীভাবে স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিল, এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে সেই সফলতার গল্প বললেন জুলফিকার।
এনটিভি অনলাইন : প্রথম কখন সফটওয়্যার ও প্রোগ্রামিং-এর প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয়?
জুলফিকার : বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির দেড় মাস আগে থেকে প্রোগ্রামিং-এর সঙ্গে পরিচিত হই। টঙ্গীতে এক বড় ভাইয়ের সঙ্গে থাকতাম। ভাই প্রোগ্রামিং করতেন। উনার কাছ থেকে প্রোগ্রামিং শেখা হয়েছে। বর্তমানে ওই ভাই ফেসবুকে (ইউএসএ) কর্মরত। আগে উনি গুগলে কাজ করেছেন। ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার পর প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) চান্স পাই। পরে জাহাঙ্গীরনগরে আইআইটি’তে ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর ঢাবি ছেড়ে চলে আসি। কারণ, আমার আগে থেকেই সফটওয়্যার ও প্রোপ্রামিং-এর প্রতি একটা আকর্ষণ ছিল।
এনটিভি অনলাইন : পড়াশোনার পাশাপাশি কীভাবে প্রোগ্রামিং শিখেছেন?
জুলফিকার : আমার ডিপার্টমেন্ট যেহেতু আইআইটি, তাই বিভিন্ন প্রোগ্রামিং কনটেস্টে অংশ নিতাম। এরপর কয়েক বছর নিজে নিজে শিখেছি এবং অনুশীলন করেছি। পড়াশোনা শেষে স্যামসাং কোম্পানিতে জয়েন করেও প্রোপ্রামিং-এর কাজই করেছি। অফিসের কাজের বাইরেও প্রোগ্রামিং করা হতো। কখনও প্রোগ্রামিং ছাড়া হয়নি।
এনটিভি অনলাইন : কোন কোন সাবজেক্ট থেকে ফেসবুকে চাকরি পাওয়ার সুযোগ আছে?
জুলফিকার : যেকোনো সাবজেক্ট থেকেই এখানে চাকরির সুযোগ আছে। কিন্তু, ব্যক্তিকে অবশ্যই সমস্যা উদঘাটন ও তা সমাধানের প্রক্রিয়া জানতে হবে। প্রোগ্রামিং জানতে হবে। প্রোগ্রামিং-এর দক্ষতার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধানের উপায় বের করতে হবে।
এনটিভি অনলাইন : কীভাবে একজন নতুন গ্র্যাজুয়েট ফেসবুকে চাকরির জন্য আবেদন করবেন?
জুলফিকার : প্রতিবছর ফেসবুক বিভিন্ন দেশ থেকে লোকবল নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। প্রায় সব দেশ থেকেই অনেক আবেদনপত্র জমা পড়ে। তবে সুবিধা হয়, যদি কারও কাছ থেকে সুপারিশ নেওয়া যায়। কোনো বড় ভাই, যিনি ফেসবুকে কর্মরত রয়েছেন, এমন কারও সুপারিশ নিলে সহজে ভাইভার সুযোগ পাওয়া যায়। তবে, সরাসরি আবেদন করলেও সম্ভব।
এনটিভি অনলাইন : ফেসবুক অফিসে লোকবল নিয়োগ দেবে, এটা জানবে কীভাবে?
জুলফিকার : ফেসবুকের ক্যারিয়ার সাইটে ঢুকে দেখতে হবে—কী কী চাকরির সুযোগ আছে। এ ছাড়া প্রতি বছরের শুরুতে একটা হেড কাউন্ট করা হয়। হেড কাউন্ট মানে হলো—এ বছর কী পরিমাণ মানুষ নেওয়া হবে, এ রকম খবর পাওয়া যায়। আরেকটা উপায় হলো, পরিচিত মানুষের মাধ্যমে সহজে জানা যায়।
এনটিভি অনলাইন : ফেসবুকে কী ধরনের চাকরির সুযোগ আছে?
জুলফিকার : ফেসবুকে অনেক চাকরির সুযোগ আছে। মানুষ শুধু মনে করে, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়াররাই চাকরি করে। বিষয়টা কিন্তু এমন না। এখানে হিউম্যান রিসোর্স (এইচআর), মার্কেটিং, অ্যাডমিনসহ বিভিন্ন বিভাগে পদ আছে।
এনটিভি অনলাইন : ফেসবুকে চাকরিতে কয়টি ধাপ আছে?
জুলফিকার : ফেসবুকে চাকরি শুরু হয় ই-৩ থেকে। এই ধাপ মানে হলো ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েট। এরপর ই-৪ থেকে ই-৮ পর্যন্ত আছে। ওপরের দিকের পদগুলো হলো ডিরেক্টরদের। তবে, এখানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারদের পদের সংখ্যাই বেশি।
এনটিভি অনলাইন : আবেদন কি অনলাইনে করতে হয়? আপনি কীভাবে আবেদন করেছেন?
জুলফিকার : সাধারণত আবেদন ওয়েবসাইটে গিয়ে করতে হয়। ওখান থেকে পরে ইন্টারভিউ-এর জন্য ডাকা হয়। আমার যেহেতু একজন পরিচিত বড় ভাই ছিলেন, উনাকেই আমি সিভি দিয়েছি। উনি সুপারিশ করে জমা দিয়েছেন। এরপর রিক্রুটমেন্ট থেকে ভাইভার জন্য ডেকেছে।
এনটিভি অনলাইন : কয়টা ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে? কী প্রক্রিয়ায় দিতে হয়েছে?
জুলফিকার : আমাকে মোট সাতটি ইন্টারভিউ দিতে হয়েছে। প্রথমেই রিক্রুটমেন্ট থেকে ভাইভা নেওয়া হয়েছে। সেখানে একজন আবেদনকারীর আগের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানা হয়। এটা যাচাই করা হয় যে, তিনি মূল ভাইভা দেওয়ার জন্য যোগ্য কিনা।
এরকম ধাপে ধাপে ইন্টারভিউ সম্পন্ন হয়। তিন থেকে চারটি ধাপের মাধ্যমে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হয়। শেষ ধাপে চার থেকে পাঁচটি ইন্টারভিউ দিতে হয়। এটা একদিনেও হতে পারে আবার দুদিনও লাগতে পারে। ফাইনাল ধাপে এরকম প্রোগ্রামিং ইন্টারভিউ থাকে দুই থেকে তিনটি। এ ছাড়া ফেসবুক চাকরির ক্ষেত্রে প্রত্যেক প্রার্থীকে অবশ্যই সিস্টেম ডিজাইন ইন্টারভিউ/সিস্টেম আর্কিটেক্ট ইন্টারভিউ দিতে হয়। এরপর আবেদনকারীকে বিহ্যাভিওরাল ইন্টারভিউ দিতে হয়। এই তিন ধরনের ইন্টারভিউ দিতে হয়।
এ তিন ধরনের ইন্টারভিউ হলো—
ফোন ইন্টারভিউ : এটা মূলত ভিডিও কলের মাধ্যমে নেওয়া হয়। এটা প্রোগ্রামিং ইন্টারভিউ। একজন ইন্টারভিউয়ারের সঙ্গে কথা বলতে হয়। তিনি কিছু সমস্যা দেন, তা সমাধান করতে হয়। সঙ্গে সঙ্গে ব্যাখ্যাও দিতে হয়। কোনো একটি সমস্যা সমাধানে আমি কী চিন্তা করছি, তা বর্ণনা করতে হয়। কোনটা সবচেয়ে ভালো সমাধান হবে, তা নির্বাচন করতে হয়। এর জন্য ৩৫ থেকে ৪০ মিনিটের সময় পাওয়া যায়।
সিস্টেম ডিজাইন ইন্টারভিউ/সিস্টেম আর্কিটেক্ট ইন্টারভিউ : এই ইন্টারভিউটা একটু ব্যাতিক্রমী। কোনো একটি সিস্টেম কীভাবে ডিজাইন হয়, সে সম্পর্কে ধারণা দিতে হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়—ডিজাইন ইউটিউব অথবা ডিজাইন গুগল সার্চ। এর মানে হলো, এই সিস্টেমটা ডিজাইন কীভাবে করতে হবে, তার সম্পর্কে ধারণা দিতে হবে। কীভাবে এপ্রোচ করবে এবং কীভাবে উপাদানগুলো থাকবে, সবগুলো উপাদান আবার কীভাবে একসঙ্গে কাজ করবে, এরকম রাউন্ড থাকে। এই রাউন্ডে ভালো করতে হলে চাকরির অভিজ্ঞতার পাশাপাশি সিস্টেম আর্কিটেক্ট সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।
বিহ্যাভিওরাল ইন্টারভিউ : এটিও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে যে বিষয় নিয়ে কথা হয়, তার মধ্যে হলো—ব্যক্তির আগের কী কী অভিজ্ঞতা আছে, কী কী চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করা হয়েছে, বর্তমান চাকরিতে থাকা সমস্যাগুলো কীভাবে সমাধান করছি, কারও সঙ্গে মতবিরোধ হলে কীভাবে সমাধান করছি, এসব ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট উদাহরণসহ ব্যাখ্যা দিতে হয়।
এনটিভি অনলাইন : সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে কতো সময় লাগতে পারে?
জুলফিকার : নিয়োগের সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ন্যূনতম দেড় মাস সময় লাগে। তবে প্রাথমিক ধাপগুলো পার হলে আবেদনকারীকে জিজ্ঞেস করা হয়, তাঁর কী পরিমাণ সময় লাগতে পারে। পরবর্তী সময়ে প্রস্তুতির জন্য তাঁকে সে পরিমাণ সময় দেওয়া হয়। আমার এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তিন মাস লেগেছে।
এনটিভি অনলাইন : একজন ব্যক্তি কয়বার আবেদন করতে পারবেন?
জুলফিকার : ফেসবুক প্রতি বছরই নতুন লোকবল নিয়োগ দিয়ে থাকে। তাই, কেউ চাইলে প্রতিবারই চেষ্টা করতে পারেন। অনেক সময় প্রথমবার না পারলে কর্তৃপক্ষ থেকেই বলা হয়, আপনি আগামীবার আবার চেষ্টা করুন।
এনটিভি অনলাইন : আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন, আপনার অনুভূতি কেমন?
জুলফিকার : এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশের তেমন লোকবল নেই। তাই অল্প কয়েকজনের মধ্যে একজন হতে পেরে অসাধারণ অনুভূতি কাজ করছে। দেশের বাইরে নিজের দেশ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্ব করা সৌভাগ্যের ও গর্বের।
এনটিভি অনলাইন : যেসব তরুণ শিক্ষার্থীরা ফেসবুকে চাকরি করতে আগ্রহী, তাদের জন্য আপনার কী পরামর্শ থাকবে?
জুলফিকার : যারা ফেসবুকের মতো এমন বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আগ্রহী, তাদের প্রথম বর্ষ থেকেই পড়াশোনার পাশাপাশি প্রোগ্রামিং নিয়ে নাড়াচাড়া করতে হবে। যাদের সফটওয়্যারে আগ্রহ বেশি, তারা ‘লিককোড সাইট’ দেখতে পারেন। এখানে যারা অলরেডি ইন্টারভিউ দিয়েছেন, তাঁরা তাদের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন, বিভিন্ন সমস্যা সম্পর্কে বলেন। আগ্রহীদের এসব সমস্যা সম্পর্কে জানতে হবে এবং তা সমাধান করতে পারতে হবে। এভাবে আস্তে আস্তে তাঁর মধ্যে দক্ষতা বৃদ্ধি পেতে থাকবে। এ ছাড়া ‘গ্লাসডোর’ নামের একটি সাইট রয়েছে। এখানেও ইন্টারভিউ’র অভিজ্ঞতা শেয়ার করা হয়। যারা সফটওয়্যার ছাড়া অন্যান্য বিভাগের, তাঁরা এখান থেকে সব ধরনের সমস্যা সম্পর্কে জানতে পারবেন, প্রাথমিক ধারণা পাবেন। এই আলোকে নিজেকে প্রস্তুতের সুযোগ পাবেন। এসব প্রস্তুতির পাশাপাশি তাঁকে বিভিন্ন প্রোগ্রামিং অথবা বিজনেস আইডিয়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে হবে। সুযোগ থাকতে কারও দ্বারা ডেমো ইন্টারভিউ নেওয়া যেতে পারে। এ রকমভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে।
এনটিভি অনলাইন : আন্তর্জাতিক এসব প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশিদের সুযোগ কেমন?
জুলফিকার : আমাদের পাশের দেশ ভারতের মানুষরা এসব প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশ পদ দখল করে আছেন। তাদের সুবিধা হলো—ভারতে সব প্রতিষ্ঠানের আঞ্চলিক অফিস রয়েছে। তাই তাদের ফ্রেশ গ্র্যাজুয়েটরা খুব সহজেই এসব প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুযোগ পান। ভারত অনেক জনসংখ্যা থাকায়, তাদের মার্কেটিং পলিসি ও ম্যানেজমেন্ট পলিসির দক্ষতা বেশি থাকে। ফলে তাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদে সহজেই আসীন হন। আমাদের দেশে এরকম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের অফিস নেই। তাই আমাদের সুযোগটা তুলনামূলক কম এবং উত্তীর্ণ হওয়া কঠিন। সরকার এসব বড় প্রতিষ্ঠানগুলোর অফিস বাংলাদেশে করার সুযোগ সৃষ্টি করলে বাংলাদেশি তরুণেরাও আন্তর্জাতিক এসব প্রতিষ্ঠানে নেতৃত্ব দিবে।
এনটিভি অনলাইন : আপনার জন্য অনেক শুভকামনা।
জুলফিকার : এনটিভি অনলাইনের জন্যেও অনেক শুভকামনা।