জাবির ভিসি প্যানেলের নির্বাচন ঘিরে নানা সমীকরণ
আগামী ১২ আগস্ট দীর্ঘ আট বছর পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন। নির্বাচন ঘিরে চলছে নানা সমীকরণ। প্রার্থী বাছাইয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন সিনেট সদস্যরাও। আলোচনায় আসছে সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম।
সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকার দৌড়ে এগিয়ে আছেন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মো. নূরুল আলম, সাবেক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক আমির হোসেন, সাবেক উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন, অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক আব্দুল জব্বার হাওলাদার, অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদার এবং অধ্যাপক লায়েক সাজ্জাদ এন্দেল্লাহ।
এ ছাড়াও বর্তমান কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক রাশেদা আখতার, অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফি ও অধ্যাপক মোহা. মুজিবুর রহমানের নাম শোনা যাচ্ছে।
সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামের ‘কাছের মানুষ’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলম। উপ-উপাচার্য (শিক্ষা), শিক্ষক সমিতির সভাপতিসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এই অধ্যাপক। সক্রিয় রয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় রাজনীতিতে। শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটি বড় অংশ ধামরাই-মানিকগঞ্জের হওয়ার সুবাদে তাঁদের মধ্যে বেশ গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে তাঁর। নিজ প্যানেলে শক্ত প্রতিনিধি নিয়ে আসতে নতুন করে মাঠ গোছাচ্ছেন বলেও জানা গেছে।
শিক্ষক রাজনীতি ও সিনেটে ভালো গ্রহণযোগ্যতার জন্য সাবেক উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আমির হোসেনকে ভিসি হওয়ার দৌড়ে অনেকেই এগিয়ে রাখছেন। ২০১৪ সালের ভিসি প্যানেল নির্বাচনে সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির প্যানেলে থেকে নির্বাচন করে তৃতীয় হয়েছিলেন অর্থনীতি বিভাগের এই অধ্যাপক।
বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ-এর সভাপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একমাত্র বীর মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষক আমির হোসেন এবারেও অধ্যাপক শরীফ পন্থিদের সাহচার্য পাবেন বলে মত অনেকের।
এ ছাড়াও এই প্যানেল থেকে অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান, অধ্যাপক আব্দুল জব্বার হাওলাদার কিংবা অধ্যাপক মো. আবুল হোসেন নির্বাচন করতে পারেন বলে জানা গেছে।
দেশব্যাপী পরিচিত, গুণী প্রত্নতত্ত্ববিদ হওয়ার সুবাদে প্যানেলের বাকিদের তুলনায় অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান এগিয়ে থাকবেন বলেও মত একাধিক সিনেট সদস্যের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিনেট সদস্য বলেন, ‘আমরা চাই নির্বাচনের মাধ্যমে একজন ভালো শিক্ষাবিদি এবং একই সঙ্গে দক্ষ প্রশাসক উপাচার্য হিসেবে আসুক। এতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব অংশীজনের উপকার হবে। দুটি গুণই অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের মধ্যে বিদ্যমান।’
এ ছাড়াও উপাচার্যের দৌড়ে পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক অজিত কুমার মজুমদারকে এগিয়ে রাখছেন কেউ কেউ। তিনি বর্তমান উপাচার্যেরও ঘনিষ্ঠজন এবং বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের সভাপতি। তবে গত ২৪ জুন সিনেট অধিবেশনে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তাঁর একটি বক্তব্য নানা সমালোচনার জন্ম দেয়। পত্রিকায় ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলে বেশ কিছুদিন। এ ঘটনার পরে রাজনীতিতে তিনি কিছুটা পিছিয়ে পড়েছেন শিক্ষক সমিতির ছয়বারের নির্বাচিত এই সভাপতি৷ তবে, তিনি নূরুল আলমপন্থি প্যানেল থেকে নির্বাচন করবেন বলে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এদিকে, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচন নিয়ে অনেকটা বেখেয়াল বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম। অধ্যাপক ফারজানা গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আছি। তাঁরা আমাকে এখন আর সেভাবে ডাকেন না। তবে, ডাকলে আমি সাড়া দেব। আমার জায়গা থেকে তাঁদের পরামর্শ দেব, যাতে তাঁরা বিভক্ত না হয়ে চেতনার জায়গায় অটল থাকেন।’
অধ্যাপক ফারজানা আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের কিছু নেতা যদি মনে করেন, দলের আদর্শ ও চেতনাকে সমুন্নত রাখতে পদত্যাগ করা বাঞ্ছনীয়, তবে পদত্যাগ করাই শ্রেয়। ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে নিজের আদর্শকে সুমহান মর্যাদায় সমুন্নত রাখা যায়।’
ধারণা করা হচ্ছে, ফারজানা ইসলামপন্থি কিছু শিক্ষক আলাদা প্যানেল থেকে নির্বাচন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের পূর্ণ সমর্থন পাবেন না নূরুল আলমপন্থি প্যানেল। এদিকে নির্বাচন বানচালেরও অভিযোগ উঠেছে ফারজানাপন্থি শিক্ষকদের বিরুদ্ধে।
ফারজানা ইসলামপন্থি বলে পরিচিত বর্তমান কোষাধ্যক্ষ ও নৃবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক রাশেদা আখতার প্যানেল নির্বাচন করতে পারেন বলে জানা গেছে। নির্বাচন করতে পারেন বর্তমান প্রভোস্ট কমিটির সভাপতি অধ্যাপক আব্দুল্লাহ হেল কাফি ও অধ্যাপক মোহা. মুজিবুর রহমান। তবে, তাঁরা একই প্যানেল থেকে নাকি আলাদা কোনো প্যানেল থেকে নির্বাচন করবেন, তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়নি।
আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের নিয়ে একটি প্যানেলে নির্বাচনের গুঞ্জন থাকলেও এই সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিচ্ছেন অনেকে। ‘বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী প্রগতিশীল শিক্ষক সমাজ’-এর এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক বলেন, ‘আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের নিয়ে এক প্যানেলে অথবা আলাদা আলাদা প্যানেলেও নির্বাচন হতে পারে। কোনকিছুই এখনও ফিক্সড না। সিনিয়র সদস্যরা এটা ঠিক করবেন।’
তবে মোটাদাগে মোট তিনটি প্যানেলে নির্বাচন হতে পারে—সেই আভাসই পাচ্ছেন উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ভোটার সিনেট সদস্যেরা। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমপন্থি প্যানেল, সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরপন্থি প্যানেল এবং ফারজানা ইসলামপন্থি প্যানেল থেকে নির্বাচন হতে পারে।
দীর্ঘ আট বছর পর উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের মাধ্যমে জাবিতে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে বলে আশাবাদী ছাত্র-শিক্ষক ও সিনেট সদস্যেরা।
সিনেটে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি মেহেদী জামিল বলেন, ‘২০১৭ সালে সিনেট নির্বাচনের পর সিনেট সদস্যেরা বলতে গেলে কোনো কার্যকর সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। তাঁদের সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। অনেকটা বাইপাস সার্জারি করে সিনেটরদের এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু, এবারের নির্বাচনের পর আশা করি বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ ফিরে আসবে। সিনেট সদস্যেরা একজন ভালো মনের ও দক্ষ মানুষকে উপাচার্য হিসেবে নির্বাচিত করবেন৷’
প্রসঙ্গত, উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনে সিনেট সদস্যেরা তাঁদের পছন্দের সর্বোচ্চ তিন জন প্রার্থীর ক্ষেত্রে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন। নির্বাচনে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত তিন জনের প্যানেল মনোনয়ন শেষে তা রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের কাছে পাঠানো হয়। রাষ্ট্রপতি তাঁর ক্ষমতাবলে প্যানেলের যে কাউকে উপাচার্য হিসেবে চার বছরের জন্য মনোনয়ন দেন।
জাবিতে সর্বশেষ সিনেট প্যানেল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। নির্বাচনে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, অধ্যাপক আবুল হাসান এবং অধ্যাপক আমির হোসেন জয়লাভ করেন। সে সময়ে তিন জনই সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরপন্থি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্যের নির্দেশক্রমে অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। প্রথম মেয়াদের চার বছর শেষের আগেই ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় মেয়াদে তাঁকে নিয়োগ দেওয়া হয়। চলতি বছরের ২ মার্চ শেষ হয়েছে মেয়াদকাল। গত ১ মার্চ অধ্যাপক ড. নূরুল আলমকে উপাচার্যের রুটিন দায়িত্বে নিয়োগ দেওয়া হয়। এরপর ১৭ এপ্রিল থেকে উপাচার্যের সাময়িক দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন তিনি।