শিক্ষকে শিক্ষকে দ্বন্দ্ব করে ক্লাস-পরীক্ষার ‘প্রাণ যায়’
নতুন ভবনে স্থান বরাদ্দ এবং এক বিভাগের সভাপতির পদত্যাগ দাবিকে কেন্দ্র করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি বিভাগের অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এর মধ্যে স্থান বরাদ্দকে কেন্দ্র করে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিইসি) ও ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগ এবং সভাপতির পদত্যাগ দাবিকে কেন্দ্র করে জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ রেখেছেন শিক্ষকরা।
বিজ্ঞান ভবনে স্থান বরাদ্দকে কেন্দ্র করে সিইসি ও ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগের মধ্যে সমস্যার সূত্রপাত। এর জেরে সমস্যা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্টকালের জন্য সব শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেছে বিভাগ দুটি। এতে সেশনজটসহ নানা শঙ্কায় পড়েছেন শিক্ষার্থীরা।
চলমান সংকট সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দফায় দফায় আলোচনা করেও কোনো সমাধানে পৌঁছাতে পারেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, প্রভাবশালী বিভাগীয় শিক্ষকদের কাছে কার্যত অসহায় হয়ে পড়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। গত শুক্রবার সন্ধ্যায় স্থান বরাদ্দকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত সমস্যা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বৈঠক করলেও কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয় বৈঠকটি।
জানা গেছে, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বৃহস্পতিবার ভোরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল সংলগ্ন নতুন বিজ্ঞান ভবনের তৃতীয় তলায় আসবাবপত্র তুলে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করেন পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগ। তখন ভূ-তাত্ত্বিক বিজ্ঞান ও সিএসই বিভাগের শিক্ষার্থীরা পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের ভবনে প্রবেশে বাধা দেয়।
পরে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগকে ভবন থেকে বের করে দেওয়ার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করে শিক্ষার্থীরা। এর কিছু পর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম ভবনে ঢুকতে চাইলে বাধা দেন শিক্ষার্থীরা। ভবনে ঢুকতে ব্যর্থ হয়ে একপর্যায়ে ফিরে যান উপাচার্য।
এরপর শিক্ষার্থীদের দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে ভূ-তাত্ত্বিক বিজ্ঞান ও সিইসি বিভাগের সব শিক্ষা কার্যক্রম গত শনিবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রাখার ঘোষণা দেন শিক্ষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভবনের জায়গা বরাদ্দ নিয়ে দুই বিভাগের প্রভাবশালী দুই শিক্ষকের মধ্যে ‘ইগোর যুদ্ধ’ চলছে। পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের পক্ষে লড়ছেন শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক খবির উদ্দিন এবং সিইসি বিভাগের পক্ষে লড়ছেন সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ হানিফ আলী। প্রভাবশালী দুই শিক্ষকের আধিপত্য বিস্তারের এ লড়াই দফায় দফায় মিটিং করেও সমাধান করতে পারছে না বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
আগামীকাল মঙ্গলবার দুপুর ১টার মধ্যে সমস্যা সমাধানে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে যৌথভাবে আলটিমেটাম দিয়েছে সিইসি ও ভূতাত্ত্বিক বিজ্ঞান বিভাগ। আজ সোমবারও এ ভবনের প্রথম থেকে তৃতীয় তলা পর্যন্ত বরাদ্দপূর্বক হস্তান্তরের দাবিতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল ও প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে দুটি বিভাগই। পরে উপাচার্যের সাথে দেখা করে আগামীকাল মঙ্গলবার দুপুর ১টার মধ্যে এ সমস্যা সমাধানের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেন তাঁরা।
বিষয়টি নিয়ে সভায় অংশগ্রহণকারী সিইসি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু সাঈদ মো. মোস্তাফিজুর রহমান এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘উপাচার্যের সাথে দেখা করে দুপুর ১টার মধ্যে এ সমস্যা সমাধানের আলটিমেটাম জানাতে গিয়েছিলাম। আমরা বলেছি, এর মধ্যে সমাধান না হলে মঙ্গলবার দুপুর ১টার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করা হবে। পরে তা গোটা ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়বে।’
সিইসি বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ হানিফ আলী বলেন, ‘আমরা বরাবরই শিক্ষার্থীদের প্রতি সহানুভূতিশীল। এটা তো গোটা বিভাগেরই সংকট। আমরা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলেছি, ডাবল ক্লাস নিয়ে বা আরো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে ক্ষতি পোষানোর চেষ্টা করা হবে।’
অন্যদিকে জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সভাপতির পদত্যাগ দাবিতে ক্লাস পরীক্ষা বন্ধ রেখেছেন বিভাগের বাকি তিন শিক্ষক। শনিবার তার প্রতি অনাস্থা জানিয়ে ভিসিকে লিখিত অভিযোগ দেন তাঁরা। পদত্যাগ না হওয়া পর্যন্ত শিক্ষকরা সব ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ঘোষণা দেন। লিখিত অভিযোগে বিভাগের সভাপতি আমিনা ইসলামের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে তাঁর পদত্যাগ দাবি করেন।
আজ সোমবার বিভাগে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় প্রথম বর্ষের চূড়ান্ত পরীক্ষার ‘বাংলা রাইটিং স্কিলস্’ শিরোনামের ১০৫ নং কোর্সের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও শিক্ষকদের আন্দোলনের কারণে তা হয়নি। একই সাথে এ বর্ষের মৌখিক পরীক্ষাসহ বাকি চারটি লিখিত পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে।
বিভাগের প্রথম বর্ষ পরীক্ষা কমিটির সভাপতি রাকিব আহমেদ বলেন, ‘বিভাগের সব শিক্ষক একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যে, বর্তমান সভাপতি পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা কোনো ক্লাস পরীক্ষায় অংশ নেবেন না। তাই এমন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।’
পরীক্ষা স্থগিতের বিষয়ে জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি আমিনা ইসলাম বলেন, ‘পরীক্ষা কমিটির একজন সদস্য হয়েও এ ব্যাপারে আমাকে কিছু জানানো হয়নি। আর আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো সঠিক নয়।’
তিন বিভাগের অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কী ব্যবস্থা নেবে এমন প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক আবুল হোসেন এনটিভি অনলাইনকে বলেন, ‘এ নিয়ে আলোচনা অব্যাহত আছে। একটি সুষ্ঠু সমাধানের চেষ্টা করছি।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফারজানা ইসলাম বলেন, সিন্ডিকেটের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সবার সাথে আলোচনা করে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হবে।