চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ, করণীয়
ইদানীং চিকুনগুনিয়া জ্বরের নাম অনেক শোনা যাচ্ছে। অনেকেই এই জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই জ্বর অনেকটা ডেঙ্গুর মতো। এটিও মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই জ্বরে অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়।
চিকুনগুনিয়া কী?
চিকুনগুনিয়া ভাইরাসজনিত রোগ। শব্দটি আফ্রিকান। এর অর্থ ‘ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া’। এই রোগ আফ্রিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রোগ হলেও আমাদের দেশের কিছু কিছু এলাকায় এই রোগ পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের অতি পরিচিত ডেঙ্গুর সঙ্গে এর অনেকটাই মিল রয়েছে। চিকুনগুনিয়া মানবদেহ থেকে মশা এবং মশা থেকে মানবদেহে ছড়ায়। ডেঙ্গু জ্বরের মতো এই ভাইরাস এডিস মশার মাধ্যমে হয়।
লক্ষণ
চিকুনগুনিয়ার মূল লক্ষণ হলো জ্বর ও অস্থিসন্ধির ব্যথা। এ সময় দেহের তাপমাত্রা অনেকটা বেড়ে যায়। প্রায়ই ১০৪ ডিগ্রি পর্যন্ত উঠে যায়। তবে কাঁপুনি বা ঘাম হয় না। জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ জ্বালা করা, গায়ে লাল লাল র্যাশ, অবসাদ, অনিদ্রা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দিতে পারে।
এ ছাড়া শরীরের বিভিন্ন জায়গায়, বিশেষ করে অস্থিসন্ধিতে তীব্র ব্যথা হয়। এমনকি ফুলেও যেতে পারে। জ্বর সাধারণত দুই থেকে পাঁচ দিন থাকে। এরপর নিজে থেকেই ভালো হয়ে যায়। তবে তীব্র অবসাদ, পেশিতে ব্যথা, অস্থিসন্ধির ব্যথা ইত্যাদি জ্বর চলে যাওয়ার পরও কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে, এমনকি মাসের পর মাসও অস্থিসন্ধিতে প্রবল ব্যথা হয়। এমনকি ফুলেও যেতে পারে। এতে রোগীর সাধারণত কাজকর্ম করতে অসুবিধা হয়। রোগী ব্যথায় এতই কাতর হয় যে হাঁটতে কষ্ট হয়। সামনে বেঁকে হাঁটে। স্থানীয়ভাবে কোথাও কোথাও তাই একে 'ল্যাংড়া জ্বর' বলা হয়।
দেখা গেছে, রোগীর বয়স যত বেশি, তার রোগের তীব্রতাও তত বেশি হয় এবং উপসর্গগুলো, বিশেষ করে শরীর ব্যথাও তত বেশি দিন ধরে থাকে। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সাধারণত এত দীর্ঘ সময় ধরে শরীর ব্যথা বা অন্য লক্ষণগুলো থাকে না। ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মূল সমস্যা হলো শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ। এটি অনেক সময় খুব ভয়াবহ হতে পারে। কিন্তু চিকুনগুনিয়া জ্বরে ডেঙ্গুর মতো রক্তক্ষরণ হয় না এবং রক্তের প্লাটিলেট সাধারণত খুব কমে না।
এই রোগে আক্রান্ত হলে কেউ মারা যায় না। শুধু দীর্ঘদিনের জন্য অনেকেই স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলতে পারে। ডেঙ্গু জ্বরে চারবার আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে চিকুনগুনিয়া একবার হলে সাধারণত আর হয় না।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
চিকুনগুনিয়া সন্দেহ হলে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে তা নিশ্চিত হওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে রোগীর রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি দেখা হয়। এতে ২ থেকে ১২ দিন লাগতে পারে। রোগীর আর্থিক সামর্থ্য না থাকলে শুধু শুধু এই পরীক্ষা করার কোনো দরকার নেই। কারণ, এতে চিকিৎসার ক্ষেত্রে তেমন লাভ হবে না।
চিকিৎসা
চিকুনগুনিয়া জ্বরের কোনো প্রতিষেধক নেই। এর চিকিৎসা মূলত রোগের উপসর্গগুলো নিরাময় করা। রোগীকে সম্পূর্ণ বিশ্রামে রাখতে হবে। প্রচুর পানি বা অন্যান্য তরল খেতে দিতে হবে। জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধই যথেষ্ট। এর পাশাপাশি পানি দিয়ে শরীর মুছে দিতে হবে। তীব্র ব্যথার জন্য ভালো ওষুধ প্রয়োজন হতে পারে। তবে এসপিরিন না দেওয়াই ভালো। ক্লরোকুইন এই রোগের উপশম করে বলে কেউ কেউ দাবি করছেন।
রোগীকে আবার যেন মশা না কামড়ায়, এ জন্য রোগীকে মশারির ভেতরে রাখাই ভালো। কারণ, আক্রান্ত রোগীকে মশায় কামড় দিয়ে কোনো সুস্থ লোককে সেই মশা কামড় দিলে, সেই ব্যক্তিও এই রোগে আক্রান্ত হবেন।
প্রতিরোধ
চিকুনগুনিয়ার জন্য কোনো ভ্যাক্সিন বা টিকা নেই। তাই প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হলো এডিস মশা প্রতিরোধ।
- বাড়ির আশপাশে যেখানে পানি জমে থাকতে পারে, সেটি সরিয়ে ফেলতে হবে অথবা নিয়মিত পরিষ্কার রাখতে হবে।
- ডাবের খোসা, কোমল পানীয়ের ক্যান, ফুলের টব—এসব স্থানে যাতে পানি জমে না থাকে, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। মজা পুকুর বা ডোবা পরিষ্কার করতে হবে।
- ডেঙ্গু জ্বরের বেলায় স্বচ্ছ, পরিষ্কার পানিতে এডিস মশা বংশবিস্তার করে। তবে চিকুনগুনিয়াতে মশা নোংরা ও অপরিষ্কার পানিতেও ডিম পাড়তে পারে। তাই পানি জমে থাকে এমন জায়গা পরিষ্কার রাখতে হবে।
- এ ছাড়া মসকুইটো রিপেলেন্ট ব্যবহার করা যেতে পারে।
- বাইরে যাওয়ার সময় শরীর ভালোভাবে ঢেকে রাখতে হবে, যাতে মশা কামড়াতে না পারে।
- ঘরে ঘরে মশার ওষুধ দেওয়া, দরজা-জানালায় নেট লাগানো, রাতে মশারি ব্যবহার ইত্যাদি করতে হবে। তবে জেনে রাখা ভালো, এডিস মশা মূলত দিনের বেলা এবং ঘরের বাইরেই বেশি কামড়ায়।
লেখক : ডিন, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।