সন্তান না হওয়ার কারণ
ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যত্ব এটি একটি গুরুতর সমস্যা। আমাদের দেশে এমন অনেক দম্পতি আছে যাদের ইচ্ছা থাকলেও সন্তান হয় না। বর্তমানে এই রোগের অনেক চিকিৎসা তৈরি হয়েছে এবং বাংলাদেশে এর অনেক ভালো চিকিৎসাও হচ্ছে। আজ মঙ্গলবার (১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৪৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ল্যাবএইড ফার্টিলিটি সেন্টারের সাবেক সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. এম এম মোরতায়েজ আমিন।
প্রশ্ন : ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যত্ব বিষয়টি কী এবং সেখানে নারীর অবস্থান কোথায়?
উত্তর : যদি এক বছর কোনো দম্পতি একসাথে থাকেন এবং কোনোরকম বাধা ছাড়া (প্রোটেকশন) শারীরিক মেলামেশা করে, এরপরও যদি তাদের সন্তান না হয় তাহলে আমরা বলতে পারি তারা ইনফার্টিলিটি বা বন্ধ্যত্ব সমস্যায় ভুগছে।
প্রশ্ন : এদের মধ্যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি কী এবং বিশেষ করে নারী পুরুষ ভেদটা কেমন?
উত্তর : নারী-পুরুষ এখন সমানভাবেই এই সমস্যার জন্য দায়ী বা ভুক্তভোগী। ১০০ জন নিঃসন্তান দম্পতির মধ্যে ৫০টি দম্পতির ক্ষেত্রে পুরুষের সমস্যা আর বাকি ৫০টি দম্পতির ক্ষেত্রে নারীর সমস্যা হয়ে থাকে। এর মধ্যে দুজনেরই সমস্যা আছে এমন দম্পতি রয়েছে ১২ থেকে ১৫ শতাংশ। বর্তমানে মানুষের এ ব্যাপারে সচেতনতা বেড়েছে, ডাক্তারের সংখ্যা বেড়েছে, প্রযুক্তি উন্নত হচ্ছে তারপরও বাংলাদেশে সমস্যাটি বাড়ছে দিন দিন। এর কিছু কারণও রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো বাংলাদেশের এখন ৭০ লাখেরও বেশি মানুষ দেশের বাইরে থাকে। এরমধ্যে ৩০ লাখ মানুষ এমন যারা দু-এক বছর পরপর দেশে আসে, থাকে, আবার চলে যায়। তারা এসেই বিয়ে করে, বিয়ে করে কিছুদিন থেকে আবার চলে যায়। অনেকদিন পর এসে এক মাস বা দুই মাস থাকে। আমি যেমন বলেছি, কম করে হলেও এক বছর একসাথে থাকতে হবে এবং বাচ্চা নেওয়ার চেষ্টা করতে হবে। সেটা হয় তো আর হয় না। হয় তো দেখা যাচ্ছে তাদের কোনো সমস্যা নেই। এই দূরে থাকাটাই তখন সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।
প্রশ্ন : অনেক সময় পরীক্ষা করে স্বামী-স্ত্রী কারোই সমস্যা পাওয়া যাচ্ছে না কিন্তু সন্তান হচ্ছে না- এর কারণ কী?
উত্তর : প্রায় ১০ শতাংশ মানুষের ক্ষেত্রে দেখা যায় কোনো সমস্যা নেই তারপরও সন্তান হচ্ছে না। পৃথিবীর সব দেশেই এ ধরনের সমস্যার জন্য পরীক্ষা করা হয়। প্রায় একই ধরনের পরীক্ষা থাকে। সেগুলোতে কারোটা ধরা পড়ে আর কারোটা ধরা পড়ে না। এর মধ্যে কোনো কোনো সমস্যার চিকিৎসা করা যায় আবার কোনো কোনো সমস্যার চিকিৎসা করা যায় না।
প্রশ্ন : নারীরা প্রধানত কী কারণে বন্ধ্যত্বের সমস্যায় ভোগে থাকে?
উত্তর : আমার নিজস্ব একটা মত রয়েছে এ ব্যাপারে। হয় তো অনেকেই আমার কথাটি নাও মানতে পারে। সেটা হলো পলিসিস্টিক ওভারি একটা কারণ হতে পারে। আমি মনে করি, ফলিকুলার সিনড্রম নামে একটি সিনড্রম রয়েছে, যেখানে নারীদের মাসিক নিয়মিতই হচ্ছে, অন্য সবকিছুই স্বাভাবিক, কিন্তু ওই সিন্ড্রমের ফলে যে ডিমটি বের হবে সেই ডিম বের হচ্ছে না এবং এটার হার ২৫ থেকে ৩৫ শতাংশ। যেখানে পলিসিস্টিক ওভারির শতাংশ অনেক কম। তাই সিনড্রম একটা বড় কারণ হতে পারে যা আমরা হয়তো খেয়াল করছি না। আর দ্বিতীয় হচ্ছে পিসিও(পলিসিস্টিক ওভারি) যেখানে অনেক সিস্ট হয় যে সিস্টগুলো পরিণত হয়ে ফেটে ডিম বের হয়। অনেকের এই সিস্ট পরিণত হয়ে ফেটে ডিমে বের হয় না তখনই সন্তান ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে সে। আরেকটা বড় কারণ হচ্ছে, ইউটেরাস যেখানে বাচ্চা থাকে বা বড় হয় সেটার দুই পাশে দুটি নল থাকে আমরা সেটাকে ফেডোপেন টিউব বলে থাকি। এই ফেডোপেন টিউব ওভারির কাছাকাছি গিয়ে শেষ হয়। ওভারি থেকে ডিম ফেডোপেন টিউবে আসে। সেখানে স্পার্ম গিয়ে ফার্টিলাইজেশন করে। অনেক সময় এই ফেডোপেন টিউব বন্ধ হয়ে যায় আর এটার প্রধান কারণ হলো ইনফেকশন। মেয়েদের ইনফেকশন বেশি হয় এবং অনেকেই ঠিকমতো এর চিকিৎসা করে না। সে কারণে টিউবটা বন্ধ হয়ে যায়। আর এর ফলে ডিম আসতে পারে না আবার স্পার্মও যেতে পারে না। এর ফলে বন্ধ্যত্ব সমস্যা দেখা দেয়।
প্রশ্ন : এই সমস্যার ক্ষেত্রে নারীদের বয়স কোনো প্রভাব ফেলে কি?
উত্তর : মেয়েদের প্রতি মাসে একটা করে ডিম বের হয়। বলা হয়ে থাকে ৩৫ বছররের পর নারীদের এই ক্ষমতা কমতে থাকে। কিন্তু আমি বলব ৩২ বছর পর থেকেই এই সমস্যা শুরু হয়ে থাকে। একটা পরিসংখ্যানের কথা বলি যেখান থেকে সহজেই বুঝে যাবেন বয়সের সাথে ডিমের গুণাগুণ কতটা সম্পর্কযুক্ত। ৩৫ বছর বয়সের মায়েদের ৮০০ সন্তানের মধ্যে ১টা বাচ্চা হবে ডাউন সিনড্রম, যা একটি জেনেটিক রোগ। এই রোগ ভালো হয় না। মায়ের বয়স যদি ৩৮ বছর হয় ডাউন সিনড্রম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে প্রতি ৪০০ জনে একজন, মায়ের বয়স যদি ৪০ হয় ডাউন সিনড্রম প্রতি ২০০ জনে একজন এবং যদি বয়স ৪২ হয় তাহলে প্রতি ১০০টা বাচ্চার মধ্যে একটা ডাউন সিনড্রম হবে। আর যদি বয়স ৪২ এর বেশি হয় তাহলে প্রতি ৫০টা বাচ্চার মধ্যে একটা হবে ডাউন সিনড্রম। আর যাদের সন্তান হয় না তাদের ক্ষেত্রে, ৩৫ বছরের পর প্রথমত ফার্টিলাইজেশন রেট কমে যায়, দ্বিতীয়ত ইনপ্লান্টেশনের রেট কমে যায় অর্থাৎ ভ্রুনটা পাঁচ-ছয়দিন পর এসে ইউটেরাসে জমা হয় তার পরিমাণ কমে যায়। তখন নারীদের বন্ধ্যত্ব সমস্যা দেখা দেয়।
প্রশ্ন : ইনফার্টিলিটি সমস্যা যদি নারীদের ক্ষেত্রে হয় তাহলে এ ক্ষেত্রে কী ধরনের চিকিৎসা রয়েছে?
উত্তর : এ ক্ষেত্রে বলব, একেকজনের সমস্যা একেক ধরনের হয়। আর এর চিকিৎসা পদ্ধতিও একেক রকমের হয়ে থাকে। তাই প্রথমেই জেনে নিতে হবে কী কারণে এ সমস্যা হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা করতে হবে।
প্রশ্ন : ''টেস্টটিউব বেবি'' কি বাংলাদেশের প্রক্ষাপটে সম্ভব?
উত্তর : ''টেস্টটিউব বেবি'' বাংলাদেশে সম্ভব। তবে এ ক্ষেত্রে বলব, সরকারের উচিত একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা। এটা খুবই স্পর্শকাতর একটা ব্যাপার। টেস্টটিউব বেবি সেন্টারের মান কেমন হবে, সেখানে প্রশিক্ষিত ডাক্তার কেমন থাকবে তার ওপর নীতিমালা আরোপ করা দরকার। সেটা ঠিকমতো অভিজ্ঞদের হাতে পরিচালিত হচ্ছে কি না সেদিকেও নজর রাখা উচিত।