হৃদরোগ নির্ণয়
হৃদপিণ্ডের বিভিন্ন ধরনের রোগ নির্ণয়ে এখন নিত্যনতুন ও আধুনিক পদ্ধতি বের হয়েছে। এগুলোর মাধ্যমে খুব সহজেই হৃদরোগ নির্ণয় করা যাচ্ছে। আর বাংলাদেশেও খুব সফলভাবে এই পদ্ধতির ব্যবহার হচ্ছে। আজ বুধবার (২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৫৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শফিউদ্দিন।
প্রশ্ন : হৃদরোগ সাধারণত কী কী ধরনের রয়েছে?
উত্তর : আসলে হৃদরোগ কথাটি শুনলে সাধারণ মানুষের ভেতরে ভীতি কাজ করে। অনেকেই মনে করেন হৃদরোগ মানে হার্ট অ্যাটাক বা হার্টের ব্যথা। আসলে সেটি নয়। একজন মানুষের জীবনের শুরু থেকেই হৃদরোগের সমস্যা হতে পারে। যেমন : একটি শিশুও কিন্তু হৃদরোগ নিয়ে জন্মাতে পারে। যেগুলোকে আমরা বলি কনজিনিটাল হার্টের অসুখ। অর্থাৎ জন্মগত হার্টের ত্রুটি। অর্থাৎ হৃদপিণ্ডের ভেতর যেই ভাগ থাকে, সেই সেপাটামগুলোর মধ্যে ফুটো থাকতে পারে। এ ধরনের কিছু জন্মগত ত্রুটি আছে যেগুলো শিশুকাল থেকে থাকতে পারে।
আমাদের দেশে খুব প্রচলিত একটি রোগ আছে বাতজ্বর বা রিউমেটিক ফিভার। এর থেকেও কিছু কিছু হৃদপিণ্ডের সমস্যা হয় এগুলো মূলত ভাল্ভের সমস্যা। হৃদপিণ্ডের চারটি ভাল্ভ কে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কিশোরদের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি হয়।
পরবর্তী সময়ে রোগীরা যে সমস্যা নিয়ে আসে সেটি হলো স্কেমিক হার্ট ডিজিজ। হৃদপিণ্ডে চর্বি জমে বা ব্লক হয়ে এ সমস্যা তৈরি হয়। এর বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। এর মধ্যে কিছু কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পায়। কিছু ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পায় না।
মূলত শিশুকাল থেকে এবং বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন হৃদরোগ রয়েছে। এ ছাড়া কিছু হৃদরোগ রয়েছে যেগুলো ভাইরাসের কারণে হয়। এ ক্ষেত্রে ভাইরাল মায়ো ক্যাডাডিস, স্পেনিক্যাডাডিস হয়। হার্টের পর্দার নিচে পানি জমতে পারে। এ ধরনের সমস্যা হয়।
প্রশ্ন : রোগ নির্ণয়ের আধুনিক কী ধরনের পদ্ধতি রয়েছে?
উত্তর : প্রথমেই রোগ নির্ণয়ের জন্য যেটি হয় সেটি ইসিজি। অনেক রোগীই দেখা যায় আমাদের চেম্বারে আসার আগে হার্টের সমস্যা হলে ইসিজি করে নিয়ে আসেন। এটি খুব গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এটাকে আমরা বলি ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম। অর্থাৎ হার্ট যে পাম্প করছে তার ইলেকট্রিক্যাল একটিভিটি আমরা বাইরে থেকে মেশিন দিয়ে রেকর্ড করি। এটা হার্টের অসুখ নির্ণয়ে খু্ব সহোযোগী। যদি কারো হার্ট অ্যাটাক হয় তখন এর গ্রাফটি সাধারণ গ্রাফের থেকে বদলে যায়। এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি হার্ট অ্যাটাক হয়েছে কি না। স্কেমিয়া হয়েছে কি না। আবার কোনো কোনো রোগ আছে এরিডমিয়া অর্থাৎ হৃদপিণ্ডের ছন্দপতন। হার্টের যে নিয়মিত ছন্দ রয়েছে সেটিতে ব্যঘাত ঘটে। ছন্দপতন হয়ে স্পন্দন (বিট) কমে যেতে পারে । আবার বেড়ে যেতে পারে। অনিয়মিত স্পন্দনও হতে পারে। এটিও ইসিজি দিয়ে খুব সহজে নির্ণয় করা যায়। তবে ইসিজি করলেই সব রোগ ধরা পড়ে না।
প্রশ্ন : তাহলে আর কী কী রয়েছে যেগুলো ইসিজিতে ধরা পড়ছে না?
উত্তর : এর পর রয়ছে এক্স-রে । এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি। হার্টের সাইজ ঠিক আছে কি না। হৃদপিণ্ড খুব বেশি বড় হয়ে গেছে কি না। এর মধ্যে কোনো পানি জমছে কি না। হার্টে পানি জমলে সেটি ইসিজির মাধ্যমে বোঝা যাবে না। এক্স-রে করতে হবে।
আরেকটি পরীক্ষা করা হয় ইকো কার্ডিওগ্রাম। সংক্ষেপে একে বলা হয় ইকো। এর দ্বারা ভাল্ভের সমস্যা বোঝা যায়। বাতজ্বরের কারণে যে সমস্যা হয়। সেই ভাল্বগুলো চেপে গেছে কি না। হার্টের পাম্প ঠিক মতো হচ্ছে কি না সেগুলো ইকো দিয়ে বোঝা যায়। এ ছাড়া এর মাধ্যমে হার্টের কোনো অংশ যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেটি বোঝা যায়। হার্টের পর্দার নিচে পানি জমেছে কি না সেটি বোঝা যায়। এটি এক ধরনের হৃদপিণ্ডের আলাট্রাসনোগ্রাম। যদি গঠনগত কোনো সমস্যা থাকে সেটি ইকোতে বোঝা যায়।
প্রশ্ন : এছাড়া আমরা ইটিটিও করতে দেখি। ইটিটি মূলত কখন দেওয়া হয়?
উত্তর : আমরা যদি সন্দেহ করি রোগীর স্কেমিক হার্ট ডিজিজ অর্থ্যাৎ করোনারি ধমনিতে কোনো সমস্যা আছে তখন আমরা ইটিটি করতে দেই।
প্রশ্ন : যদি হৃদপিণ্ডে ব্লক দেখা যায় তখন এনজিওগ্রাম করে থাকি। এটি কখন দেওয়া হয়?
উত্তর : সাধারণত হাঁটা চলা করতে গেলে, পরিশ্রম করতে গেলে, সিঁড়ি বাইতে গেলে হার্টটা কেমন চেপে আসে, বুকে ব্যথা করে, গলা চেপে আসে, দম বন্ধ হওয়ার মতো অবস্থা হয়। তখন আমরা অনুমান করি ব্যক্তিটির ব্লক থাকতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আমরা ইটিটি করি। ইটিটি ইসিজিরই একটি অংশ। ইটিটির ক্ষেত্রে হাঁটার মেশিনের মাধ্যমে ব্যায়াম করতে দেই। তখন তার পরিশ্রম করার ক্ষমতা কতটুকু সেটি দেখা হয়। ইটিটির ভিতরে যদি পজিটিভি চলে আসে অর্থাৎ গ্রাফটি খারাপ দেখাচ্ছে তখন আমরা এনজিওগ্রাম করি।
প্রশ্ন : এনজিওগ্রামের মাধ্যমে আপনারা কী নির্ধারণ করেন এবং কী চিকিৎসা দিয়ে থাকেন?
উত্তর : যখন ইটিটি করে পজিটিভ আসে তখন এনজিওগ্রাম করি। এ ছাড়া ইটিটি ছাড়াও এনজিওগ্রাম করা হয়। যদি কারো হার্ট অ্যাটাক হয় সে হয়তো সমস্যাটি বুঝতেই পারল না তখন এটি করা হয়। হার্ট অ্যাটাক সাধারণত দুভাবে হতে পারে। ব্যক্তি হয়তো সুস্থ ছিল, অফিস করছিল হঠাৎ অ্যাটাক হয়ে গেল। আগে কোনো লক্ষণই ছিল না। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তির দীর্ঘ দিন ধরে বুকে চিন চিন করছে। হাঁটতে গেলে কষ্ট হয়। এসময় হঠাৎ করে অ্যাটাক হয়ে গেল।
আবার যখন অ্যাটাকের প্রথমিক লক্ষণ দেখা দেয় তখনো এনজিওগ্রাম করি। অনেকে মনে করে এনজিওগ্রাম মানে একধনের অপারেশন। অনেকের মধ্যে ভীতি কাজ করে। এটি আসলে অপারেশন নয়।
প্রশ্ন : যাদের এনজিওগ্রাম নিয়ে ভীতি কাজ করে তাদের প্রতি আপনাদের কী পরামর্শ রয়েছে?
উত্তর : হার্টের রোগ ধরার পড়ে তখন যদি ওষুধ দিই সেটা রোগীরা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার কথা চিন্তা না করে খায়। কিন্তু এনজিওগ্রাম করতে বললে রোগীরা ভয় পায়। ভাবে বাঁচব কি না। আসলে এনজিওগ্রাম কোনো সার্জারি নয়। বোঝার জন্য বলি, যেকোনো সার্জারিতে কাটতে হয়। কিন্তু এনজিওগ্রামে কাটতে হয় না। শুধু আমরা এখানে উড়ুর সন্ধির ওপর যে ধমনি আছে সেখানে একটি লোকাল এনেসথেসিয়া দিয়ে অবশ করি। সেখান দিয়ে একটি চিকন টিউব বা ক্যাথেডার দিয়ে ভেতরে ঢুকিয়ে হার্টের গোড়ায় নিয়ে বাইরের থেকে কিছু ক্যামিক্যাল দেই। ক্যামিক্যাল দিলে আমরা দেখতে পারি কোথায় কোথায় ব্লক আছে, কতটা ব্লক আছে অথবা কত শতাংশ আছে। এটি কী ওষুধে ভালো হবে নাকি এনজিওপ্লাস্টি লাগবে না ওপেন হার্ট সার্জারি বাইপাস করা লাগবে। রোগ নির্ণয়ের জন্য এই চিকিৎসা পদ্ধতিটি অত্যন্ত জরুরি এবং আধুনিকতম একটি পদ্ধতি।
এটি বাংলাদেশে সফলভাবে করা হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত হচ্ছে। ঢাকা শহরে আরো কিছু হাসপাতালে এগুলোতে হচ্ছে। এ ছাড়া ঢাকার বাইরেও কিছু হাসপাতালে এনজিওগ্রাম চালু হয়েছে।