চোখের চিকিৎসায় লেজারের ব্যবহার
সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও চোখের চিকিৎসায় খুব ভালো পদ্ধতি রয়েছে। আজ শুক্রবার (২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫) এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৫৯তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বাংলাদেশ চক্ষু হাসপাতালের ফ্যাকো ও গ্লুকোমা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. এম নজরুল ইসলাম।
প্রশ্ন : এখন আমাদের দেশে চিকিৎসকরা লেজারের ব্যবহার করছেন, এর পরিস্থিতি কী এবং চোখের কোন কোন ক্ষেত্রে আপনারা লেজারের ব্যবহার করছেন?
উত্তর : চোখের জন্য এখন অনেক অত্যাধুনিক চিকিৎসা রয়েছে, যা লেজারের সাহায্যে করা হচ্ছে। চোখের ছানির সবচেয়ে আধুনিক চিকিৎসা হলো ফেকো সার্জারি। সেটিও এখন লেজারের সাহায্যে করা হচ্ছে। গ্লুকোমা চোখের অন্ধত্বের অন্যতম একটি কারণ। সেখানেও লেজার দিয়ে অনেক চিকিৎসা করা হচ্ছে। অনেক সময় ডায়াবেটিসের কারণে রেটিনার সমস্যায় রক্তক্ষরণ হয়ে অন্ধত্ববরণ করতে হয়। সেখানেও লেজারের সাহায্যে এই অন্ধত্ব প্রতিরোধ করা হচ্ছে।
প্রশ্ন : আসলে লেজার বিষয়টি কী?
উত্তর : লেজারের পূর্ণাঙ্গ রূপ হচ্ছে, লাইট অ্যাম্প্লিফিকেশন বাই স্টিমুলেটেড এমিশন অব রেডিয়েশন। সহজ করে বললে, একটি আলোর শক্তি যখন আসে তখন এটিকে যদি রূপান্তর করে আরেকটি শক্তিতে পরিণত করা যায় সেই শক্তিটি শরীরের জন্য উপকারী, সেটিই লেজার। এর মাধ্যমে এখন অনেক চিকিৎসা করা হচ্ছে। বিভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে এই চিকিৎসাগুলো করা হচ্ছে।
আমরা সবাই মোটামুটি লেসিক নামটির সঙ্গে পরিচিত। এটিও একটি লেজার। এক্সাইমাল লেজারের সাহায্যে আমাদের চোখের যে কর্নিয়া থাকে তার পুরুত্বটা পরিবর্তন করা হচ্ছে। পরিবর্তন করে তার পাওয়ার পরিবর্তন করা হচ্ছে।
পরিবর্তন করে যার মাইনাস ১০ পাওয়ার সেটি হয়তো শূন্যতে নিয়ে আসা যাচ্ছে। তখন সে চশমা ব্যবহার ছাড়াই ভালো হয়ে যাচ্ছে। এই যে পদ্ধতি, এগুলো লেজারের সাহায্যেই হচ্ছে। এই লেজারের নাম হলো এক্সাইমাল লেজার।
প্রশ্ন : চোখে যদি ছানি পড়ে, এর চিকিৎসায় ট্রেডিশনাল পদ্ধতি আছে? এই ট্রেডিশনাল পদ্ধতির সঙ্গে লেজারের পার্থক্য কী?
উত্তর : আমরা যখন একটি ছানি অপারেশন করি, মূল বিষয়টি যেটা থাকে সেটি নেচারাল লেন্স। এটা নষ্ট হয়ে গেছে, ঘোলা হয়ে গেছে। আমাদের এটাকে বের করতে হবে। বের করার পদ্ধতি অনেক রকম রয়েছে। এটাকে বলা হয় এসআইসিএস, ফেক ওইমালসিফিকেশন সার্জারি। এগুলো হলো সবচেয়ে আধুনিক সার্জারি।
প্রশ্ন : এই সার্জারিতে আপনারা কী করে থাকেন?
উত্তর : ফেক ওইমালসিফিকেশন সার্জারিতে, ইনসিশনের ভেতর দিয়ে চোখের লেন্স যেটি রয়েছে তার পর্দা গোল করে পাঁচ-ছয় মিলিমিটার কাটা হয়। ভেতরে লেন্সকে ছোট ছোট টুকরো করে বের করে দিই। পরে ওই জায়গাটিতে আমরা একটি ফোল্ডিং লেন্স বাইরে থেকে ঢুকিয়ে দিচ্ছি। আর ফেক ওইমালসিফিকেশন সার্জারির সঙ্গে লেজারের পার্থক্য হচ্ছে ফেক ওইমালসিফিকেশন আমরা ছুরি বা কাঁচি দিয়ে মানুষের মাধ্যমে (ম্যানুয়ালি) করে থাকি। এটি সব সময় ঠিক নাও হতে পারে। কিন্তু লেজারের মাধ্যমে এই কাটার বিষয়টি সঠিকভাবে করা যায়। লেজার দিয়ে কাটলে ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। তবে পরবর্তী অংশটি ম্যানুয়ালি করা হয়। পার্থক্য হচ্ছে, একটি মানুষ করলে বিষয়টি যতটা ভুল হওয়ার আশঙ্কা থাকবে, লেজারের মাধ্যমে করলে সেটি আর থাকবে না। এই লেজারের ব্যবহার বাংলাদেশে আমরা করছি। এবং এটি করে অনেকেই বেশ ভালো আছেন।
প্রশ্ন : আরেকটি বিষয় আমরা বলি গ্লুকোমা। গ্লুকোমা অনেক উত্তপ্ত (বার্নিং) একটি বিষয়। এটি ছাইচাপা আগুনের মতো, ভেতরে ভেতরে নার্ভটাকে খেয়ে ফেলছে। গ্লুকোমা কী, সেই বিষয়ে একটু বলুন এবং গ্লুকোমা রোগে লেজারের কী ব্যবহার রয়েছে- এ ব্যাপারে কিছু বলুন।
উত্তর : সংক্ষিপ্তভাবে বলতে গেলে চোখের ভেতর একটি প্রেসার বা চাপ থাকে। যে প্রেসারের কাজ হচ্ছে চোখের পুষ্টি ঠিক রাখা। এই চাপ কোনো কারণে বেড়ে গিয়ে এর ভেতরে নার্ভটা, যে নার্ভ চোখ এবং মস্তিষ্কের যোগাযোগ করে (অপটিক নার্ভ) সেটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, শুকিয়ে যায়। সেই রোগটির নাম হলা গ্লুকোমা। এই গ্লুকোমা রোগ যদি হয়, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য হলো চোখের চাপকে কমাতে হবে। কমানোর জন্য আমরা বিভিন্ন চিকিৎসা ব্যবহার করি। প্রথম চিকিৎসা হলো ওষুধ, চোখের ড্রপ। দ্বিতীয় চিকিৎসা লেজার। তৃতীয় চিকিৎসা হলো সার্জারি।
এর মধ্যে লেজারের কাজ হলো চোখের প্রেসারটা কমানো। একটি লেজার রয়েছে এসএলটি। এর কাজ হলো চোখের ভেতর যে জায়গা দিয়ে ফ্লুইটগুলো বের হয়ে যায়, সেই কোণে কিছু পরিবর্তন করা। যাতে করে ফ্লুইটটা খুব সুন্দরভাবে বের হয়ে যেতে পারে। চাপটা কমে যায়। এটি লেজারের একটি ব্যবহার। আরো কিছু ব্যবহার রয়েছে। যেমন- অ্যাঙ্গেল ক্লোজার গ্লুকোমা বলে চোখে একটি রোগ আছে, যেখানে অ্যাঙ্গেলটি বন্ধ হয়ে যায়। সেখানে আমরো যদি চোখের আইরিসের একটি ছোট্ট ছিদ্র করে দিই। যাকে আমরা বলি এলপি আই। তাহলে ব্যক্তিটির হঠাৎ করে চোখের চাপ বেড়ে গিয়ে চোখ অন্ধ হয়ে যাওয়ার যে আশঙ্কা ছিল, সেটি কমে যায়। তাই গ্লুকোমাতে লেজারের খুব ভালো ব্যবহার রয়েছে।
প্রশ্ন : রেটিনার সমস্যায় লেজারের কী ধরনের ব্যবহার রয়েছে?
উত্তর : ডায়াবেটিস যদি কারো অনিয়ন্ত্রিত থাকে, তাহলে তার চোখের ভেতর রেটিনায় কিছু পরিবর্তন হয়। পরিবর্তন হলে রক্তনালিগুলো বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে গেলে তার পাশে যে রেটিনা রয়েছে, তার মধ্যে আর পুষ্টি বা নিউট্রিশন থাকে না। এর ফলে ওখান থেকে তার একটি স্টিমুলেশন ফ্যাক্টর তৈরি হয়। হয়ে সেখান থেকে নতুন নতুন রক্তনালি তৈরি হয় যেটি অস্বাভাবিক। সেগুলা ফেটে যায় এবং রক্তপাত হয়। আমাদের কাজ হলো ওই অস্বাভাবিক জায়গাকে লেজার করে পুড়িয়ে দেওয়া। যাতে করে নতুন রক্তনালি তৈরি হতে না পারে। তাই লেজারের মাধ্যমে রোগটি যেন জটিল না হয়, সেজন্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছি।
সুতরাং যার ডায়াবেটিস থেকে অন্ধত্ববরণের কথা ছিল, সে যদি আগে থেকে লেজার দিতে পারে তাহলে ভালো হয়।
প্রশ্ন : যখনই এ ধরনের আধুনিক কোনো চিকিৎসার বিষয় আসে, তখনই খরচের বিষয়টি মাথায় আসে। যে এটি আমাদের আয়ত্বের ভেতরে কিনা? বাংলাদেশে যে আপনারা করছেন এর খরচ কত পড়ে?
উত্তর : আমাদের দেশে এখন অনেক কম টাকায় এসব চিকিৎসা করা হচ্ছে। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও এটি অনেক কম। যারা এই চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে চান, তারা বিদেশ না গিয়ে এই চিকিৎসা বাংলাদেশে করুন। অনেক কম খরচে করা সম্ভব।