ব্রেইন স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাক কি এক?
মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ বা ব্রেইন স্ট্রোকের কারণে মৃত্যুর হার বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি। কিন্তু অনেকে ব্রেইন স্ট্রোক করলেও মনে করেন হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। তাই হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে ছোটাছুটি করে অনেকে। এতে অনেকটা সময় নষ্ট হয়। এমনকি রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হয়ে যায়। তাই আগে বুঝে নিতে হবে রোগীর ব্রেইন স্ট্রোক হয়েছে না হার্ট অ্যাটাক। এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ১৯৬৩তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল কাদের শেখ।
প্রশ্ন : স্ট্রোক রোগটি কী, এটি কেমন রোগ এবং হৃদরোগের সঙ্গে এর পার্থক্য কোথায়?
উত্তর : অনেক সময় স্ট্রোক করলে হার্ট অ্যাটাক হয়েছে বলে মানুষ ধারণা করে থাকে। তখন তারা হার্টের ডাক্তার মানে হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে যায়। কিন্তু স্ট্রোক শুধু ব্রেইনে হয় এটা অনেকে বোঝে না। আর না বোঝার কারণে রোগী অযথা হয়রানির শিকার হয়। মনে রাখবেন, ব্রেইনে যখন কোনো আঘাত হয় বা ব্রেইনের জন্য প্যারালাইসিস হয়, রক্তনালি বন্ধ হয়ে যায় বা রক্তক্ষরণ হয় তখন এটাকে ব্রেইন স্ট্রোক বলে। দুটি আসলে সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়। তাই আমরা এখন চেষ্টা করছি যে স্ট্রোক শব্দটি না বলে ব্রেইন অ্যাটাক বলতে। এর উদ্দেশ্য হলো যাতে মানুষ বুঝতে পারে যে তার হার্ট অ্যাটাক হয়ছে তাকে হার্টের ডাক্তারের কাছে যেতে হবে অথবা তার ব্রেইন অ্যাটাক হয়েছে তাঁকে ব্রেইনের ডাক্তার মানে নিউরোলোজিস্টের কাছে যেতে হবে অথবা নিওরো সার্জেন্টদের কাছে যেতে হবে।
আসলে ব্রেইন স্ট্রোক বলেই এই শব্দ সবার কাছে পরিচিত। কিন্তু যদি এটাকে ব্রেইন অ্যাটাক হিসেবে সবার কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয় তাহলে দুটো রোগের পার্থক্য সবাই বুঝতে পারবে। কারণ ব্রেইন স্ট্রোক হলে যদি হার্টের ডাক্তারের কাছে যাওয়া হয় তাহলে অনেক দেরি হয়ে যেতে পারে। ব্রেইন স্ট্রোক হওয়ার তিন ঘণ্টার মধ্যে একটি বিশেষ থেরাপি রয়েছে, যা দেওয়া হলে সাথে সাথেই একেবারে সুস্থ হয়ে যেতে পারে রোগী। কিন্তু এটি তিন ঘণ্টার মধ্যেই দিতে হবে। তাহলে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকবে।
প্রশ্ন : ব্রেইন স্ট্রোকের লক্ষণ কী?
উত্তর : যখন দেখবেন, কোনো মানুষের একপাশ হঠাৎ করেই প্যারালাইজড হয়ে গেছে অথবা কোনো অঙ্গ একেবারেই দুর্বল হয়ে গেছে বা কথা জড়িয়ে গেছে বা মুখটা একটু বাকা হয়ে গেছে তখন বুঝবেন তার স্ট্রোক বা ব্রেইন অ্যাটাক হয়েছে। তখন তাৎক্ষণিকভাবে যেকোনো নিওরোলোজিস্টের কাছে নিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন : হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ কী?
উত্তর : যখন দেখবেন কারো প্রচণ্ড বুকে ব্যথা হচ্ছে, ঘামাচ্ছে, বমি হচ্ছে, শ্বাসকষ্ট হচ্ছে তখন বুঝবেন তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে এবং তাঁকে হার্টের ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।
প্রশ্ন : কোন জিনিসগুলো একজন মানুষের স্ট্রোকে আক্রান্ত হওয়ার জন্য ঝুঁকি বাড়ায় এবং কেন একজন মানুষ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়?
উত্তর : স্ট্রোকের প্রধান এবং এক নম্বর ঝুঁকি হলো বয়স। যত বেশি বয়স হবে তত তাঁর স্ট্রোকের ঝুঁকি বেড়ে যাবে। দুই নম্বরে রয়েছে হাইপার টেনশন, তিন নম্বরে রয়েছে ডায়াবেটিস, চার নম্বরে রয়েছে হার্টের অসুখ, পাঁচ নম্বরে রয়েছে ধূমপান, ছয় নম্বরে রয়েছে অ্যালকোহলজনিত সমস্যা, সাত নম্বরে দেখা যায় যাদের চর্বি বেশি সে কারণে তাদের স্ট্রোক হয়।
প্রশ্ন : গড় আয়ু বাড়লেও এর সঙ্গে যেন স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি না বাড়ে সেজন্য করণীয় কী?
উত্তর : কারো ব্লাড প্রেসার বেশি থাকলে সে প্রেসার কন্ট্রোলে রাখবে, ডায়াবেটিস থাকলে সে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখবে, ধূমপান করলে ছেড়ে দিতে হবে, প্রতিদিন ব্যায়াম করতে হবে, ফল ও সবুজ শাকসবজি বেশি করে খেতে হবে, একটা শৃখ্লতার মধ্যে জীবনযাপন করতে হবে। জীবনযাপন প্রণালিতে পরিবর্তন এনে এবং এই বিষয়গুলো মেনে চললে মানুষের গড় আয়ু বাড়বে, সুস্থ থাকবে, ব্রেইন স্ট্রোকও কমে যাবে এবং হার্ট অ্যাটাকের আশঙ্কাও থাকবে না।
প্রশ্ন : স্ট্রোক করলে কি কোনো প্রথমিক চিকিৎসা রয়েছে?
উত্তর : স্ট্রোকের আসলে কোনো প্রাথমিক চিকিৎসা নেই। তবে যদি কোনো রোগী জেলা পর্যায়ে কোনো হাসপাতালে থাকে যেখানে সিটিস্ক্যানের কোনো ব্যবস্থা নেই, ব্রেইন পরীক্ষা করার যন্ত্রপাতি নেই তাহলে ইচ্ছা করলে সাথে সাথেই তাকে সংশ্লিষ্ট কিছু ওষুধ খাওয়াতে পারেন। কারণ আমরা জানি ৮৫ ভাগ ক্ষেত্রে রক্ত জমাট বাঁধার কারণে স্ট্রোক হয়ে থাকে। আর ১৫ ভাগ ক্ষেত্রে রক্ত ক্ষরণ হওয়ার জন্য স্ট্রোক হয়ে থাকে। যার প্রেসার বাড়ার কারণে স্ট্রোক হয়েছে তাকে প্রেসার কমানোর ওষুধ খাওয়াতে হবে, ডায়াবেটিস রোগীদের ডায়াবেটিস কন্ট্রোলের ওষুধ খাওয়াতে হবে। এটি হাসপাতালে যাওয়ার পথে চাইলে করতে পারেন। এতে কিছুটা হলেও ঝুঁকি কম থাকবে।
প্রশ্ন : হাসপাতালে নেওয়ার পর এর কী ধরনের চিকিৎসা করা হয়?
উত্তর : হাসপাতালে নেওয়ার পর তাকে তাড়াতাড়ি নিউরোলোজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট করা হয়, তার সিটিস্ক্যান করা হয়, সেখানে কি রক্ত জমাট বেঁধেছে না রক্তক্ষরণ হয়েছে সেটা দেখা হয়, তার এয়ারওয়ে কেমন আছে, সারকুলেশন কেমন আছে, ব্লাড প্রেসার কেমন আছে সেগুলো দেখা হয়। এরপর যদি না খেতে পারে তাহলে তাড়াতাড়ি নরম ভাত দেওয়া, যদি ইউরিন বন্ধ থাকে তাহলে সেটা বের করার ব্যবস্থা করা, ডায়াবেটিস থাকলে সেটার ওষুধ, প্রেসার থাকলে প্রেসারের ওষুধ, রক্ত জমাটবাঁধা থাকলে ব্লাড থিনারের ওষুধ দেওয়া হয়ে থাকে। ফিজিওথেরাপিসহ অন্যান্য সাপোর্ট তাদের দেওয়া হয়ে থাকে। তখন আমরা নির্ধারণ করি তার মেডিকেল ট্রিটমেন্ট লাগবে না সার্জিক্যাল ট্রিটমেন্ট লাগবে। যাদের অনেক বড় স্ট্রোক হয় অর্থাৎ যদি তাদের রক্ত জমাটবাঁধা স্ট্রোক হয় তাহলে এক ধরনের সার্জারি করা হয় এবং রক্তক্ষরণ হয়ে স্ট্রোক হলে তখন তাকে আরেক ধরনের অপারেশন করে রক্তটা বের করতে হয়। এ ধরনের আরো অনেক উন্নতমানের চিকিৎসা এখন বাংলাদেশে করানো সম্ভব। মনে রাখবেন, স্ট্রোক হলে তাড়াতাড়ি চিকিৎসা নিলে মৃত্যুর আশঙ্কা অনেক কম থাকে।