অন্য তারা
‘রঙ’ নিয়ে রঙিন বিপ্লব সাহা
ইদানীংকালের ছেলেমেয়েরা দেশীয় ঐতিহ্যের পোশাক পরতেই বেশি পছন্দ করেন। আর এই দেশীয় ঐতিহ্য ও ঢঙের পোশাক তৈরিতে অগ্রগামী প্রতিষ্ঠানের নাম রঙ। প্রতিষ্ঠানটিকে তিলে তিলে যিনি রঙিন থেকে রঙিনতর করে তুলেছেন, তিনি বিপ্লব সাহা। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন ‘রঙযাত্রার’ কাহিনী।
স্মৃতিকথা
১৯৭১। সালটা ছিল যুদ্ধের। বিপ্লব সাহা তখন তাঁর মায়ের পেটে ধীরে ধীরে বড় হচ্ছেন। প্রাণ বাঁচাতে তাঁর মায়ের ছুটতে হয়েছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে, এক জেলা থেকে অন্য জেলায়। সঙ্গে ছিলেন তাঁর বাবা, দুই ভাই ও তিন বোন। শুধু গর্ভে থাকা সন্তানের প্রাণ বাঁচানোর জন্য বিপ্লব সাহার মা কতই না কষ্ট করেছেন। হেঁটেছেন মাইলের পর মাইল, এমনকি নৌকাতেই ঘুমাতে হয়েছে তাঁকে। অবশেষে পহেলা ডিসেম্বর আগরতলাতেই জন্ম হয় রঙের মানুষ বিপ্লব সাহার। যুদ্ধ শেষে সবাই আবার ফিরে আসে সোনার বাংলাদেশে। বাবার ব্যবসার কারণে মূলত ছোটবেলা থেকেই নারায়ণগঞ্জে বসবাস। একান্নবর্তী পরিবারে বেড়ে ওঠা বিপ্লব সাহা ছিলেন পরিবারের সবার ছোট।
রঙের প্রতি ভালোবাসা
ঢাকায় তাঁর বিস্তর ব্যবসা থাকা সত্ত্বেও শুধু রঙের টানে, মাটির টানে বিপ্লব সাহা এখনো নারায়ণগঞ্জেই থাকেন। ফ্যাশন ডিজাইনার বা ফ্যাশন উদ্যোক্তা যা-ই বলি না কেন, হয়তো মাটির প্রতি ভালোবাসার কারণেই বিপ্লব সাহা আজও ঠিক আগের মতোই রঙিন। আর হবেই বা না কেন, শিল্পী বলে কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে প্রথম শ্রেণি পাওয়া স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বিপ্লব সাহা। তবে এর আগে থেকেই তিনি বিয়ের আলপনা আঁকতেন, হলুদ ও বিয়ের মঞ্চ বানাতেন। এমনকি কনেও সাজাতেন। আর সেই থেকেই রং ও নকশার প্রতি তাঁর ভালোবাসা জন্ম নেয়। ঠিক তখনই ঠিক করেন বাণিজ্যিকভাবেও তাঁর এই প্রতিভাকে কাজে লাগাবেন। পিছুটান, অসহনীয় কষ্ট সবকিছুই সঙ্গী ছিল, কিন্তু নিজের মনোবল, প্রবল ইচ্ছা আর রঙের প্রতি ভালোবাসার কারণেই আজ তিনি রঙের মানুষ বিপ্লব সাহা।
রঙের বেড়ে ওঠা
রঙ আর বিপ্লব সাহা একই সূত্রে গাঁথা। হাজারো বাধা-বিপত্তিকে পেছনে ফেলে একই সঙ্গে দুজন ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। বেড়ে ওঠার পথটিও কি রঙিন ছিল, এমন প্রশ্নের উত্তরে বিপ্লব সাহা বলেন, ‘নারায়ণগঞ্জ শহরে দোকান পাওয়া তখন খুব একটা সহজ ছিল না। চাষাঢ়া মোড়ে সান্ত্বনা মার্কেট নামে নতুন একটি মার্কেটের নিচতলায় ১০০ বর্গফুটের দোকান নিয়ে ১৯৯৪ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘রঙ-চারুকারু কেন্দ্র’ চালু করি। সঙ্গে ছিল বন্ধু মামুন আল কবির, জাকিরুল হায়দার আর চারুকলার ছাত্র সৌমিক দাস। তখনকার সময়ে এক হাজার টাকা দোকান ভাড়া দিতাম। সারা দিন আমার আর সৌমিকের চারুকলায় ক্লাস থাকত। সেই সময়টা দোকানে থাকত জাকিরুল ও মামুন। আর আমরা বিকেলের দিকে দোকানে আসতাম। স্থানীয় একটি চারুকলা শিক্ষাকেন্দ্রে আমি ছবি আঁকার কাজ শুরু করি। আর সেই স্কুলের শিক্ষার্থীদের জন্য আঁকার সরঞ্জাম রাখতাম রঙের দোকানে।
একদিন জাকিরুলের ভাবি আমাদের কয়েকটি টাইডাই করা শাড়ি দিলেন। তবে সেটা শর্ত প্রযোজ্য ছিল। বিক্রি হলে দাম দেব। ভাবিও রাজি ছিলেন। আমাদের দোকানে শাড়ি রাখার কোনো জায়গা ছিল না। তাই পাটির ওপরই পলিথিনে মোড়কে শাড়িগুলো রেখেছিলাম। বিক্রি হলো বেশ ভালোই। সেই সুবাদে দোকানে আরো পোশাক আনা শুরু করলাম। ওই সময়টায় চারুকলার বন্ধুরা অনেক সহায়তা করেছিল, যা ভোলার মতো নয়। ১৯৯৬ সালে ঈদে বিক্রির জন্য প্রথমবারের মতো পাঞ্জাবি আনলাম। এ কারণে ঈদের ব্যবসাটাও অনেক ভালো হলো। এরপরই ঢাকা থেকে প্রাইডের শাড়ি আর থানকাপড় আনা শুরু করলাম। এভাবেই রঙ একটু একটু করে বেড়ে উঠল। ২০০১ সালে নারায়ণগঞ্জের পর ঢাকার কনকর্ড টুইন টাওয়ারে নতুন শাখা চালু করি। ধীরে ধীরে রঙের শাখা-প্রশাখা বেড়ে উঠতে শুরু করে। বর্তমানে রঙের মোট ১৩টি শাখা রয়েছে।’
অনুপ্রেরণায়
এত দূর আসার পেছনে কার অনুপ্রেরণা ছিল জানতে চাইলে বিপ্লব সাহা বলেন, ‘সত্যি কথা বলতে কি, সৃষ্টিশীল কোনো কাজের জন্য আমার পরিবার থেকে কোনো দিন কোনো পৃষ্ঠপোষকতা পাইনি। ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকার প্রতি প্রবল ঝোঁক ছিল। কিন্তু লেখাপড়ার ক্ষতি হবে বলে কখনো আমার পরিবার থেকে কোনো সহযোগিতা পাইনি। এমনকি স্কুলের ড্রইং ক্লাসের জন্য যতটুকু দরকার, তার বাইরে এতটুকু ড্রইং খাতা বা রং কিনে দেওয়া হতো না আমায়। পঞ্চম শ্রেণিতে যখন পড়ি, তখন আমার মেজো ভাইয়ের বন্ধু মুস্তফা ভাই আমাকে প্রথম জলরং কিনে উপহার দেন। সেই দিনটির কথা আমি আজও ভুলিনি। স্টিলের একটা সুটকেস ছিল আমার। মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে খাটের নিচে গিয়ে ছবি আঁকতাম। আর ওই সুটকেসে জমাতাম। ক্লাস নাইনে ওঠার পর আমার বড়দিদি বাসার কাছে একটি আর্ট স্কুলে ৯০ টাকা দিয়ে ভর্তি করিয়ে দেন। ১৯৮৯ সালে এসএসসি পরীক্ষার কারণে আর্ট স্কুলে যাওয়া বন্ধ হলো। এরই মধ্যে বিভিন্ন চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছি বেশ কয়েকবার। বিভিন্ন প্রদর্শনীতেও অংশগ্রহণ করেছি।
কিন্তু হুট করেই বাবার নিজের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। এরই মধ্যে বড় ভাই বিদেশ পাড়ি দিলেন। মেজো ভাইও একটি প্রাইভেট ফার্মে যোগ দিলেন। ১৯৯১ সালে এইচএসসি পাসের পর আমার জামাইবাবুর অসুস্থতার কারণে আমাকে আনা হয় নারায়ণগঞ্জ থেকে। রাতে বোনের বাসায় যাওয়ার পথে একদিন হঠাৎ ঢাকার একটি ম্যাপে খুঁজে পেলাম ঢাকা আর্ট কলেজ। বোনের দেওয়া টাকা নিয়ে ধানমণ্ডি থেকে একটি রিকশায় করে চলে এলাম চারুকলা ইনস্টিটিউটে। সামনের গোল সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠে গিয়ে দেখলাম অনেক ছেলেমেয়ে সারি সারিভাবে বসে ছবি আঁকছে। জানতে পারলাম দুদিন পর ভর্তি পরীক্ষা। কী করব বুঝতে পারছিলাম না।
পকেটের সবটা দিয়ে একটা ফরম কিনলাম। দুদিন পর বোনের বাসা থেকে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিলাম। কিছুদিন পর পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো। প্রথম দশজনের একজন আমি। কিন্তু আমার সব খুশিতে প্রথম বাধা এলো আমার পরিবার থেকে। আমার বোনের শ্বশুরবাড়ির লোকজন অনেক কষ্টে বাবাকে রাজি করালেন। তবে শর্ত ছিল, নারায়ণগঞ্জে তোলারাম কলেজে বিকম-এ ভর্তি হতে হবে। কী আর করা, আর্ট কলেজ ও ডিগ্রিতে লেখাপড়া একসাথেই চলতে লাগল।’
‘আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার পর টুকটাক ভালো রোজগার হতে লাগল। নিজের হাতখরচ ও আর্টের সরঞ্জাম নিজের টাকা দিয়েই কিনতাম। এভাবেই ধীরে ধীরে চারিদিকে আমার নাম ছড়িয়ে পড়ে। বলতে গেলে নিজের ইচ্ছা, নিজের অনুপ্রেরণায় আজ আমি রঙকে এতদূর নিয়ে আসতে পেরেছি,’ বললেন বিপ্লব সাহা।
বিশেষ কাজ
সব কাজই আমার কাছে বিশেষ। এর মধ্যে কিছু কাজ বেশ পছন্দের; রঙ-আরটিভি ২০-২০ কালারস, আমার রঙ আমার মা, রঙের ১৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে রংধনু এক্সপোজিশন ২০১০, রঙ ভ্যালেন্টাইন ডে বেস্ট কাপল উইনার ২০০৯ ও ফাদারস ডে স্পেশাল।
অবসর আর ভালোলাগা
খুব একটা অসবর পান না বিপ্লব সাহা। তবে যতটুকু সময় পান নিজের পরিবারকেই সময় দেন। নানা রঙের রং নিয়ে খেললেও তাঁর নিজের ভিষণ পছন্দের রং নীল। লতা মঙ্গেশকারের গান শুনতে ভালোবাসেন তিনি। তবে সবার গানই বিপ্লব সাহার বেশ পছন্দের। ছোটবেলা পাঠ্যপুস্তকের বাইরে তিনি গানও মুখস্থ করতেন। তিনটি গানের খাতাও ছিল তাঁর। সারাদিন রং নিয়ে যাঁর ওঠাবসা, সেই বিপ্লব সাহার বর্ণহীন নদী ভীষণ পছন্দের।
যাঁরা এই পেশায় আসতে আগ্রহী
বিপ্লব সাহা বলেন, অনেকেই আছেন যাঁরা রঙের মতো একটি ব্র্যান্ড তৈরি করতে চান। আবার অনেকে আছেন যাঁরা বিপ্লব সাহা হতে চান। সবার আগে ঠিক করতে হবে আপনার আগ্রহ কোনটির প্রতি বেশি। তবে ক্রিয়েটিভিটি না থাকলে এবং টাকা না থাকলে এই পেশা একটু বেশিই কষ্টদায়ক। কেউ কেউ শুরুতেই টাকার পেছনে ছুটে থাকেন। সব সময় মনে রাখবেন, কোয়ালিটি থাকলে, কাজের পিছে ছুটলে টাকাও আপনার পেছনে ছুটবে। আমি বিশ্বাস করি, ভালো উদ্দেশ্য সফলতা আনবেই।