নারী দিবসে সফল নারীদের প্রত্যাশা
নারী। যার বিচরণ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে। ঘর থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র কোথায় নেই নারী! কখনো মা হয়ে, কখনো বোন হয়ে, আবার কখনো বা স্ত্রী। পুরুষের জীবনে প্রতিটি সম্পর্কের ক্ষেত্রেই নারীদের ভূমিকা অনেক বেশি। সর্বোচ্চ পর্যায়ে এখন নারীদের বিচরণ। এমনকি সব পেশাকেই নির্দ্বিধায় বেছে নিচ্ছেন নারীরা। আর এসব ক্ষেত্রে সাফল্যের বিন্দুমাত্র ঘাটতি নেই। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে আলাপ হলো এমন কয়েকজন সফল নারীর সঙ্গে। আজকের দিনে তাদের প্রত্যাশা সম্বন্ধে জানিয়েছে নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে সফল এই নারীরা।
লিপি খন্দকার
ফ্যাশন ডিজাইনার, বিবিআনা
আমাদের কাজের জায়গাতে আমরা যারা কাজ করছি তারা অনেক সম্মান ও সুযোগসুবিধা পাচ্ছি। কিন্তু যারা মাঠ পর্যায়ে কাজ করছেন তারা অনেক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন। এমনকি যারা নতুন করে এই ব্যবসায় পুঁজি দিতে আগ্রহী তাদের জন্য খুব একটা সুখকর নয় বিষয়টি। আমাদের নারীদের জন্য বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ সুবিধা দেওয়া হয়। এর মধ্যে কিছু কিছু ব্যাংকে ৯ শতাংশ সুদ দিতে হয় আর বেশির ভাগ ব্যাংকই ১০ শতাংশ পর্যন্ত সুদ রাখে। যা অনেকের পক্ষে শোধ করা কষ্টকর। তাই অনেক ক্ষেত্রেই নারীরা স্বাবলম্বী হতে এগিয়ে এলেও এসব বাধার মুখে পরে আবার পিছিয়ে যায়। আবার ব্যাংকের টাকা শোধ করার মেয়াদও থাকে অনেক কম। আমার মনে হয়, এই মেয়াদটা একটু বাড়িয়ে দিলে নারীদের জন্য লোন পরিষদে সুবিধা হবে। আমরা যতই বলি নারীরা স্বাবলম্বী, এসব ক্ষেত্রে নারীরা অনেক বেশি বৈষম্যের শিকার হয়। একজন নারী যখন তার নিজের কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করে তখন সামাজিকভাবে অনেক ক্ষেত্রেই সে সহযোগিতা পায় না। এমনকি স্বামীর কাছে থেকেও ততটা সুযোগ সে নিতে পারে না। অথচ সেই ব্যবসা যখন পুরোপুরি ভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় তখন তার স্বামী এসে নজরদারি রাখা শুরু করে। এমনকি সেই নারীর উপার্জনের টাকা সে নিজের ইচ্ছায় খরচও করতে পারে না। তাঁর নিজের উপার্জনের ওপর কোনো স্বাধীনতা থাকে না। এই সমস্যার মুখোমুখি অনেক নারীই হয়ে থাকেন। কিন্তু তাঁরা প্রকাশ করেন না। আমি আরো বলব, পাবলিক যানবাহগুলোতে কর্মজীবি নারীরা প্রতিনিয়ত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। দেখা যায় ঠেলাঠেলি করে বাসে উঠার সময় হেলপার কোন এক নারীকে পিঠে হাত দিয়ে বাসে তুলে নিচ্ছে। বলা হয়, এটা সাবধানতা বা সুরক্ষার জন্য করা হয়। কিন্তু আমার প্রশ্ন এটা কী কোনো হয়রানির বিষয় না? এই বিষয়টাতে কোন নারীই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করবেন না। এমনকি বাসে উঠার পর দেখা যায় সিট না থাকলে কোন পুরুষ তাকে বসার জন্য জায়গা করে দেয় না। অথচ বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই নিয়মটা প্রতিটি যানবাহনের ক্ষেত্রেই প্রযোয্য। আর আমাদের দেশে এই শ্রেণী বৈষম্য এখনো বহাল রয়েছে। নারীদের জন্য অলাদা আসন রাখা আছে ঠিকই। কিন্তু বাসে ওঠার সময় যে হয়রানি হয় তার সমাধান কী? তাই নারীদের জন্য আলাদা আসন না রেখে আলাদা বাসের ব্যবস্থা করে দেওয়াই ভালো। আজকের এই নারী দিবসে আমার এটাই প্রত্যাশা।
আফরোজা পারভীন
বিউটি এক্সপার্ট, রেড বিউটি সেলুন
আমি একজন নারী হয়ে গর্বিত আজকের এই দিনটির জন্য। একজন নারীকে কতটা সম্মান দেওয়া সম্ভব এই দিবসটা সেটাই তার বড় প্রমাণ। আমার কাজের ক্ষেত্রটা আসলে নারীদেরই। এখানে কাজ করে যারা এবং সেবা নেয় যারা তার মধ্যে ৯৫ শতাংশই নারী। এই একটা পেশা যেখানে সব ধর্মের নারীরাই কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। এখানে পর্দার মধ্যে থেকেও কাজ করা সম্ভব। অন্য যেকোনো পেশায় হয়তো পুরুষদের সঙ্গে কাজ করতে হয়, যেখানে হয় তো অনেকেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। কিন্তু এই ক্ষেত্রে নারীদের কাজের জায়গাটিও নারীদের সঙ্গে। তাই বিউটি বিজনেস নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য অনেক ভালো একটি ক্ষেত্র। কারণ এই পেশায় অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে। তাই নারীদের বলবে, বর্তমানে এই পেশাটি নারীদের জন্য অনেক সম্মানজনক এবং স্বাচ্ছন্দের। তাই এ পেশাকে নির্দ্বিধায় বেছে নেবে সব নারী, আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা।
পারভীন জলী
সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
আমি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে বলছি, নারী দিবসে শুধু আনুষ্ঠানিকতাই যেন লক্ষ্য না হয়। প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকারের দিকে নজর রাখা হচ্ছে কি না সেটাও দেখার বিষয়। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একজন নারী। এটা আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয়। কিন্তু অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে আছে যেখানে নারীদের বিচরণ নেই বললেই চলে। এখনো কোনো ছাত্র হলে নারী হাউস টিউটর নেই। আমার প্রশ্ন হলো আমরা যদি ছাত্রদের ক্লাসে পড়াতে পারি তাহলে তাদের হলের হাউস টিউটর কেন হতে পারব না। অন্যদিকে মেয়েদের হলে ঠিকই পুরুষ হাউস টিউটর থাকে। এটা কেমন বৈষম্য? যুগে যুগে সব সময় দেখে আসছি নারীদের সব বিষয়ে নজর রাখা হয়, খবরদারি করা হয়। তাদের সন্ধেহের চোখে দেখা হয়। এটা তাদের সুরক্ষার জন্য করা হয় না কি এখানেও বৈষম্য- এটা আমাদের আগে বুঝতে হবে। হল প্রশাসন, যেখানে শিক্ষক এবং অন্য কর্মকর্তারা কর্মরত রয়েছেন সেখানে ১৩৭টি পদের মাত্র ৩৫টি পদ নারীদের আর ১০২টি পদ পুরুষদের। এমনকি সিনেটের ৮৩টি পদের মধ্যে মাত্র ৭টি পদ নারীদের। আমাদের সবাইকে আগে বুঝতে হবে, আমরা কি সর্বোচ্চ পদে নারীদের দেখতে চাই নাকি সবক্ষেত্রে নারীদের দেখতে চাই। আমি নারী হিসেবে বলবে, শুধু সর্বোচ্চ পদে নয় সবক্ষেত্রে নারীদের বিচরণ চাই। আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা।
তামান্না চৌধুরী
প্রধান পুষ্টিবিদ, অ্যাপোলো হাসপাতাল
গত সাত-আট বছর ধরে আমাদের দেশে নিউট্রিশিয়ান বা ডায়েট স্পেশালিস্ট বিষয়টি বেশ পরিচিত হয়েছে। এর আগে পুষ্টির জন্য যে ডাক্তার দরকার এই বিষয়টিই মানুষ বুঝত না। আমি বলব এই পেশাটি নারীদের জন্যই। একজন নারী যদি তার পরিবারের সবাইকে সুস্থ রাখার ব্যাপারে সারাক্ষণ সচেতন থাকতে পারেন তাহলে এই পেশাটা তাঁকে আরো বেশি সাহায্য করবে বলে আমার মনে হয়। একটি হাসপাতাল পরিপূর্ণ হয় ডাক্তার, নিউট্রিশিয়ান, নার্স ও ফার্মেসি এই চারটির সমন্বয়ে। তাই প্রতিটি হাপাতালে একজন নিউট্রশিয়ান রাখা খুবই প্রয়োজন। আজকের এই দিনে আমি বলব, নারী দিবস বলি, নারীদের স্বাধীনতা বলি আর নারীদের সাফল্য বলি- সবকিছুই ঠিক থাকবে যখন একজন নারী সুস্থ থাকবেন। যুগ যুগ ধরে ক্যালোরি বিষয়টি শুধু পুরষদের জন্যই বরাদ্দ থাকে। একজন নারীরও সমান পরিমাণ ক্যালোরি প্রয়োজন তা এখনো আমাদের সমাজে অনেকেই বুঝতে চায় না। জন্মের পর পরই কন্যা শিশুকে পুষ্টির আওতায় অনতে হবে। নিয়মিত চেকআপ করাতে হবে। আমি খুবই অবাক হই শুধু গর্ভাবস্থায় নারীর পুষ্টির কথা চিন্তা করা হয়, তাদের নিয়মিত চেকআপ করানো হয়। এর পরই আমরা আবার সব ভুলে যাই। নারীদের জন্য পুষ্টি খুবই জরুরি এবং নিয়মিত তার শারীরিক চেকআপ প্রয়োজন- বিষয়টি সবাই বুঝতে পারবে, আজকের দিনে এটাই আমার প্রত্যাশা।