শিশুর জন্য আট রকম বই
‘শিশুদের অবশ্যপাঠ্য ৫০টি বই’ অথবা ‘শিশুদের জন্য সর্বকালের সেরা ১০০টি বই’ ইত্যাদি রকমের তালিকাগুলোয় একটা বড়সড় গলদ রয়েছে। একটা শিশুকে না জেনে না বুঝেই তার জন্য ৫০ বা ১০০টা বই বাধ্যতামূলকভাবে চাপিয়ে দেওয়া একটু জুলুম করাই বলা যায়! এর অনেকগুলো তো তার নাও পছন্দ হতে পারে। এদিকে অভিভাবক হিসেবে আপনিও এই তালিকার ওপর ভরসা করে আপনার শিশুটির ওপর চাপিয়ে দিলেন সাধের গন্ধমাদন পর্বতের বোঝা! শিশুর জন্য নির্দিষ্ট কিছু বই হাজির না করে তাকে বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের কিছু বইয়ের মালিক করে দিতে পারেন বরং। কদিন বাদে দেখবেন, আপনার সন্তান নিজেই নিজের লাইব্রেরি গুছিয়ে নিতে সমর্থ হয়ে যাবে। নজর বুলিয়ে নিন আট ধরনের বইয়ের ওপর, যেগুলো আপনার সন্তানের লাইব্রেরিতে থাকা জরুরি :
১. ছবির বই
একপাশে ছবি, আরেকপাশে সরল টানে তার অনুরূপ একটি আকৃতি। আপনার শিশুটির কাছে রংপেনসিল কি ওয়াটার কালারের কমতি নেই। সুতরাং, এই আকৃতি সে রাঙিয়ে তুলবে কল্পনা আর সৃষ্টিশীলতার খেলায়। এই শক্তপোক্ত মোটা কাভারের ছবির বইয়ের যে কি শক্তি, তা আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। সেটা সন্তানকে নিজের মতো বুঝে নিতে দিন, তার যেমন খুশি আঁকতে কি খেলতে ইচ্ছে হয়, করতে দিন।
২. পৌরাণিক কাহিনীর বই
আমাদের দুনিয়ায় পুরাণের গল্প অজস্র। পৌরাণিক কাহিনীতে সাহিত্য শিক্ষা বা বিনোদনের পাশাপাশি কিন্তু বিভিন্ন দেশ-জাতি-জনপদের ইতিহাস, সংস্কৃতিসহ আরো অনেক কিছু জানা যায়। কাজেই, ছোট থাকতেই যদি শিশুকে পৌরাণিক আখ্যানের বিশালতার সাথে পরিচয় করিয়ে না দেন, তাহলে আর কখন! গ্রিক পুরাণ, মহাভারতের গল্প, আরব্য রজনী, রাজা আর্থারের কাহিনী- সবই দিয়ে দেখুন ওকে। দেখুন বা বোঝার চেষ্টা করুন ওর কোনটা ভালো লাগছে- কেন ভালো লাগছে। ওর পছন্দকে অনুসরণ করুন।
৩. ছেলেবেলায় আপনার পছন্দের বই
সময় তো বদলাচ্ছে। ‘জেনারেশন গ্যাপ’ বলে যে একটা কথা আছে, সেটাও মানতে দ্বিধা নেই কারো। সুতরাং আপনার সন্তান আর আপনার পছন্দের মাঝে ফারাক থাকতেই পারে। তবুও কে জানে, ছেলেবেলায় রবিনহুডের কাহিনী পড়ে আপনার হয়তো শেরউড জঙ্গলের রাজা হওয়ার খায়েশ হয়েছিল আর ওদিকে আপনার বীরপুরুষ ছোট্ট ছেলেটিও হয়তো বা মনে মনে তেমনটিই চায়! আপনার ছেলেবেলায় পড়া পছন্দের বইগুলো তাকে দিয়েই দেখুন একবার, দেখুন তার কেমন লাগে!
৪. শিশুর ব্যক্তিত্বের সাথে মানানসই বই
একেক শিশুর চিন্তাভাবনা একেক রকম হয়। কোনো শিশু ছোটবেলা থেকেই বিরাট দার্শনিক, কেউ বা স্পোর্টসম্যান, কেউ বা আপন জগতে এক ছোট্ট রূপকথার রাজকুমারী। তাদের ব্যক্তিত্বের ধরনটা বোঝার চেষ্টা করুন। সেই অনুসারে তাকে ভিভ রিচার্ডসের ছেলেবেলা, শিশুদের ডিরোজিও কিংবা লুইস ক্যারলের রূপকথার বই এনে দিন। অনুসরণ করুন ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ তত্ত্ব!
৫. কবিতার বই
কবিতা হয়তো আপনার কাছে একঘেয়ে কিংবা অনর্থক হতে পারে, আবার চিন্তাশীল সাহিত্যের অনন্য বহিঃপ্রকাশের একক মাধ্যমও হতে পারে! সে যাই হোক না কেন, কবিতা কিন্তু শিশুদের জন্য খুবই দরকারি। কোন শব্দের সাথে কোন শব্দটা খাপ খায়, ভাষা কীভাবে হয় ছন্দময় - তার শিক্ষা শিশুরা কবিতা থেকেই সবচেয়ে ভালো নিতে পারে। একই সাথে চিন্তার জগতে ডুব দেওয়ার প্রশিক্ষণেও তাদের জন্য কবিতা আর তার ছন্দই সেরা। সুতরাং পাঠ্যপুস্তকের কবিতা মুখস্থকরণ কর্মসূচির মাঝে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে পড়তে দিন বিভিন্ন কবিতা। কেবল ছোটদের ছন্দময় ছড়াই নয়, বিখ্যাত কবি ও ছড়াকারদের লেখার সাথেও তাদের পরিচয় করিয়ে দিন।
৬. মননশীল বই
ইন্টারনেটে সবই পাওয়া যায়, কিন্তু ইন্টারনেট কখনোই সবকিছু নয়। একটা শিশুর জন্য তো কখনোই নয়। দুনিয়াটাকে ঠিকঠাক চিনতে, জানতে আর জ্ঞানের বিচিত্র অপার জগত তার সামনে তুলে ধরতে তাকে ইতিহাস, জীবনীর মতো কিছু মননশীল বইয়ের সন্ধান দিন। কে জানে, সেখান থেকেই হয়তো তার আগামীর জীবনটা নির্ধারিত হয়ে যেতে পারে।
৭. বড়দের বই
শুনে একটু চমকে গেলেন কি? ‘বড়দের বই’ শিরোনামের কার্যকারিতাই তো সেখানে যে সেটা ছোটদের পড়া বারণ! সে যা হোক, এখানে বড়দের বই বলতে এক্কেবারে ‘বড়দের’ বই বোঝানো হচ্ছে না। আপনার শিশুটি কি সব সময় ছবির বই আর ডালিম কুমারের কাহিনী নিয়েই পড়ে থাকবে না কি? কে জানে, তার হয়তো এখনই নার্নিয়ার আখ্যান, হ্যারি পটারের গল্প কিংবা তিন গোয়েন্দা সিরিজ শুরু করে দেবার ইচ্ছা! সুতরাং এ নিয়ে তার সাথে কথা বলুন। সে যা বা যেগুলো পড়তে চায়, সেগুলো তাকে পড়ার জন্য আস্তে আস্তে উপযোগী করে তুলুন।
৮. ডায়েরি
কারো লেখা ডায়েরি নয়, নেহাত ফাঁকা একটা নোটবুক। এই ফাঁকা বইয়ের পৃষ্ঠাগুলো নিজের মতো করে ঠাসবুনোনির লেখায় পরিপূর্ণ করে তুলবে আপনার সন্তানটি। এই গল্প হবে তার নিজের গল্প, আপন জগতের আখ্যান, নিজেকে ধীরে ধীরে আবিষ্কার করার আর চিনে ওঠার যাত্রা। সুন্দর একটা নোটবুক কিনে দিন আপনার শিশুকে, এটা হতে পারে তার জন্য আপনার সেরা উপহার।