প্রথমে ২০ টাকা দিয়ে ছবি বিক্রি করেছি: প্রীত রেজা
শুরুটা হয়েছিল ২০ টাকার বিনিময়ে প্রিন্ট করা ছবি বিক্রির মাধ্যমে। কিন্তু বিষয়টি যে শুধু বেচাকেনা নয়, সেখানে যে শিল্প আছে এবং উচ্চশিল্পেরও যে দাম আছে সেটাই ধীরে ধীরে প্রমাণ করেছেন ওয়েডিং ফটোজার্নালিস্ট প্রীত রেজা। আজ শুধু বাংলাদেশে নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তাঁর খ্যাতি। বিয়ের ছবি তোলাও যে সম্মানজনক পেশা হতে পারে, সেই স্বীকৃতি তিনি আদায় করে ছেড়েছেন। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে এক আলাপে রেজা জানিয়েছেন এই শিল্পে তাঁর পথচলার কথা। চলুন তাঁর মুখেই শুনি মুহাম্মদ জাহিদ রেজা প্রীত কী করে এতদূর পথ এলেন।
প্রীতর প্রীত হওয়া
পুরো নাম মুহাম্মদ জাহিদ রেজা প্রীত। তিনি যখন জনপ্রিয় হতে শুরু করলেন, তখন কেউ তাকে জাহিদ বলত, কেউ রেজা আবার কেউ বা ডাকত প্রীত বলে। তখন এক বন্ধুর উপদেশে পুরো নাম বদলে হয়ে গেলেন প্রীত রেজা। তিনি আমাদের দেশের বিখ্যাত ওয়েডিং ফটোগ্রাফার হিসেবেই স্বীকৃত।
কাজের শুরু
বিখ্যাত ব্যক্তিদের বিখ্যাত হওয়ার পেছনের ঘটনা কখনোই মধুর হয় না। তেমনি অনেক পিছুটান, নানা বাঁধা পার হয়ে আজ তিনি প্রীত রেজা। তিনি জানান, ‘মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ফটোগ্রাফি পেশায় আসা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার ছিল তখন। আর এখনকার মতো ডিজিটাল ক্যামেরারও প্রচলন ছিল না। সে সময় কামেরায় ছবি তোলার জন্য ফিল্ম ব্যবহার করা হতো। তাই খরচটাও একটু বেশি ছিল। কী আর করা। শখ তখন পেশায় পরিণত হলো। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ার সময় বিভিন্ন উৎসব যেমন- পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, ২১ শে ফেব্রুয়ারিতে অনেকের পোর্ট্রেট ছবি তুলতাম। প্রতি ছবির জন্য ২০ টাকা করে নিতাম। তাও আবার প্রিন্টসহ। এভাবেই ধীরে ধীরে এই পেশায় জড়িয়ে গেলাম।’
অনুপ্ররণা
প্রতিটি কাজের পেছনেই কারো না কারো অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হয়। প্রীত রেজারও অনুপ্রেরণার দরকার হয়েছিল। তবে সেই অনুপ্রেরণায় তিনি নিজেই ছিলেন। এ বিষয়ে প্রীত রেজা বলেন, ‘আমার আসলে পেছন ফিরে তাকানোর কোনো রাস্তা ছিল না। সামাজিকভাবে, পারিবারিকভাবে এই পেশার ততটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল না তখন। বলতে গেলে নিজের ইচ্ছার ওপর ভর করেই এতদূর আসা। আমি একজন স্বপ্নবাজ মানুষ। স্বপ্ন দেখতে খুবই পছন্দ করি। আর স্বপ্ন দেখার কারণেই আজ এই পেশায় নিজের জায়গা করে নিয়েছি। আমার মনে হতো, আমি অনেক বড় ঝুঁকি নিয়ে ফেলেছি, যা থেকে পেছনে ফেরা কোনোভাবেই সম্ভব না। এখানেই আমাকে প্রতিষ্ঠিত হতে হবে। এই ইচ্ছাশক্তিই আমাকে সাহায্য করেছে।’
বিয়ের ছবিই কেন
মূলত পত্রিকার ছবি তুলতেই প্রীত রেজা পছন্দ করতেন। কিন্তু সবকিছু পেছনে ফেলে ওয়েডিং ফটোগ্রাফিকেই কেন বেছে নিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে প্রীত রেজা বলেন, ‘বিভিন্ন পত্রিকায় আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করতাম। সেখান সম্মান পেয়েছি অনেক কিন্তু অর্থনৈতিক দিক দিয়ে সচ্ছলতা খুব একটা ছিল না। তাই তখন টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে ছবি তুলতাম। কিন্তু যাদের মাঝে আমার ফটোগ্রাফির পথচলা, তারাই আমাকে নিয়ে পরিহাস করা শুরু করল। বলত, এই ছেলেটা এত ভালো ছবি তোলে, তাহলে বিয়ের ছবি তোলার কী দরকার। তখন আমার মধ্যে ভীষণ জেদ কাজ করত। আমার ছবি তুলতে ভালো লাগে। সেটা প্রকৃতির হোক কিংবা কারো বিয়ের স্মৃতি হোক। দুটোই আমার কাছে সমান গুরুত্বের। তাই আমার এই পেশাটাকে খারাপ বলার তাদের কোনো অধিকার নেই। তাই ভাবতাম যেভাবেই হোক, আমি এই পেশায় প্রতিষ্ঠিত হবই। একসময় বাংলাদেশে ওয়েডিং ফটোগ্রাফার হিসেবে সবাই আমাকেই চিনবে।’
ফিরে দেখা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকেই প্রীত জড়িয়ে যান এই পেশায়। এরপর সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব ফটোগ্রাফি (পাঠশালা) থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। বিভিন্ন স্বনামধন্য পত্রিকা দৈনিক ইত্তেফাক, নিউ এইজ, দ্য ডেইলি স্টার, দৃক নিউজ, দৈনিক আজকের কাগজ এবং ভোরের কাগজে আলোকচিত্রী হিসেবে কাজ করেছেন। আইস মিডিয়া লিমিটেডের বিভিন্ন প্রসিদ্ধ ম্যাগাজিনের (আইস টুডে, আই সি ই বিজনেস টাইমস, চারবেলা চারিদিক এবং বেঙ্গল বার্তা) ফটো এডিটর হিসেবে কাজ করেছেন। বর্তমানে ওয়েডিং ডায়েরির সিইও এবং ডিওপি হিসেবে রয়েছেন। এ ছাড়া কাউন্টার ফটোর ফ্যাকালটি হিসেবে কাজ করছেন। ২০১২ সাল প্রীত রেজা আন্তর্জাতিকভাবে ওয়েডিংয়ের ওপর কাজ করেছেন। থাইল্যান্ড, ভারত, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম পিএএসইও আর্ট ফেস্টিভালে ২৬টি গ্যালারির মাঝে প্রীত রেজার একক প্রদর্শনী হয়।
প্রিয় ফটোগ্রাফার
প্রীত রেজা বলেন, ‘দেশের মধ্যে আমার শহীদুল আলম, আনোয়ার হোসেন এবং হাসিব জাকারিয়াকে পছন্দ। আর দেশের বাইরে রঘু রায়, কেডা জং, ডেভিড ব্যাকসিডের কাজ ভালো লাগে। তবে আমি কাউকে সরাসরি অনুসরণ করিনি। একেকজনের একেক বিষয় আমার ভালো লাগত। সেখান থেকে আমি নিজেকে তৈরি করার চেষ্টা করেছি।’
বর্তমানে ব্যস্ততা
প্রীত রেজা বর্তমানে বাংলাদেশের ফুজি ফিল্মের ফটোগ্রাফার অ্যাম্বাসাডর হিসেবে কাজ করছেন। ডব্লিউপিপিএ (ওয়েডিং অ্যান্ড পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফারস এশিয়া) বাংলাদেশের অ্যাম্বাসাডর এবং প্রথম বাংলাদেশি স্পিকার প্রীত রেজা। বাংলাদেশের একমাত্র আলোকচিত্রীনির্ভর টিভি শো ‘ডার্করুম’-এর উপস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন। প্রীত রেজা প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারস অব আমেরিকা (পিপিএ), ওয়েডিং অ্যান্ড পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফার ইন্টারন্যাশনাল (ডব্লিউপিপিআই-ইউএসএ), ইন্টারন্যাশনাল সোসাইটি অব প্রফেশনাল ওয়েডিং ফটোগ্রাফারস (আইএসপিডব্লিউপি), ওয়েডিং অ্যান্ড পোর্ট্রেট ফটোগ্রাফারস এশিয়া (ডব্লিউপিপিএ) এবং ইপ্লাস ইন্টারন্যাশনালের সদস্য।
সাম্প্রতিক কাজ
প্রীত রেজা যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব স্টেটের একজন প্রফেশনাল ফেলো এবং অ্যালামনাই, যা গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলোশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে তিনি অর্জন করেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ভবিষ্যতে কী করতে চান জানতে চাইলে প্রীত বলেন, ‘আমি মনে করি একা একা বনের বাঘ হয়ে কোনো লাভ নেই। এটা একটা শিল্প। এখানে অনেক মানুষের আনাগোনা প্রয়োজন। তাই আমি চাই তরুণ প্রজন্ম এই পেশাটিকে বেছে নিক। তাদের শেখার অনেক সুযোগ রয়েছে। যেটা আমাদের সময়ে ছিল না। আমার মধ্যে এই বিষয়ে যতটুকু জ্ঞান রয়েছে, আমি চাই সবটুকু নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে যাতে তারা এই শিল্পকে যথাযথ সম্মানের সাথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।’
কাজের স্বীকৃতি
প্রীত রেজা মিরর বিজনেস অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে ‘দ্য বেস্ট ওয়েডিং ফটোগ্রাফার ২০১১-১২’ পুরস্কার পেয়েছেন এবং দ্য ডেইলি নিউ এইজ পত্রিকার ম্যাগাজিন ‘জোভেন’ তাঁকে ‘ইয়ং আইকন ২০১২’ নির্বাচিত করেছে।
অবসর এবং ভালো লাগা
প্রীত রেজা একটু সংকোচ নিয়েই বললেন, ‘আমি আসলে খুব একটা সময় পাই না অবসরের। যতটুকু সময় পাই, আমার পরিবারকেই সময় দেই।’ মায়ের হাতে তৈরি বিভিন্ন ধরনের ভর্তা খেতে ভালোবাসেন তিনি। আর বোনের হাতের রান্নাও তাঁর খুব পছন্দ। তিনি আরো বলেন, ‘আমার স্ত্রীর মধ্যরাতের রান্না করা নুডলস আমার ভীষণ প্রিয়, যা কাজের সময়ে আমাকে বেশ সঙ্গ দেয়।’ শুনতে ভালোবাসেন অঞ্জন দত্তের গান। ছোটবেলা থেকে পাগলের মতো অঞ্জনের গান শুনতেন। আর ভালোবাসেন সমুদ্রের বিশালতা।
কেউ এই পেশায় আসতে চাইলে
আমাদের দেশে যারই একটা ডিএসএলআর ক্যামেরা আছে সেই একজন ওয়েডিং ফটোগ্রাফারের। দিনের বেলা হয়তো ব্যাংকে চাকরি করেন আর রাতে একটা-দুটো বিয়েতে ছবি তুললে ক্ষতি কি? বাড়তি একটা আয় হলো। এ ধরনের মনমানসিকতা নিয়ে কখনোই সফল হওয়া সম্ভব নয়। একজন মানুষের কাছে বিয়ে অনেক বড় একটি ব্যাপার। এত বড় একটি কাজকে স্মৃতির পাতায় ধরে রাখার কাজ তারা ভরসা করে আমাদের হাতে তুলে দেন। তাই কয়েক ঘণ্টা ছবি তুললাম আর টাকা নিয়ে চলে এলাম, এ ধরনের চিন্তা থেকে আমাদের বেরুতে হবে। এটা অনেক সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অনেক কিছু শেখার আছে। তাই শুধু ক্যামেরা কিনলেই চলবে না। ভর্তি হতে হবে কোনো প্রতিষ্ঠানে। শেখার কোনো বিকল্প নেই। আর আমি মনে করি, নিজের ইচ্ছা আর শেখার আগ্রহ থাকলে কখনোই পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না।