শুধু ক্লিক করলেই ভালো ছবি হয় না : আবু নাসের
মাত্র আড়াই হাজার টাকা দামের ‘জেনিথ ১২২’ ক্যামেরা দিয়ে ছবি তোলা শুরু। এর পর ধীরে ধীরে ছবি তোলা নেশা থেকে পেশায় পরিণত হয় তাঁর। একটা সময় বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর জনপ্রিয়তা। বলা হচ্ছে, ফ্যাশন ফটোগ্রাফার আবু নাসেরের কথা। এনটিভি অনলাইনের সঙ্গে এক আলাপে আবু নাসের নিজের মুখেই জানালেন কতটা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আজ তিনি এই অবস্থানে।
ফিরে দেখা
ক্যামেরার প্রতি আগ্রহ তৈরি হলো কীভাবে—এমন প্রশ্নের জবাবে আবু নাসের বললেন, “১৯৯৪ সালের দিকে মিনোল্টার একটি ক্যামেরা দেখে আমার খুব শখ হয়েছিল ক্যামেরা কেনার। আমার বাবা বিভিন্ন ম্যাগাজিন কিনে আনত বাসায়। সেই ম্যাগাজিনে বিভিন্ন ফ্যাশন ফটোগ্রাফির ছবি দেখে ভাবতাম, আমিও একদিন এভাবে ছবি তুলব। বাবাকে গিয়ে বললাম, ক্যামেরা কিনতে চাই? তখন তিনি আমাকে বললেন, একটা ক্যামেরার দাম লাখখানেক হবে। তুমি এটা দিয়ে কী করবে? আমি তো শুনে খুবই অবাক। এটার এত দাম কেন? বললাম, থাক লাগবে না। এসএসসি পরীক্ষার পর যখন রেজাল্ট দিল, তখন আমার বাবা ভাবতেই পারেননি যে আমি এত ভালো রেজাল্ট করব। কারণ, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে আমি নির্ঘাত ফেল করব। অথচ ঘটল ঠিক তার উল্টোটা। রেজাল্ট ভালো হওয়ার কারণে বাবা খুশি হয়ে জানতে চাইলেন, কী চাই আমি তাঁর কাছে। তখন সাহস করে তাঁর কাছে ক্যামেরাটাই চেয়ে বসলাম। কিন্তু সেই লাখ টাকার ক্যামেরা নয়। বাবা বললেন, যখন কিনবে ভালোটাই কেনো। আমি বললাম, প্রথমে কম দামে কিনে শিখে নিই। তার পর আমি নিজেই কিনে নেব। সে সময় আড়াই হাজার টাকা দিয়ে ‘জেনিথ ১২২’ ক্যামেরা কিনি। মজার ব্যাপার হলো, এই ক্যামেরা দিয়েই আমার হাতেখড়ি হয়েছিল। আমার খালাতো ভাইয়ের কাছে এই মডেলের ক্যামেরাটাই ছিল। যেহেতু এই ক্যামেরাটা সম্বন্ধে আমি জানতাম, তাই তখন এটাই কিনেছিলাম। ৪ অক্টোবর আমার জন্মদিন ছিল। সেদিনই বাবা আমাকে ক্যামেরাটা কিনে দেন। তখন থেকেই ছবি তোলা আমার শখ থেকে নেশায় পরিণত হয়। আর নেশা থেকে পেশায়।”
আবু নাসের বলেন, ‘বাবার চাকরির কারণে আমার ছোটবেলা কাটে সৌদি আরবে। সেখান তিনি জার্মানির একটি কোম্পানির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। একই বিল্ডিংয়ে থাকার কারণে তাদের সঙ্গে ওঠাবসা ছিল। তাদের জীবনধারার সঙ্গে অনেকটা মিশে গিয়েছিলাম। তাদের ফ্যাশন আমাকে খুব টানত। আসলে সত্যি বলতে কি, ছোটবেলা থেকেই শার্ট-প্যান্ট পরা আন্টিদের দেখে আসছি। তাই বাইরের দেশের ফ্যাশনের ধারাটা আমার কাছে অবাক হওয়ার মতো কোনো বিষয় ছিল না; বরং ছবি তোলার সময় অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যের মধ্যেই কাজটা করতাম।’
অনুপ্রেরণায়
প্রত্যেক মানুষের প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পেছনে কোনো না কোনো অনুপ্রেরণা কাজ করে। আবু নাসেরের জীবনেও এমন একজন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি তাঁকে এই শিল্পে কাজ করতে উৎসাহ দিয়েছেন। আবু নাসের এ সম্বন্ধে বলেন, “আমার চাচা আবদুস সামাদ না থাকলে আমার ছবি তোলাই হতো না। আমার চাচা যখন ডার্করুমে কাজ করতেন, তখন দেখতাম পানির মধ্যে কাগজ ভেজাচ্ছেন আর ছবি বের হয়ে আসছে। এই ব্যাপারটি আমার কাছে খুবই মজা লাগত। একটা সময় খুবই আগ্রহ তৈরি হয় ছবি তোলার বিষয়ে। তখন আমার চাচা আমাকে উৎসাহ দেন ছবি তোলার জন্য। মাধ্যমিক পরীক্ষার পর কলেজে ভর্তির আগে আমার অনেক বড় একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়। পুরোপুরি বিছানায় ছিলাম বেশ কিছুদিন। তখন আমার চাচা আমাকে ৯.৩০ টাকা দিয়ে এমএ বেগের লেখা ‘আধুনিক আলোকচিত্র’ নামের কলকাতার একটি বই এনে দেন। তখন সাদাকালো ছবি সম্বন্ধে আমার ধারণা হয়। তখন থেকেই আসলে ছবি তোলার প্রতি আগ্রহটা আরও বেড়ে যায়।”
কীভাবে এই পেশায় আসা
ফ্যাশন ফটোগ্রাফি পেশাদারিত্বে পরিণত হলো কেন—এর উত্তরে আবু নাসের বলেন, ‘বলতে গেলে শখের কারণেই ছবি তুলতাম। ফ্যাশনের পাশাপাশি বাচ্চাদের ছবি তুলতেও আমার খুব ভালো লাগত। তখন খুব একটা কমার্শিয়াল কাজের কথা চিন্তা করতাম না। কিন্তু ’৯৯ সালের দিকে হঠাৎ আমার বাবা মারা যান। তখন বাসার বড় ছেলে হওয়ার কারণে অর্থনৈতিক চাপটা পুরোপুরি আমার ওপর চলে আসে। তখন কীভাবে এই পেশা থেকে উপার্জন সম্ভব, সেদিকে বেশি নজর দিলাম। তখন অনেক কমার্শিয়াল কাজ করেছি, ওয়েডিং করেছি, ফ্যাশন হাউসের ছবি তুলেছি। এভাবেই ছবি তোলা আমার পেশায় পরিণত হয়।’
কাজের ক্ষেত্র
বিভিন্ন দেশীয় ও ওয়েস্টার্ন আউটফিটের বেশ কিছু হাউসে আবু নাসের কাজ করেছেন। আড়ং, এক্সটাসি, ওয়ারাহ, ওটু, তানজিম, যাত্রা, আলমিরা, শপার’স ওয়ার্ল্ড, মুমু মারিয়ার মতো ফ্যাশন হাউসগুলোর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কাজ করেছেন বিভিন্ন ফ্যাশন ও লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনে। আইস টুডে, চারবেলা চারিদিক, ক্যানভাস, হাইওয়ে, এফআই, স্টাইলওয়াচ, গ্রোভ ও ডেইলি স্টার পত্রিকার লাইফস্টাইল ট্যাবলয়েডের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন বিউটি স্যালন পারসোনা, ফারজানা শাকিল’স, রেড লেজার চেইন ও হেয়োরোবিক্স-এ বিভিন্ন শুটে কাজ করেছেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও তাঁর পদচারণা চোখে পড়ার মতো। ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী ম্যাক্স (পাকিস্তান), জে অ্যাডোনবি (যুক্তরাজ্য) এবং ভেলভেট মডেল এজেন্সিতে (মালয়েশিয়া) কাজ করেছেন।
বিশেষ কাজ
আবু নাসের বলেন, ‘আসলে আমি কখনোই চিন্তা করিনি কোন কাজটা আমার বিশেষ। যখন যে কাজটি করি, তখন সেই কাজটাই আমার কাছে বিশেষ ছিল। যখন একটা কাজ শেষ হয়, তখন আরেকটি কাজ আসে। সে মুহূর্তে ওই কাজটিকে আমার কাছে বিশেষ মনে হয়। কোনো একটা ম্যাগাজিনের জন্য আমি একটি পোর্টফোলিও শুট করি। দীর্ঘদিন ধরে আমি সেই কাজটি করি। সিনসিটির একটা মুভিকে কেন্দ্র করে ছবিটি তুলি। পুরো ছবিটি ছিল সাদাকালো। আর শুধু জিন্সের নীল রংটি দেখা যেত। কিন্তু অফিশিয়াল কোনো একটা কারণে ছবিটি পাবলিশড হয়নি। কিন্তু এক কথায় বলব সেই কাজটি আমার অনেক প্রিয় ছিল। এ ছাড়া ‘হাইওয়ে’ নামের একটি ম্যাগাজিনে কাজ করতাম। ম্যাগাজিনটি এখন বন্ধ হয়ে গেছে। সেখানে মডেল রুমাকে নিয়ে আন্ডারওয়াটার একটা শুট করি। সেই শুটটা অনেক জনপ্রিয় হয়েছিল। এর পর তিন বছর পর লাক্স থেকে আমাকে অফার দেওয়া হয় আন্ডারওয়ারটার শুটের জন্য। পুরো শুটটা বৃষ্টির মধ্যে করতে হয়েছিল। যদিও হাজারটা প্রতিকূলতা পার করে অনেক ভালো কিছু ছবি তুলেছিলাম, যা আমার প্রিয় কাজের মধ্যে একটি।
সাম্প্রতিক কাজ
সম্প্রতি আবুর নাসের ইউরোপিয়ান একটি ফ্যাশন ক্যাটালগে কাজ করেছেন। দেশের মধ্যে আপন জুয়েলার্স ও যমুনা ফ্রিজের বিজ্ঞাপনের কাজ শেষ করেছেন। এ ছাড়া বৈশাখের বিভিন্ন শুট নিয়ে বর্তমানে তিনি ব্যস্ত আছেন।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ফ্যাশন ফটোগ্রাফির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আবু নাসের বলেন, ‘ফ্যাশন ফটোগ্রাফি বিষয়ে আরো অনেক কিছু শিখতে চাই। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিজের কাজকে নিয়ে যেতে চাই। আমাদের দেশের ডকুমেন্টারি ফটোগ্রাফাররা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ জনপ্রিয়। সেভাবেই আমাদের ফ্যাশন ফটোগ্রাফিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই। আমি যখন এই পেশায় আসতে চেয়েছি, তখন আমাদের শেখানোর কেউ ছিল না। এমনকি টাকা দিয়েও শেখার কোনো গুরু পাইনি। নিজে নিজে শিখতে হয়েছে। তবে আমি ফটোগ্রাফার ডেভিড বারিকদারের কাছে অনেক কৃতজ্ঞ। তার সঙ্গে আমি তিন বছর কাজ করেছি। অনেক কিছু শিখেছি। তাই আমি চাই, যারা এই পেশায় আসতে চায়, তাদের কিছুটা হলেও শেখাতে। যাতে তারা খুব সহজে নিজের জায়গা করে নিতে পারে। প্র্যাকটিক্যাল শুট করিয়ে তাদের হাতেকলমে শেখাতে চাই। যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই শিল্পের ধারাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
যারা এই পেশায় আসতে চান
কেউ এই শিল্পকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে চাইলে কী করবেন—এ প্রসঙ্গে আবু নাসের বলেন, “এই পেশাকে খুব সহজ চোখে দেখা ঠিক নয়। এখানে অনেক কিছু শেখার আছে। শিখে না এলে কখনোই এ পেশায় প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব নয়। নিজের জানার আগ্রহ থাকতে হবে। এখনকার ক্যামেরাগুলোতে অটোপোগ্রাম করা থাকে। তাই ছবি তোলা খুব সহজ। কিন্তু শুধু ক্লিক করলেই ভালো ছবি তোলা যায় না—এই কথা আমরা অনেকেই মানতে নারাজ। তাদের আগে জানতে হবে, তারা কি ক্যামেরা অপারেটর হতে চায়? বাইরের দেশে দেখা যায়, অনেক বয়স্ক ফটোগ্রাফার আছেন, যারা ক্যামেরা ক্লিক করতে পারেন না। তারা অ্যাসিস্ট্যান্ট রাখেন, যারা ক্যামেরা ক্লিক করে। ফটোগ্রাফার ফোকাস করে তাকে ক্লিক করতে বলে। আর সে ক্লিক করে। তাদের ক্যামেরা অপারেটর বলে। যদি মন থেকে ছবি তুলতে চান বা একে পেশা হিসেবে গ্রহণ করতে চান, তাহলে আমি বলব, শেখার কোনো শেষ নেই। চেষ্টা করুন, কীভাবে ভালো ছবি তোলা যায়, সেটা শেখার। দেখবেন, খুব সহজেই বিষয়টি আপনার আয়ত্তে চলে আসবে।
অবসর আর ভালোলাগা
অবসর সময় পেলেই ঘুমাতে পছন্দ করেন আবু নাসের। আর সময় পেলেই ঘুরতে বেরিয়ে পড়েন তিনি। কোনো কাজের জন্য নয়, যতদিন তিনি বাইরে কোথাও ঘুরতে যান, তখন নিজের মতো করে সময় কাটান। আর খেতে ভালোবাসেন বাইরের দেশের রাস্তার পাশের মুখরোচক খাবারগুলো। আর দেশীয় খাবারের মধ্যে পছন্দ সবজি, মাছ আর মুরগির মাংস। শুনতে ভালোবাসেন শিরোনামহীন, ফাহমিদা নবী এবং ওয়ারফেজের গান। আর পছন্দ করেন আকাশ এবং খোলা দিগন্ত।