ঢাকার কথা ১৭
উনিশ শতকে ঢাকার সাহিত্যপত্র
ঢাকার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে সাহিত্যচর্চার খবর উনিশ শতকের ইতিহাসে পাওয়া যায়। ধীরে ধীরে ঢাকায় মুদ্রণযন্ত্রের বিকাশ ঘটায় লেখকসমাজের উদ্যোগে সাহিত্যপত্র প্রকাশের প্রণোদনা তৈরি হয়। প্রাপ্ত সূত্র থেকে ধারণা করা হয়, ‘কবিতাকুসুমাবলী’ হচ্ছে ঢাকা থেকে প্রকাশিত প্রথম সাহিত্য সাময়িকী। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার সম্পাদিত এই পত্রিকাটির প্রকাশকাল ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দ। বাংলা সন হিসেবে প্রকাশকাল লেখা হয়েছিল ১২৬৭ সনের জ্যৈষ্ঠ মাস। পত্রিকাটির প্রথম দুই সংখ্যা আট পৃষ্ঠা করে প্রকাশিত হয়। বার্ষিক মূল্য রাখা হয় এক টাকা। তৃতীয় সংখ্যা থেকে আকার বৃদ্ধি পেয়ে তা হয় ১৬ পৃষ্ঠা। বার্ষিক মূল্য ধার্য হয় দেড় টাকা। প্রথম দিকে পত্রিকা শুধু কবিতা দিয়ে সাজালেও পরে কবিতার পাশাপাশি গদ্য লেখাও প্রকাশিত হয়। সেই সময়ের বিচারে কবিতাকুসুমাবলী বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। এক বছরের মধ্যেই পত্রিকাটির গ্রাহকসংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে যায়।
একই সালে অর্থাৎ ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দ্বিতীয় মাসিক পত্রিকাটির নাম ছিল ‘মনোরঞ্জিকা’। কোনো কোনো সূত্র মতে, এই পত্রিকাটির সম্পাদকও ছিলেন কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। মহেশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন এই পত্রিকার প্রকাশক। তিনি ছিলেন সূত্রাপুর বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষক। ‘মনোরঞ্জিকা সভা’ নামে এ সময় ঢাকায় একটি সাহিত্য সংগঠন ছিল। মনোরঞ্জিকা পত্রিকাটি ছিল এই সংগঠনের মুখোপত্র। কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার এই সাহিত্য সংগঠনের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন।
দেখা যায়, কবিতাকুসুমাবলী প্রকাশের পর থেকে ঢাকায় পত্রিকা প্রকাশের জোয়ার সৃষ্টি হয়। ১৮৬১ সালে প্রকাশিত হয় দুটি মাসিক পত্রিকা। একটি ‘গদ্য প্রসূণ’ আর অন্যটি ‘গদ্য মাসিক’। মনোরঞ্জিকার প্রকাশক মহেশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় গদ্যপ্রসূণ পত্রিকাটি প্রকাশ করেন। অবশ্য এই সময় মনোরঞ্জিকার প্রকাশ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। গদ্য মাসিক পত্রিকার সঙ্গেও মহেশচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায় যুক্ত ছিলেন। এই পত্রিকায় তাঁর সহযোগী ছিলেন বিদ্যাধর দাস।
‘চিত্তরঞ্জিকা’ নামে একটি কবিতা মাসিকপত্র প্রকাশিত হয় ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে। সে সময়ের ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী সরদারকান্ত সেন এই পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন। সুনিশ্চিত না হলেও ধারণা করা হয়, এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন কবি হরিশচন্দ্র মিত্র। পত্রিকাটিতে সবচেয়ে বেশি কবিতা লিখেছেন কবি হরিশচন্দ্র মিত্র এবং কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার। তা ছাড়া দুজন মুসলমান কবির কবিতাও প্রকাশিত হয়। এঁরা সংক্ষিপ্ত নাম ব্যবহার করতেন। এঁদের একজন লিখতেন ‘আহমদ’ ও অন্যজন লিখতেন ‘এইচ’। একই বছর ‘অবকাশ রঞ্জিকা’ নামে আরেকটি মাসিক পত্র প্রকাশিত হয়। হরিশচন্দ্র মিত্র এই পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন। এখানে জনসচেতনতামূলক লেখা বেশি প্রকাশিত হতো। প্রকাশিত হতো সামাজিক কুপ্রথার বিরুদ্ধে সমাজ সচেতনতামূলক নাটক, ব্যঙ্গরসাত্মক কবিতা, প্রহসন ইত্যাদি। হরিশচন্দ্র মিত্র ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ‘কাব্যপ্রকাশ’ নামে এবং ১৮৭১ সালে ‘মিত্রপ্রকাশ’ নামে আরো দুটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যপত্র হিসেবে ‘মিত্রপ্রকাশ’ বেশ সুনাম অর্জন করতে পেরেছিল। বৈচিত্র্যপূর্ণ নানা ধরনের লেখা প্রকাশ পেত এই পত্রিকায়। পত্রিকার অঙ্গসৌষ্ঠবে বেশ যত্নের ছাপ ছিল। কবি ও নাট্যকার হরিশচন্দ্র মিত্র একজন সফল সাহিত্য সমালোচকও ছিলেন। প্রকাশনা জগতের এই সুদক্ষ শিল্পী ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর পর খুব বেশিদিন ‘মিত্রপ্রকাশ’ টিকে থাকেনি।
‘ধুমকেতু’ নামে একটি পত্রিকা ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায় না। পত্রিকাটি ব্রাহ্মসমাজ বিদ্বেষী বলে কেউ কেউ মন্তব্য করেছেন। ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে একটি উচ্চমার্গের পরিশীলিত সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হয়। এর নাম ‘বান্ধব’। পাঠকের কাছে সহজলভ্য করে তোলার জন্য পত্রিকাটির খুব কম মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছিল।
খুব সুনাম অর্জন না করলেও উনিশ শতকে ঢাকা থেকে আরো কয়েকটি সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হয়েছিল। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল জ্ঞানভেদ, দুঃখিনী, ভারত ভিখারিণী, নবীন, সুদর্শন, অদৃষ্ট প্রভৃতি। ঢাকা শহর ছাড়াও ঢাকা জেলার নানা অঞ্চল থেকেও এই শতকে বেশ কয়েকটি সাহিত্যপত্র প্রকাশিত হয়েছিল।