ঢাকার কথা ২২
কয়েকটি ক্ষুদ্র পেশা
উনিশ শতকের শেষ দিক থেকে ঢাকায় বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে নানা জরুরি এবং কম জরুরি জিনিসপত্রের চাহিদা বৃদ্ধিপায়। ঢাকায় ফেরি করে নানা নিত্যপণ্যের জিনিস বিক্রি করার সাধারণ প্রচলন ছিল। এর মধ্যে একটি ছিল হজমি বিক্রি। পেশাজীবী হজমিওয়ালাদের এখন আর চোখে পড়ে না।
ছোটদের মধ্যে টক স্বাদের এই হজমি খাওয়ার আগ্রহ বেশি ছিল। এ কারণে হজমিওয়ালাদের বেশি দেখা যেত স্কুলের গেটে। কালো দানাদার হজমি গুঁড়ো একটি কাঁচের শিশিতে ভরা থাকত। ক্রেতাকে দেওয়ার আগে বিশেষ প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত করতে হতো। এই প্রস্তুত প্রক্রিয়া ছোটদের কাছে খুব আকর্ষণীয় ছিল। হজমিওয়ালার ঝুলিতে বা কাঁধে ঝোলানো ঝুরিতে আরেকটি কাঁচের শিশি থাকত। তার মধ্যে থাকত পানির মতো দেখতে এক ধরণের ক্যামিকেল। প্রথমে ক্রেতার চাহিদা মতো ছোট কাগজের টুকরায় একপয়সা বা দুই পয়সার হজমি রাখা হতো। তার মধ্যে তরল ক্যামিকেলের এক দুই ফোটা ফেলা হতো। সাথে সাথে এক মুহূর্তের জন্য ধপ করে আগুন জ্বলে উঠত। এভাবে প্রস্তুত হতো হজমি। হজমি বিক্রি করেই এই দরিদ্র পেশাজীবীরা তাদের সংসার নির্বাহ করত।
আরেক শ্রেণির পেশাজীবী শিংয়ের তৈরি চিরুনি আর বোতাম বিক্রি করত। কাঁচামাল হিসেবে প্রথমে গরু ও মহিষের শিং যোগাড় করতে হতো। এ কারণে এই পেশার সাথে জড়িত কিছু মানুষ বাড়ি বাড়ি ঘুরে, কসাইয়ের দোকান বা ভাগাড় থেকে সংগ্রহ করত পশুর শিং। তারা এগুলো বিক্রি করত চিরুনি তৈরির কারখানায়। শিং দিয়ে চিরুনি, বোতাম ইত্যাদি তৈরির কারিগরদের সাধারণ পরিচয় ছিল ‘খুন্দিগর’ নামে। এই অদ্ভুত নামটি এসেছে ফারসি শব্দ ‘কুন্দিকার’ শব্দ থেকে। মোগল শাসন পর্বে ঢাকায় ব্যবসা ও চাকরির আশায় অনেক ইরানি এসে বসবাস শুরু করে। তাদের মাধ্যমে অনেক ফার্সি শব্দও প্রবেশ করে ঢাকাইয়া ভাষায়।
গত শতকের চল্লিশের দশকেও ঢাকার নবাবগঞ্জে খুন্দিগড়দের কয়েকটি কারখানা ছিল।
সমসাময়িক সূত্রে এসব কারখানার উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়। প্রথমে শিংগুলো আগুনের উত্তাপে নরম করা হতো। তারপর কাঠ বা লোহার চাপে তাকে করা হতো সোজা এবং চ্যাপ্টা। এক ধরনের ধারালো অস্ত্র দিয়ে প্রয়োজনমতো কেটে চিরুনি ও বোতাম বানানো হতো। এসব চিরুনি বা বোতাম বিক্রি হতো কলুটোলার হাটে।
বিশ শতকের আগে কাপড় ধোয়ার জন্য ঢাকায় বিদেশি সাবান সহজলভ্য ছিল না। এই অভাব পূরণে স্থানীয়ভাবে এক ধরনের সাবান তৈরি হতো। ছোট আকারের ফুটবলের মতো গোলাকৃতি হতো এই সাবানগুলো। সাধারণের কাছে এই কাপড় ধোয়ার সাবান বাংলা সাবান নামে পরিচিত ছিল। ঢাকাইয়া ভাষায় সাবানকে বলা হতো ‘সাবুন’। এ কারণে জনপ্রিয় এই সাবানকে ঢাকার মানুষ বলতো ‘বাংলা সাবুন’পরে ‘বাংলা সাবান’নামটি দেশজুড়ে প্রচলিত হয়ে যায়। ঢাকায় এই সাবান বিক্রেতারা পরিচিত ছিল ‘সাবুনওয়ালা’নামে। কোনো কোনো সূত্র দাবি করে ঢাকার বাংলা সাবান ভারত ও আশপাশের কয়েকটি দেশে রপ্তানি হতো।
প্রথম দিকে বাংলা সাবানের কারখানাগুলো গড়ে ওঠে চকবাজারের কাছে। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হবে ছোট কাটরার আশপাশে। সাবানের কারখানায় অনেক শ্রমিক নিয়োগ করতে হতো। একদল শ্রমিক বড় কড়াইয়ে সাবানের উপকরণ জ্বাল দিত। এরপর আরেকদল শ্রমিক মণ্ড তৈরি করত। কেউ পিটিয়ে গোলাকার রূপ দিত।
সাবান তৈরির একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া রয়েছে। প্রথমে একটি বড় পাত্রে সোডা, ক্ষার ও চুন পানির সঙ্গে মিশিয়ে জ্বাল দেওয়া হতো। এরপর এগুলো কয়েকদিন ঠান্ডা অবস্থায় রেখে দিত। পরে যত্ন করে ফেলে দেওয়া হতো তলানির ময়লা। তারপর পশুর চর্বি অথবা তিলের তেল মিশিয়ে আবার জ্বাল দেওয়া হতো। সাবানের মান নির্ভর করত কত বেশি জ্বাল দেওয়া হয়েছে তার ওপর। ভালো মানের সাবান তৈরির জন্য ১৪-১৫ দিন সময় লেগে যেত।
খুচরা দোকানিরা বাংলা সাবান সের দরে বিক্রি করত। এক একটি সাবানের গোলা এক সের সোয়া সের পর্যন্ত হতো। যাদের অল্প প্রয়োজন ঝুলিয়ে রাখা তার দিয়ে কেটে টুকরো করে তাদের কাছে বিক্রি করা হতো। এখনো বাংলা সাবান একেবারে হারিয়ে যায়নি।