ঢাকার কথা ২৩
বিলুপ্তপ্রায় বিচিত্র পেশা
বর্তমানে দালানকোঠা নির্মাণ উপকরণে অনেক আধুনিক জিনিসপত্র যুক্ত হয়েছে। নির্মাণ রীতিতেও এসেছে পরিবর্তন। তবে প্রাচীন যুগ থেকে শুরু করে ঔপনিবেশিক যুগ পর্যন্ত নির্মাণ উপকরণের দিক থেকে বড় রকমের পরিবর্তন হয়নি। শুধু ঔপনিবেশিক যুগে ইউরোপীয় রীতি প্রবেশ করতে গিয়ে লোহার গ্রিল, ছাদের নিচে বিম এবং বিশেষ ধরনের মোজাইক ও টাইলসের ব্যবহার যুক্ত হয়েছে। আরসিসি অর্থাৎ রড, কংক্রিট ও সিমেন্টের ব্যবহারের মতো আধুনিক উপকরণ ও প্রযুক্তির ব্যবহার তখনো শুরু হয়নি। বরাবর বালু সিমেন্টের বিকল্প ছিল চুন-সুরকি।
চুন-সুরকির গাঁথুনিতে ইট বসিয়ে দেয়াল তৈরি সহজ হলেও ছাদ নির্মাণ সহজ ছিল না। ছাদের চুন-সুরকির আস্তরণ জমাট বাধাতে- বিশেষ করে ছাদ শক্ত করতে ও বৃষ্টির পানি শোষণ রোধ করার জন্য নির্মাণের সময় ছাদ পেটাতে হতো। কোনো নির্মীয়মাণ ইমারতে ছাদ পিটানোর ছন্দে ছন্দে ধুপ ধুপ শব্দ ঢাকাবাসীর বেশ পরিচিত ছিল।
ছাদ পেটাতে অনেক শ্রমিকের প্রয়োজন হতো। ইংরেজ শাসন যুগে বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদার আর ব্যবসায়ীদের হাতে গোনা পাকা দালান ছাড়া বেশির ভাগ দালান তৈরি হতো ঢাকাতে। তাই ঢাকাতে ছাদ পেটানোর একটি পেশাজীবী শ্রেণী গড়ে ওঠে। ছাদে চুন সুরকির ঢালাই দেওয়ার পর ছাদ পেটানো শ্রমিক দল এক ধরনের মুগুর দিয়ে তালে তালে ছাদ পেটাতে থাকত। সাধারণত কিশোর বয়সের ছেলেদের ছাদ পেটানোর কাজে নিয়োগ করা হতো। একজন ‘সর্দারে’র তত্ত্বাবধানে এই শ্রমিকদল কাজ করত।
সাধারণত সর্দার এক হাতে ছাতা নিয়ে রোদ থেকে মাথা বাঁচাতেন আর অন্য হাতে একটি লম্বা বেত রাখতেন। কিশোররা যাতে কাজে ফাঁকি না দেয় তাই হাতে এই বেত রাখা। মাঝেমধ্যে হাওয়ায় বেত নাড়িয়ে শপাং শপাং শব্দ তুলতেন। তাতেই ভয় পেয়ে যেত কিশোর শ্রমিকরা। কাজে উৎসাহ দেওয়া বা গতি আনার জন্য একজন গায়ক রাখা হতো। তিনি বেহালা বাজিয়ে গানের একটি কলি টান দিতেন। শ্রমিকরা দোহারের মতো পরের লাইনে সুর তুলে তালে তালে ছাদ পেটাত। দৈনিক মজুরির ভিত্তিতে এসব ছাদ পেটানো শ্রমিক নিয়োগ করা হতো।
১৯৬৪ সালে তদানীন্তন পূর্বপাকিস্তানে টেলিভিশনের যাত্রা শুরুর আগে সিনেমা হলে গিয়ে সিনেমা দেখা ছিল একমাত্র আধুনিক বিনোদন। তা ছাড়া যাত্রা থিয়েটারের ধারা তো ছিলই। কিন্তু এসব বিনোদন মাধ্যম ঢাকার সাধারণ পরিবারের কিশোর কিশোরীদের কাছে সহজলভ্য ছিল না। বিনোদনের এই শূন্যতা পূরণে এক ধরনের পেশাজীবী ভূমিকা রাখেন। এঁরা ছোটদের কাছে বায়োস্কোপওয়ালা নামে পরিচিত ছিলেন। বায়োস্কোপওয়ালারা একটি তিন কোণাকার কাঠের বাক্স এবং বাক্স বসানোর জন্য একটি স্ট্যান্ড নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। ছোটদের আকৃষ্ট করতে তাদের অনেকের পরনে থাকত সঙদের মতো রঙিন কাপড়ের তালি দেওয়া পোশাক। পায়ে পরতেন ঝুমুর। এক হাতে থাকত ঝুনঝুনি।
বায়োস্কোপওয়ালারা সাধারণত স্কুলের কাছে বা জনবহুল এলাকায় রাস্তার ধারে বাক্স স্ট্যান্ডে বসিয়ে ঝুনঝুনি বাজিয়ে ছোটদের আকৃষ্ট করতেন। কখনো কোনো বাড়ি থেকে ডাক এলে বাড়ির ভেতরে উঠোনে বায়োস্কোপের আসর বসত। বাক্সের তিনদিকে মুড়ির টিনের মুখের মতো ফোকর থাকত। সেখানে বসানো থাকত আতশ কাচ। দুই পয়সা এক আনার বিনিময়ে বায়োস্কোপ দেখা যেত। দর্শকরা একেকজন একেক ফোকরে চোখ রেখে দাঁড়াত। শুধু ছোটরা নয় অনেক সময় বয়স্করাও বায়োস্কোপের দর্শক ছিলেন। বাক্সের ভেতরে বিপরীত দিকে একটি দণ্ডে ধারাবাহিকভাবে অনেক রঙিন ছবি বসানো কাগজ রোল করা থাকত। ছবি বসানো কাগজের একটি দিক অন্য প্রান্তের দণ্ডে লাগানো হতো। এক প্রান্তের দণ্ড ঘোরালে ছবিগুলো ধারাবাহিকভাবে চলে আসতে থাকত। আতশ কাচের কারণে ছবিগুলো বড় আকারে দেখা যেত।
এগুলোর মধ্যে থকত, তাজমহল, কুতুব মিনার, ষাটগম্বুজ মসজিদ, রয়েল বেঙ্গল টাইগার, বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা, কবি এসব ছবি। বায়োস্কোপওয়ালার ছবি দেখানোর অদ্ভুত ভঙ্গি ছিল। তারা ঝুমুরের শব্দ তুলে ঝুনঝুনি বাজিয়ে সুরে সুরে ছবিগুলোর বর্ণনা দিতে থাকত। ছোটদের কাছে বায়োস্কোপ সে যুগে জনপ্রিয় বিনোদন ছিল।