ঢাকার কথা ২৮
ঢাকার নৌ যোগাযোগে স্টিমার
বাংলায় ইংরেজ শাসন যুগে চাকা সংযুক্ত জাহাজ প্রবর্তন নৌ যোগাযোগের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের শুরুতে ঢাকার যানবাহনের তালিকায় যুক্ত হয় স্টিমার। এই বিশেষ ধরনের জাহাজ স্টিমার নামে পরিচিত হওয়ার প্রধান কারণ হচ্ছে, স্টিম ইঞ্জিনের শক্তিতে তা চালিত হতো। চাকাচালিত জাহাজ চলাচলের ইতিহাস অনেক পুরোনো। চাকাযুক্ত জাহাজের প্রাচীনত্বের কথা নানা সূত্রে জানা যায়। সূত্রমতে, চার ও পাঁচ শতকে রোমে প্রথম প্যাডেল জাহাজের প্রচলন হয়। পরে তা ইউরোপের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চীন সবার আগে প্যাডেল জাহাজ ব্যবহার শুরু করেছিল। উপমহাদেশে প্যাডেল স্টিমার চালু হয় ইংরেজ শাসন যুগে সামরিক প্রয়োজনে এবং বাণিজ্যিক প্রয়োজনে।
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহ ভারতে ইংরেজ শাসনের ভিত্তিমূলে বড় ঝাঁকুনি দিয়েছিল। ফলে নানা দিক থেকে ইংরেজ শাসকরা সতর্ক হয়ে পড়ে। এরই ধারাবাহিকতায় শাসকরা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে পদক্ষেপ নেয়। প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ব্রিটিশ স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’। এই কোম্পানি ১৮৫২ সালে ‘ঢাকা এ- আসাম লাইন’ নামে জাহাজ চলাচল শুরু করে। ক্রমে ঢাকা-কলকাতা ও আসামের মধ্যে স্টিমার যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়।
প্রথম দিকে নানা সীমাবদ্ধতার জন্য স্টিমার নিয়মমতো চলত না। ধীরে ধীরে আরো কতগুলো স্টিমার কোম্পানি এই পথে স্টিমার চালানো শুরু করে। বাষ্পীয় ইঞ্জিনের এই স্টিমারগুলোতে জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করা হতো। বাষ্পীয় শক্তিতে জাহাজের দুই পাশের প্রপেলার বা চাকা ঘুরে। চাকা পানি কেটে এগিয়ে নেয় জাহাজটিকে।
কলকাতা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়েছিল ১৮৬২ সালের নভেম্বরে। ফলে কলকাতার সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগের জন্য ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত নৌ যোগাযোগের প্রয়োজন অনুভূত হয়। অবশেষে ঢাকার কমিশনার বাকল্যান্ডের চেষ্টায় ঢাকা থেকে কুষ্টিয়া পর্যন্ত স্টিমার চলাচল শুরু হয়। এরপর রেললাইন আরো বিস্তৃত হয়। রেললাইন টেনে আনা হয় গোয়ালন্দ পর্যন্ত। ফলে স্টিমার যাতায়াতের নতুন রুট তৈরি হয়। ঢাকার উপকণ্ঠে নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরের মর্যাদা লাভ করে। এ পর্যায়ে নারায়ণগঞ্জ থেকে গোয়ালন্দ পর্যন্ত স্টিমার চলাচল শুরু হয়। এরই মধ্যে নারায়ণগঞ্জ থেকে ঢাকায় রেল যোগাযোগ শুরু হয়েছিল। তাই নৌবাণিজ্য নারায়ণগঞ্জের মধ্য দিয়ে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যায়।
ধীরে ধীরে দুটি স্টিমার লাইন চালু হয়। একটি পদ্মা-মেঘনা নদীকে অবলম্বন করে, অন্যটি যমুনা নদীকে অবলম্বন করে। দুই রুটেই ‘রিভার স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’ ও ‘ই-ন্ডিয়ান জেনারেল স্টিম নেভিগেশন কোম্পানি’র জাহাজ চলাচল করত। জাহাজগুলো মালপত্র, আরোহী, ডাক ইত্যাদি নিয়ে গোযালন্দ থেকে পদ্মা, মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা দিয়ে নারায়ণগঞ্জে আসত এবং নারায়ণগঞ্জ থেকে সিলেট, কাছাড়, চাঁদপুর, বরিশাল প্রভৃতি স্থানে যেত।
যমুনা নদীকে কেন্দ্র করে চলা স্টিমার সাধারণত ‘আসাম লাইন’ নামে পরিচিত ছিল। এ লাইনের স্টিমার গোয়ালন্দ থেকে পশ্চিম দিক দিয়ে যমুনার পথে আসাম যাতায়াত করত। এই পথে আরিচা ছিল অন্যতম স্টেশন।
বর্ষাকালে আরেকটি বিশেষ স্টিমার সার্ভিস চালু ছিল। এটি ‘ধলেশ্বরী স্টিমার সার্ভিস’ নামে পরিচিত। এই সার্ভিসের স্টিমার গোয়ালন্দ থেকে ধলেশ্বরীর পথে ঢাকার উপকণ্ঠ সাভার পর্যন্ত চলাচল করত। ‘সুন্দরবন ডেসপাচ’ নামে এক কোম্পানির জাহাজ সপ্তাহে একবার কলকাতা থেকে মালপত্র নিয়ে বঙ্গোপসাগর ঘুরে সুন্দরবনের পথে নারায়ণগঞ্জ আসত। বিক্রমপুরের কু-উপাধিধারী জমিদারদের জাহাজ কলকাতা থেকে মালপত্র নিয়ে নারায়ণগঞ্জ, লৌহজং প্রভৃতি স্থানে যাতায়াত করত।
পাকিস্তান আমলের শেষ দিক থেকে নারায়ণগঞ্জ নৌ বন্দরের গুরুত্ব হারাতে থাকে। ঢাকায় বুড়িগঙ্গার তীরে নৌবন্দর প্রতিষ্ঠিত হয়। স্টিমারের ঘাট প্রতিষ্ঠিত হয় সদরঘাটের কাছে বাদামতলীতে। গোয়ালন্দ নৌবন্দরের গুরুত্ব হারিয়ে ফেলেছিল অনেক আগেই। স্টিমারের শেষ রুট হিসেবে অদ্যাবধি টিকে রয়েছে ঢাকা-খুলনা সার্ভিস।