ঢাকার কথা ২৯
মোগল স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য ও হাজি খাজা শাহবাজ মসজিদ
সুলতানি শাসন পর্ব ও মোগল শাসন পর্বে নির্মিত স্থাপত্যে বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে অনেক পার্থক্য রয়েছে। সুলতানি যুগের একটি বড় সময় বাংলার সুলতানরা দিল্লির সুলতানদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘোষণা করে বাংলায় একটি স্বাধীন সার্বভৌম শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এ পর্বে বাংলা উত্তর ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এ সময় রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে নির্মিত স্থাপত্যের সিংহভাগই ছিল মসজিদ। স্থানীয় কারিগরদের ওপর নির্মাণের দায়িত্ব থাকায় তাঁরা অনেকটা স্বাধীনতা ভোগ করেছিলেন। যে কারণে সুলতানি বাংলার স্থাপত্যে দেশীয় প্রভাব অনেক বেশি ছিল। এ পর্বে কারিগররা দেয়ালে প্লাস্টার করার পদ্ধতি জানত না। তাই চুন সুরকির গাঁথুনিতে লাল ইট বসানো হতো। প্লাস্টারের বিকল্প হিসেবে অনেক ক্ষেত্রে পোড়ামাটির ফলক ব্যবহার করা হতো। বৃষ্টির পানি যাতে গড়িয়ে পড়তে পারে তাই ছাদ হতো কিছুটা ঢালু। গম্বুজগুলো হতো উল্টানো পেয়ালার মতো এবং নিরাভরণ। মসজিদের চারকোণে চারটি মিনারের মতো স্তম্ভ ছাদ পর্যন্ত উঠে যেত। এগুলো কর্নার টাওয়ার বা বুরুজ নামে অভিহিত করা হয়। এমনি আরো সব বৈশিষ্ট্য রয়েছে।
মোগল যুগে এসব বৈশিষ্ট্যের রূপান্তর ঘটে। এ পর্বে বাংলা তার স্বাধীনতা হারায়। দিল্লির প্রদেশ বা সুবায় পরিণত হয় বাংলা। দিল্লি থেকে প্রশাসক বা সুবাদার পাঠানো হয়। তাঁদের তত্ত্বাবধানে উত্তর ভারতীয় মোগল রীতিতে তৈরি হতে থাকে ঢাকার স্থাপত্য। মোগল যুগে প্লাস্টার ব্যবহার পদ্ধতি জানা হয়ে গিয়েছিল। তাই স্থাপত্যের দেয়াল চুন সুরকির প্লাস্টারে ঢেকে দেওয়া হতে থাকে। ফলে পোড়ামাটির ফলক ব্যবহার কমে যায়। বাঁকানো ছাদের বদলে সমতল ছাদ তৈরি হতে থাকে। মসজিদের গম্বুজ হয় ফিনিয়াল সমৃদ্ধ। কর্নার টাওয়ারগুলো হয় অপেক্ষাকৃত সরু এবং তা ছাদ অতিক্রম করে মিনারের মতো উপরে উঠে যায়। এ যুগে ঢাকা মোগল রাজধানী হওয়ায় এবং সুবাদাররা ঢাকায় অবস্থান করায় মোগল পর্বের বাংলাদেশে অধিকাংশ ইমারত ঢাকাতেই নির্মিত হয়েছিল।
হাজি খাজা শাহবাজ মসজিদ ও সমাধি
মোগল যুগের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী হাজি খাজা শাহবাজ এই মসজিদ নির্মাণ করেন। বর্তমান ঢাকায় বাংলা একাডেমি ও দোয়েল চত্বরের মাঝামাঝি পূর্ব দিকে বাংলাদেশ শিশু একাডেমির সীমানা প্রাচীরের ভেতর এই মসজিদটি অবস্থিত। তবে আলাদা একটি প্রাচীর বেস্টনি দিয়ে মসজিদ-সমাধি কমপ্লেক্সটির স্থান সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। এটি মোগল স্থাপত্যশৈলীর এক অনুপম শৌকর্য সমৃদ্ধ মসজিদ। হাজি খাজা শাহবাজ ১৬৬৯ খ্রিস্টাব্দে এই মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন।
মোগল রীতি অনুযায়ী মাটি থেকে কিছুটা উঁচু প্লাটফরম তৈরি করে তার ওপর মসজিদ ভবনটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তিন গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদে তিনটি প্রবেশ দরজা রয়েছে। দরজাগুলোতে আছে খাঁজকাটা খিলান। গম্বুজের চূড়ায় যুক্ত রয়েছে পদ্ম ও কলস মোটিভ। চারটি কর্নার টাওয়ার ছাড়াও দরজাগুলোর দুই পাশে একটি করে মোট চারটি ছোট স্তম্ভ রয়েছে। এই স্তম্ভগুলোও ছাদ ছাড়িয়ে কিছুটা উপরে উঠে গেছে। চূড়াগুলো মিনারের মতো। এসব মিনারের চূড়ায়ও রয়েছে চমৎকার কলস নকশা। মসজিদের বাইরে পাথরের ভিত ব্যবহার করা হয়েছে। মসজিদের দেয়ালে খোপ নকশা করে দেওয়া হয়েছে দৃষ্টিনন্দন রূপ। মিহরাবেও চমৎকার সব নকশা কাটা হয়েছে।
মসজিদের উত্তর-পূর্ব কোণে মসজিদের দেয়াল সংলগ্ন সমাধিটি মনে করা হয় নির্মাতা হাজি খাজা শাহবাজের। এটি মোগল রীতিতে নির্মিত সমাধি। মূল কবরের ওপর একটি নকল কবর তৈরি করা হয়েছে। প্রধান সমাধি কক্ষের দক্ষিণ দিকের বারান্দাটি সুন্দর দোচালা কুঁড়েঘরের আদলে গড়া। অন্যসব স্তম্ভ, খিলানও নকশা মসজিদেরই অনুরূপ।