ঢাকার কথা ৩১
লালবাগ দুর্গ হাম্মাম
‘হাম্মাম’ আরবি শব্দ। হাম্মাম থেকে হাম্মামখানা শব্দটি হয়েছে। যার অর্থ স্নানাগার অর্থাৎ গোসলখানা। তবে সর্ব সাধারণের নয়; রাজকীয় গোসলখানাকে হাম্মাম বলা হয়। হাম্মাম একটি পূর্ণাঙ্গ স্নানাগার। এখানে সুইমিং পুলের মতো চৌবাচ্চা থাকে। মাটি থেকে কিছুটা উঁচুতে তৈরি করা হয় হাম্মাম। নিচে চুল্লি থাকে। সেখানে পানি গরম করা হয়। পাশে থাকে ঠাণ্ডা পানির আধার। গরম ও ঠাণ্ডা পানি পোড়ামাটির নল দিয়ে চৌবাচ্চায় সরবরাহের ব্যবস্থা থাকে। গোসলখানার পাশে থাকে পোশাক পরিবর্তন করার ঘর। থাকে বিশ্রাম কক্ষসহ আরো অনেক কক্ষ। এভাবে হাম্মাম হয়ে ওঠে একটি জটিল স্থাপত্য। মুসলিম সভ্যতায় তুরস্কে ও পারস্যে হাম্মামের ব্যবহার রয়েছে। মুসলমানরা হাম্মামের ধারণা পেয়েছিল রোমানদের কাছ থেকে। মোগল যুগে ইরানের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় বাংলার। হাম্মাম স্থাপত্যের ভাবনা এভাবেই পারস্য থেকে বাংলায় চলে আসে।
বাংলাদেশে যে কটি হাম্মাম টিকে আছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জাঁকালোটি হচ্ছে লালবাগ দুর্গ হাম্মাম। লালবাগ দুর্গ তৈরির প্রথম দিকে হাম্মামটি আওরঙ্গবাদ হাম্মাম নামে পরিচিত ছিল। কারণ তখন এই দুর্গটিকেই বলা হতো ‘কিল্লা আওরঙ্গবাদ’। লালবাগ দুর্গের ভেতরে এই হাম্মামটি অবস্থিত। দুর্গের পূর্ব-দক্ষিণে একটি দ্বিতল ইমারতের একাংশে হাম্মামের অবস্থান। এই ইমারত হাম্মাম ছাড়াও দিউয়ানি আম, দরবারঘর, দরবার হল ইত্যাদি নামে পরিচিত। বাংলাদেশে মোগল আমলে গড়া ছয়টি হাম্মাম পাওয়া গেছে। তবে কোনোটিতেই শিলালিপি পাওয়া যায়নি যে কারণে নির্মাণকাল সুনির্দিষ্ট করা যায় না। সে যুগের কয়েকটি ইতিহাসের সূত্র থেকে জানা যায় শাহজাদা মোহাম্মদ আজম ১৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে লালবাগ দুর্গ নির্মাণ শুরু করেছিলেন। পরের বছর তাঁকে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হয়। ফলে অসমাপ্ত দুর্গের কাজ এগিয়ে নেন পরবর্তী সুবাদার শায়েস্তা খান। নানা তথ্যের সূত্রে অনুমান করা হয় শাহজাদা আজমের হাতেই এই হাম্মামটি নির্মিত হয়েছিল।
লালবাগ দুর্গ হাম্মামের প্রথম তলাতে রয়েছে সিঁড়িঘর, বিশ্রাম কক্ষ, সদর কক্ষ, পরিচারিকা কক্ষ, শৌচাগার, জলসংরক্ষণ কক্ষ, স্নানকক্ষ, পোশাক পরিবর্তন কক্ষ, চুল্লিকক্ষ ইত্যাদি। এই ইমারতের দ্বিতীয় তলায় তিনটি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় কক্ষটি ইমারতের সবচেয়ে বড় কক্ষ। কোণাগুলো কেটে কক্ষটিকে অষ্টভুজাকৃতির রূপ দেওয়া হয়েছে। কক্ষের প্রবেশ পথগুলো তৈরি করা হয়েছে পাথরের স্তম্ভের ওপর। ধারণা করা হয় সুবাদাররা দ্বিতীয় তলাটিকে দরবার ঘর হিসেবে ব্যবহার করতেন। হম্মাম ইমারতের কিছুটা পূর্ব দিকে রয়েছে একটি পকুর। হয়তো এই পুকুর থেকেই হাম্মামের পানি সরবরাহ করা হতো।
১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে বাংলার রাজধানী মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করার পর ঢাকার লালবাগ দুর্গ প্রায় পরিত্যক্ত হয়ে যায়। এ সময় হাম্মামটিও এর ঔজ্জ্বল্য হারাতে থাকে। শায়েস্তা খান ঢাকা ছেড়ে যাওয়ার আগে হাম্মাম ও সংলগ্ন ইমারত রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব উত্তরাধিকারীদের ওপর ন্যাস্ত করেছিলেন। কিন্তু দুর্বল উত্তরাধিকারীরা সংরক্ষণের দায়িত্ব সুনিপুণভাবে সম্পন্ন করতে পারেননি। ফলে এগুলো নষ্ট হয়ে যেতে থাকে। হাম্মামটি জীর্ণ হয়ে পড়ে উনিশ শতকের প্রথম দিকেই। সংস্কারের অভাবে পুকুরটি মজে যেতে থাকে। ঢাকায় পৌরসভা গড়ে ওঠার আগে ‘ঢাকা কমিটি’ নগরের দেখাশোনা করত। এই ঢাকা কমিটি ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে শহরের বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে রূপদানের জন্য লালবাগ দুর্গ সংস্কারের দায়িত্ব নেয়। এই সময় শায়েস্তা খানের উত্তরাধিকারী হিসেবে দুর্গের মালিকানার দাবিদার ছিলেন তিনজন। এঁরা হচ্ছেন মালিক মজহর আলী খান, সালেহা খানম এবং রওশন আলী খান। এঁদের সাথে ঢাকা কমিটি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি অনুযায়ী দুর্গটি ব্যবহারের জন্য মালিক পক্ষকে বছরে ষাট টাকা দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। চুক্তি সম্পাদনের আগে প্রথম দিকে হাম্মামটির মালিক ছিলেন পাদরি শেফার্ড। চুক্তির এক অংশে বলা হয় আওরঙ্গবাদ হাম্মামটি পাদরি জাহা নিলামে কিনে নিয়েছেন। ঢাকা কমিটি দুর্গটির পত্তনি নেওয়ার পর ১৮৪৪ থেকে ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে হাম্মামটির সংস্কার করে।
সিপাহী বিদ্রোহের পর উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে লালবাগ দুর্গে প্রথম অস্থায়ী সেনানিবাস এবং পরে পুলিশ রিজার্ভ ফোর্সের ব্যারাক করা হয়। এ সময় হাম্মামের কাছাকাছি কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছিল। এসব নির্মাণের ফলে হাম্মামের পানি সরবরাহ ব্যবস্থা এবং ইমারতের দক্ষিণ দিকের দেয়াল অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১৯৭৯-৮০ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর লালবাগ দুর্গ হাম্মামটি সংস্কার করে এই ইমারতটিকে একটি ছোট জাদুঘরে রূপান্তরিত করে।