ঢাকার কথা ৩৫
ঢাকায় মোগল শাসনের মধ্যাহ্ন
মোগল শাসন পর্বে উত্তর ভারত ও ইরানের সাথে যোগাযোগ উন্মুক্ত হয়ে যায় বাংলার। ফলে রাজধানী ঢাকায় ব্যাবসা বাণিজ্য ও শিল্পের বিকাশ ঘটতে থাকে। জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এ পর্বের সবচেয়ে তথ্য সমৃদ্ধ বর্ণনা জানা যায় পর্যটক সেবাস্টিন মানরিকের ভ্রমণ বৃত্তান্তে। তিনি ঢাকায় এসেছিলেন ১৬৪০ সালে। ততক্ষণে ঢাকায় মোগলদের প্রাদেশিক রাজধানী প্রতিষ্ঠার ৩০ বছর পার হয়েছে।
এ সময়ের ঢাকা শহরের সীমানা উল্লেখ করতে গিয়ে মানরিক পশ্চিম দিকের শেষ সীমানা হিসেবে মানেশ্বর নাম উল্লেখ করেছেন। স্থান নামটি পরিবর্তিত হওয়ায় এখন আর নিশ্চিত করে জায়গাটিকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না। মানরিকের মতে শহরের পরিধি পূর্ব দিকে নারিন্দা এবং উত্তর দিকে ফুলগারি পর্যন্ত প্রায় সাত কিলোমিটার বিস্তৃত ছিল। মানরিকের ফুলগারি এখনকার ফুলবাড়িয়ার সাথে অভিন্ন বলে মনে করা হয়। এই অঞ্চলটি ঘিরে নানা ধরনের ইমারত গড়ে উঠতে থাকে। মানরিকের প্রায় ২০ বছর পর ঢাকায় এসেছিলেন আরেকজন পর্যটক। নাম তাঁর মানুচি। তিনি উল্লেখ করেছেন তাঁর দেখা শহরগুলোর মধ্যে ঢাকা অপেক্ষকৃত ছোট শহর ছিল। কিন্তু এখানে লোক বসতি ছিল ঘন। সাধারণ মানুষের ঘরবাড়ি ছিল খড়ের তৈরি।
মানুচির কাছাকাছি সময়ে ১৬৬৬ সালে ঢাকায় আসেন পর্যটক টাভার্নিয়ার। তিনিও ঢাকাকে ঘনবসতিপূর্ণ শহর বলেছেন। টাভার্নিয়ারের সময় শহর আরেকটু বেড়েছিল। তাঁর হিসেবে ঢাকা নগরীর পরিধি এ সময়ে ছিল প্রায় সাড়ে নয় কিলোমিটার। ১৬৭০-এর দিকে টমাস বাউরি আসেন ঢাকায়। তাঁর বর্ণনায় অবাক করা তথ্য ছিল। মানুচির চার বছর পর চারপাশের শহরতলী মিলিয়ে ঢাকা শহরের পরিধি দাঁড়ায় প্রায় ষাট কিলোমিটার। এ কারণেই তিনি ঢাকা শহরকে বেশ প্রশস্ত শহর বলেছেন। এ পর্যায়ে উত্তর দিকে ঢাকা শহরের বিস্তার ঘটেছিল। এর বিশেষ কারণ ছিল। ঢাকা শহরের চারদিকে নিচু জলাভূমি থাকলেও উত্তর ও উত্তর-পূর্ব দিকে ছিল উঁচুভূমি। এ কারণে বর্তমান তেজগাঁও এলাকায় বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানি তাদের শিল্পকারখানা স্থাপন করতে থাকে।
মোগল যুগে ঢাকা শহরে সুবাদার এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের প্রসাদ বা বাড়ির কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়নি। এর বড় কারণ সম্ভবত ঢাকায় তাদের স্বল্প দিনের অবস্থান। বহির্ভারতের এই মোগল কর্মকর্তারা উত্তর ভারতের আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হলেও বর্ষাপ্রবণ ঢাকায় বসবাস করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। তাই তাঁরা অল্প দিন থেকে বদলি হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন। এ কারণে বড় কাটরা ছোট কাটরার মতো অস্থায়ী নিবাসে কালাতিপাত করতেন। ফলে বসবাসের জন্য স্থায়ী ইমারত গড়ায় মনযোগ দেননি।
ভারতে মোগল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৫২৬ সালে। ১৬১০ সালে সম্পূর্ণ বাংলায় মোগল অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। ঢাকা দখলের মধ্যদিয়ে মোগলদের বাংলা অধিকার সম্পন্ন হয়। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পরাজয়ের মধ্যদিয়ে প্রকৃত অর্থে ভারতে মোগল শাসনের অবসান ঘটেছিল। ১৫৭৬ সালে আফগান শাসনের অবসান ঘটিয়ে সম্রাট পশ্চিম ও উত্তর বাংলার অনেকটাই অধিকার করেছিলেন। পূর্ব বাংলার জয় বাকি রেখেই তখন বাংলা মোগল প্রদেশ বা সুবা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। পূর্ববাংলা অধিকারের কারণে ইসলাম খান চিশিতিই ১৬১০ সালে প্রথম পূর্ণাঙ্গ সুবা বাংলার সুবাদার হয়েছিলেন। ঢাকা এ সময় সুবা বাংলার রাজধানী হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ঢাকার সামাজিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে একটি বিকাশমান ধারা লক্ষ করা গিয়েছিল। গোটা মোগল শাসনপর্বে এই ধারা অব্যাহত থাকলে ঢাকার নাগরিক জীবনে অব্যাহত অগ্রগতি নিশ্চিত হতো। কিন্তু তেমনটি ঘটল না। বাংলার বেশির ভাগ সুবাদারই ঢাকাকে আপন করে নিতে পারেননি। দিল্লি থেকে দূরবর্তী অঞ্চল বলে এবং এখানকার আবহাওয়ার সাথে খাপ খাওয়াতে না পেরে সবাই বদলি হয়ে দিল্লি ফিরে যেতে চেষ্টা করেছেন। একমাত্র মীরজুমলা ও শায়েস্তা খান ছাড়া কেউ ঢাকার উন্নয়নের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন তেমন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায় না।