ঢাকার কথা ৩৬
ঢাকায় সিপাহী বিদ্রোহ
১৭৫৭ সালে ইংলিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের সাথে পলাশীর প্রান্তরে যুদ্ধ হয় বাংলার নবাব সিরাজদৌলার। যুদ্ধ জয়ের মধ্যদিয়ে ইংরেজদের হাতে চলে যায় বাংলার শাসন ক্ষমতা। এর ১০০ বছর পর ইংরেজদের হাত থেকে বাংলা ও ভারত মুক্ত করার চেষ্টা করা হয়। ১৮৫৭ সালে ভারতবর্ষে দেশীয় সৈন্যরা ইংরেজদের দেশছাড়া করতে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। একটি অসম শক্তির বিরুদ্ধে সিপাহীদের এই অসংগঠিত যুদ্ধে বিজয় লাভ সম্ভব হয়নি। ইংরেজ শাসক কঠোর হাতে বিদ্রোহ দমন করেছিল। তবুও ভারতবাসী স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় এই দেশীয় সিপাহীদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধার সাথে মূল্যায়ন করে। ইংরেজ লেখকরা একে সিপাহীদের বিদ্রোহ বলে খাটো করতে চাইলেও ভারতবাসীর চোখে তা স্বাধীনতার যুদ্ধ। সে সময়ের ভারতবাসীর একটি অংশ আজকের বাংলাদেশের মানুষ। এ দেশের মানুষ ১৯৭১ পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য আরো লড়াই করেছে। তাই ধারণাকে সুনির্দিষ্ট করার জন্য আমরা বর্তমান প্রসঙ্গে ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ কথাটিই ব্যবহার করেছি।
ঢাকার সিপাহীরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। এ সম্পর্কে তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণ পাওয়া যায় মি. ব্রেনান্ডের ডায়েরিতে। এই ইংরেজ শিক্ষাবিদ তখন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর বর্ণনা থেকে জানা যায় এসময় একটি সেনাছাউনি ছিল লালবাগ দুর্গের ভেতর। এখানে ৭৩ জন দেশীয় পদাতিক সৈন্য ছিল। ২২ নভেম্বর অর্থাৎ ১০ মহররম ব্রিটিশ প্রশাসন সিদ্ধান্ত নেয় যে সরকারি খাজাঞ্চি পাহারায় থাকা দেশীয় সৈন্য ও লালবাগ দুর্গে অবস্থানরত সৈন্যদের কাছ থেকে অস্ত্র তুলে নেওয়া হবে। খাজাঞ্চি পাহারায় থাকা ট্রেজারি গার্ডদের অস্ত্র কেড়ে নেওয়া হলো নির্বিবাদেই। কিন্তু সমস্যা হলো লালবাগ দুর্গে। সকাল ৫টায় ব্রিটিশ নৌসেনারা সৈন্যদের অস্ত্রমুক্ত করতে যায়। এখানে তারা প্রতিরোধের মুখোমুখি হয়। দুর্গের দক্ষিণ-পূর্বের তোরণ সংলগ্ন দুর্গ দেয়ালের ভাঙ্গা অংশ দিয়ে ইংরেজ সৈন্যরা ঢোকার চেষ্টা করলে সেখানে শুরু হয় সংঘর্ষ। ইংরেজ সৈন্যদের তুলনায় খুব সামান্য সৈন্য ও অস্ত্রবল ছিল দেশীয় সিপাহীদের। সিপাহীরা পরীবিবির কবরে কাছাকাছি কামান স্থাপন করে গোলা ছুড়তে থাকেন। ইংজেরাও শক্তিবৃদ্ধি করে। কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পর কোনঠাসা হয়ে পড়েন স্বাধীনতা সংগ্রামীরা। ব্রিটিশ সৈন্যদের বুলেট আর বেয়োনেটের আঘাতে প্রায় ৪০ জন্য সিপাহী মৃত্যুবরণ করেন আর আহত হন অনেকে। বাকিদের কেউ কেউ পেছনের জঙ্গল পথে পালিয়ে যান। জীবিত বেশ কয়েকজন সৈন্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিহত সৈন্যদের লালবাগ দুর্গের ভেতরে পুকুরে ছুড়ে ফেলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শী অনেক মানুষ এই ঘটনার লোমহর্ষক বিবরণ দিয়েছেন। অনেক কল্প কাহিনী ও তৈরি হয়েছে। স্থানীয় অনেকে দাবি করতেন লালবাগ দুর্গের ভেতর মৃত সৈন্যদের আত্মা রাতে ঘুরে বেড়ায়। আর করুণ স্বরে বলতে থাকে ‘ভাই একটু পানি দাও’।
চকবাজার ও আণ্টাঘরের ময়দানে গাছে ঝুলিয়ে বন্দি সিপাহীদের ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। সদরঘাটের কাছে আজকের বাহাদুরশাহ পার্কটিই ছিল সেকালের আন্টাঘরের ময়দান। সবচেয়ে বেশি বিদ্রোহীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল এই ময়দানের বটগাছে। শুধু তাই নয় মানুষ যাতে ভীত হয় এবং ইংরেজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সাহস না পায় তাই ফাঁসি দেওয়া মৃতদেহ কয়েকদিন প্রকাশ্যে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
ইংরেজরা তাদের ‘বীরত্বের’ স্মৃতি জাগরুক রাখার উদ্দেশ্যে পরবর্তী সময়ে তাদের রারি ভিক্টোরিয়ার নামে এখানে একটি পার্ক গঠন করে। এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করেন ইংরেজ সমর্থক ঢাকার নবাবরা। নবাব আবদুল গনি এই পার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ইংরেজ শাসন অবসানের পর এ দেশের মানুষ নতুনভাবে মূল্যায়ন করে। তারা স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা নামেমাত্র মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহের নামে নতুনভাবে নামকরণ করেন এই পার্কটির। সেই থেকে এই পার্কটির নাম হয়ে যায় বাহাদুরশাহ পার্ক।