সলিমুল্লাহ খানের প্রবন্ধ
কাজীর বিচার : ফররুখ আহমদের আবেহায়াত
‘ভারতের পশ্চিমপ্রান্তে মহাকবি ইকবাল অবশ্য অনেক আগেই সন্ধান দিয়েছিলেন আবেহায়াতের। তাঁর দেশকালজয়ী প্রতিভার সঙ্গে নজরুলের তুলনা করতে যাওয়া বাতুলতা।’-ফররুখ আহমদ (১৯৯৬: ৩২৭)
বাংলাদেশের জাতীয় সমাজে ফররুখ আহমদ মোটের উপর গোটা দুই ধারণার শিকার। কেহ কেহ একদা ধরিয়া লইয়াছিলেন ফররুখ আহমদ নজরুল ইসলামের উত্তরাধিকারী, কাহারও কাহারও মতে এমনকি অনুসারীও। কেহ বা আবার মনে করেন, কবিতায় তিনি খোদ নজরুল ইসলামকেও ছাড়াইয়া গিয়াছিলেন। আরেক দল আছেন মনে করেন তুলনা বৃথা, নজরুল ইসলাম আর ফররুখ আহমদ দুই ভিন্ন মেরুর দুই জল অচল কবি। এদিকে যতদূর দেখিতেছি নজরুল ইসলামকে লইয়া খোদ ফররুখ আহমদ কি ভাবিতেন খুব কম বিচারকই তাহার বিচার করিয়াছেন। এই নিবন্ধে আমরা নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে ফররুখ আহমদের বিবেচনা পর্যালোচনা করিব। আমরা দেখিব, ফররুখ আহমদ নজরুল ইসলামের সাক্ষাৎ নিজেকে অনেক বড় কবি মনে করিতেন।
তাঁহার দ্বিতীয় সংস্কারের নাম ‘মহাকবি’ ইকবাল। অহং তেমন ছোট ছিল না বিধায় ফররুখ আহমদ মাঝে মাঝে ইকবালকে সামনে দাঁড় করাইয়া- নজরুল ইসলামকে ছোট কল্পনা করিয়া- আনন্দ পাইতেন। সৈয়দ আলী আহসান বয়সে ফররুখ আহমদের কিছু কনিষ্ঠ আর চিন্তাভাবনায় বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে এই দুইজনের বিচার-বিবেচনা পাঠ করিলেও মনে হয় দুই বিচারক যেন এক সারিতে বসিয়া বিচারকার্য সারিতেছেন। ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত’ নামক কেতাবে- ১৯৫৬ সালের কথা- সৈয়দ আলী আহসান যাহা লিখিয়াছিলেন তাহার সহিত ফররুখ আহমদের বক্তব্য তুলনা করিলে আমি কি বলিতে চাহিতেছি তাহা যৎসামান্য পরিষ্কার হয়। সৈয়দ আলী আহসান লিখিয়াছিলেন:
‘নজরুল ইসলামের সর্বপ্রধান বিশিষ্টতা হচ্ছে তাঁর সাময়িকতা। সাময়িক ঘটনা, সাময়িক জীবন, অথবা কোন সাময়িক আবেগকে অবলম্বন করে এত প্রচুর কবিতা তাঁর মত আর কেউ লিখতে পারেনি। এদিক থেকে ইংরেজ কবি কিপলিঙ্গের সঙ্গে তাঁর মিল আছে। কিপলিঙ্গ সম্পর্কে টি.এস. এলিয়ট বলেছেন যে কিপলিঙ্গ কাব্যক্ষেত্রে সাংবাদিকতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন এবং অধিকাংশ মুহ‚র্তেই শিল্পায়ত্ত কবিতা লিখবার চেষ্টা করেননি। অথচ তাঁর এ সমস্ত সাময়িক কবিতাও আপন সাময়িকতা নিয়েই অত্যন্ত সজীব ও প্রাণবন্ত। নজরুল ইসলাম সম্পর্কেও নির্বিবাদে একথা বলা চলে। তিনি একই সঙ্গে কবিতা লিখেছেন, প্রচারমূলক প্রবন্ধ লিখেছেন এবং সংবাদপত্র পরিচালনা করেছেন। প্রেমের কবিতা যখন লিখেছেন তখনও এই সাময়িকতা তাঁর কাব্যে বিদ্যমান।’ (হাই ও আহসান ১৯৫৬: ৩২০)
আলী আহসান আরো লিখিতেছেন, ‘রবীন্দ্রনাথ প্রবর্তিত স্নিগ্ধ শান্ত কাব্যধারার সঙ্গে এর সমন্বয় নেই বরং অসৌজন্য আছে বলা যেতে পারে। এর কিছুটা স্বাজাত্য বরং আছে মাইকেল মধুসূদন দত্তের বৈপ্লবিক আবেগের সঙ্গে। তবে মাইকেলের সঙ্গে পার্থক্য এখানে যে মাইকেলের বাণী যেখানে সমস্ত জীবন মথিত করে উৎসারিত হয়েছে- নজরুল ইসলামের বাণী সেখানে অত্যন্ত অগভীর। এর একমাত্র কারণ এই যে নজরুল ইসলামের মধ্যে স্থৈর্যের অভাব ছিল। গভীরভাবে জীবনকে উপলব্ধি করবার মত অন্তর্দৃষ্টি তাঁর ছিল না কিন্তু জীবনকে মুহূর্তে সচকিত করার আবেগ তাঁর ছিল।' (হাই ও আহসান ১৯৫৬: ৩১৯-২০)
আলী আহসানের এই বাক্যগুলি কি অর্থ বহন করিতেছে আমি নিশ্চিত হইতে পারিলাম না। শুদ্ধ এইটুকু বুঝিলাম, নজরুল ইসলামের কবিতা তাঁহার বড় মনে ধরে নাই। অন্তর্দৃষ্টি আর আবেগের প্রতিতুলনা প্রভৃতি দেখিলে একপ্রকার সম্ভ্রম জাগে বৈকি! কিন্তু সত্য বলিতে পণ্ডিত আলী আহসানের এই জাতীয় বক্তব্যে বিভ্রম ছাড়া অন্তত আমার মনে অন্য কিছু জন্মায় নাই। কারণ আমরা দেখিয়াছি তাঁহার ঢের আগে কাজী আবদুল ওদুদ, বুদ্ধদেব বসু আর খানিক পরে ফররুখ আহমদও অবিকল একই কথা বলিতেছিলেন। সৈয়দ আলী আহসানের এই ছারখার ব্যবহারের কিছু আগে কবি আবদুল কাদির একবার তত্ত্ব করিয়াছিলেন, নজরুল ইসলাম চিরকালের না হউন, বহুকালের কবি বটেন। কাদিরের জবানিতে: ‘বাংলা সাহিত্যে নজরুল ইসলামের আবির্ভাব এক বিস্ময়কর ব্যাপার। নজরুলের আবির্ভাব না হলে একালের বাঙ্গালি মুসলমানের সাহিত্য-সাধনার দিকে সমগ্র দেশের কৌতুহলী দৃষ্টি আকৃষ্ট হত কিনা সন্দেহ। অতীতে আলাওল আর একালে নজরুল- বাংলা সাহিত্যের মুসলিম ধারায় এই দুই দিকপাল- কালের ভ্রকুটি উপেক্ষা করেও তাঁদের কাব্যকীর্তি বহুকাল অম্লান থাকবে।’ (কাদির ১৩৫৪: ৩০৭)
স্বীকার না করিয়া উপায় নাই, আজ নজরুল ইসলামের জন্মের একশত সতের বছর পরও এই দাবি কায়েম মোকাম আছে- নজরুল ইসলামের কীর্তি আজও এতটুকু ম্লান হয় নাই। দুর্ভাগ্যের মধ্যে, অনেক ভালো কবি এবং ভদ্র বিচারকও এই সত্যটি যথাসময়ে উপলব্ধি করিতে পারেন নাই। এই অপারগ দলে ফররুখ আহমদের নামও চিরদিন জ্বলজ্বল করিবে বলিয়াই আমাদের প্রত্যয় জন্মিয়াছে। কিভাবে বলিতেছি।
১
ফররুখ আহমদের কলিকাতা জীবন প্রভাতেই এক নামকরা নিবন্ধে কবি আবদুল কাদির লিখিয়াছিলেন, ফররুখ আহমদের উপর কোন ‘আধুনিক’ কবির প্রভাব থাকিয়া থাকে তো তিনি নজরুল ইসলাম। কাদির সঙ্গে সঙ্গে ইহাও দেখাইয়াছিলেন যে নজরুল ইসলাম ও ফররুখ আহমদের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর এবং সে পার্থক্য মৌলিক। কাদিরের ধারণা, ‘উভয় কবিই মুসলমানের পুনরুজ্জীবন কামনা করেন আর উভয়েই রোমান্টিক।’ ‘তবে’- তাঁহার বাক্যেই বলিতেছি- ‘নজরুল জাতীয় গণতান্ত্রিক কবি, আর ফররুখ আহমদ ধর্মবাদী (পাকিস্তানবাদী?) সমাজতান্ত্রিক।’ ‘ধর্মবাদী সমাজতান্ত্রিক’ বলিতে কি বুঝায় তাহা আমরা পরে দেখিতেছি। আপাতত বলা যায় ফররুখ আহমদ প্রসঙ্গে আবদুল কাদির পরে- এমনকি কবির মৃত্যুর পরেও- নতুন লেখা লিখিয়াছেন, তবে আগের ধারণার রদবদল বিশেষ করেন নাই। ‘ধর্মবাদী’ বলিতে আবদুল কাদির কি বুঝাইয়াছেন তাহাও পরিষ্কার হয় নাই। আমরা ধরিয়া লইতে পারি, এখানে ধর্ম বলিতে এসলামধর্মই ধরা হইয়াছে। ভারতীয় মুসলমানদের একাংশের চোখে ১৯৪০ সালের পর কোন একসময় এসলাম বলিতে পাকিস্তান বুঝাইত। (কাদির ১৩৫৪)
ফররুখ আহমদ পাকিস্তানের কবি- এ সত্যে সন্দেহ না থাকিলেও ‘সমাজতান্ত্রিক’ কথাটির অর্থ লইয়া গোল আছে। বাংলা ১৩৫০ (ইংরেজি ১৯৪৩) সালে ফররুখ আহমদ পাকিস্তানের নামে কল্পনার পাখা উড়াইয়া দিয়াছিলেন এই ভাষায়:
হাজার বছর পার হয়ে ফের ডাক দিল তোরে পাকিস্তান।
চারদিকে যবে মৃত্যুর ঘের, উড়িল তখন লাল নিশান।।
জনগণ যবে মরে ক্ষুধাতুর, বান বয়ে যায় লোহ অশ্রুর
ফেলে বেড়াজল চারদিকে বেড় বারুদে যখন কালো বিমান।।
(ফররুখ ১৯৬৮: ১৮১)
১৯৪৭ সাল আসিয়াছে। বাংলাদেশ ভাগ হইয়া গিয়াছে, প্রশ্ন উঠিয়াছে পূর্ববঙ্গের দেশভাষা কি হইবে, সেই সন্ধিক্ষণে ফররুখ আহমদ বাংলা ভাষার পক্ষে দাঁড়াইয়াছিলেন। ফররুখ আহমদের পরম নিন্দুককেও এই কথা স্মরণ করিতে হইবে। বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নির্বাচিত করার পক্ষে দুইটা যুক্তির আশ্রয় লইয়াছিলেন তিনি। এক যুক্তির নাম গণতন্ত্র, কারণ তিনি লিখিয়াছিলেন, গণতান্ত্রিক বিচারে ‘সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত’, অথচ একটি প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণী তখন ‘অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষাকে’ পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে তৎপর। এই শ্রেণীটির নাম তিনি রাখিয়াছিলেন ‘অসাধু প্রতারক’। ফররুখ আহমদের দ্বিতীয় যুক্তির নাম এসলাম। এই যুক্তি অনুসারে, ‘বাংলা ভাষার পরিবর্তে অন্য ভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করলে এই দেশে ইসলামী সংস্কৃতিকে হত্যা করা হবে।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [খ]: ৩৩০)
এই সুবাদেই হয়তো আবদুল কাদির এই এসলামবাদী কবিকে ‘ধর্মবাদী সমাজতান্ত্রিক’ বলিয়া সম্মানিত করিয়াছিলেন। তিনি বিচার করিয়া দেখেন নাই ‘ধর্মবাদী সমাজতান্ত্রিক’ কথাটির মধ্যে কোন বিরোধের, কোন কূটের আভাস আছে কিনা। সমাজতন্ত্র জিনিশটাকে জাতিবিশেষের সহিত- শ্রেষ্ঠ জাতির সহিত- জড়াইলে যে পদার্থ তৈরি হয় ইতিহাসে তাহাকেই ‘ফ্যাসিবাদ’ বলা হইয়াছে। দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে পাকিস্তান আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত তাহাতেই পর্যবসিত হইয়াছিল। ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়াইয়া অতীতের ভুত দেখিয়াছিলেন ফররুখ আহমদ। গণতন্ত্রে তাঁহার আস্থা ছিল কতটুকু? ‘গণতন্ত্র’ আর ‘ধর্মবাদ’- এই দুই পদার্থ একসঙ্গে আদৌ যায় কি? আমরা দেখিব ধর্মবাদী পাকিস্তানের প্রবক্তা ‘মহাকবি’ ইকবালও আদপে গণতন্ত্র জিনিশটার উপর বড় একটা আস্থা স্থাপন করেন নাই। জার্মান তত্ত্ব জ্ঞানী ফ্রিদরিক নিৎশের তালিম লইয়া তিনি এক প্রকার অতিমানবের পথ চাহিয়াই বসিয়াছিলেন। ইকবালের এই মেজাজশরিফ- এই ফ্যাসিবাদ পদার্থটা- ধার লইতে কদাচ সংকোচ করেন নাই ফররুখ আহমদ। করিয়াছেন কি? যে পদার্থকে এই উপমহাদেশে ‘সাম্প্রদায়িকতা’ বলা হইয়া থাকে- তাহা তো এয়ুরোপিয়া ফ্যাসিবাদেরই নিকটতম আত্মীয়। এ সত্যে সন্দেহ কোথায়?
এই ফ্যাসিপন্থার বীজ ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ভিতর কিছুদূর খনিলে পাওয়া যাইবে। অনেক ভারতীয় জ্ঞানীগুণী ও বুদ্ধিজীবী মানুষ দাবি করিয়া থাকেন, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন একদা প্রবল প্রতাপে ওয়াদা করিয়াছিলেন ভবিষ্যতে তাঁহারা জনগণের রায় লইয়াই দেশটা চালাইবেন। তাঁহারা, ভদ্রলোকের ভাষায়, অঙ্গিকার করিয়াছিলেন গণতন্ত্রের হওয়া বহাইয়া দিবেন। অথচ অন্যদিকে পাকিস্তান-ভাবের প্রধান ভাণ্ডারী সহি বড় কবি স্যার মোহাম্মদ ইকবাল স্বধর্মাবলম্বী মুসলমানদের বলিয়াই রাখিয়াছিলেন- ‘গণতন্ত্র হইতে সাবধান’। কোন কোন ভারতীয় বুদ্ধিজীবী- যেমন পৃথ্বিনাথ ধর- দাবি তুলিয়াছেন, পাকিস্তান পথিক কবি ইকবাল একেলাই ছিলেন গণতন্ত্র বিরোধী। আমরা সবিনয়ে বলিব, কথাটি পক্ষপাতদুষ্ট। সত্য বলিতে কি ভারতের জাতীয় আন্দোলন মুখেই মাত্র ‘গণতন্ত্রের’ নামাবলী জপ করিতেছিলেন। তাঁহাদের শেষের কথাটি অবশ্য কানায় কানায় সত্য। স্যার মোহাম্মদ ইকবাল সগর্বে ঘোষণা করিয়াছিলেন, তিনি জার্মান তত্ত্বজ্ঞানী নিৎশের শিষ্য। তিনি বলিয়াছিলেন, গণতন্ত্রে মানুষের কয়টা মাথা তাহাই মাত্র গোণা হয়, কোন মাথায় কতখানি মগজ আছে তাহার ওজন তো লওয়া হয় না।১ ইকবাল ভারতের মুসলমান জনসাধারণকে পরামর্শ দিয়াছিলেন, গণতন্ত্রের পায়রবি না করিয়া তাহার যেন কোন মহামহিম নেতার পিছে বিনাওজরে দাঁড়ান। তাঁহার যুক্তি, ‘দুইশত গাধা এক ময়দানে সমবেত হইলেও উহাদের মাথা হইতে একটা মানবিক ভাবনা বাহির হইবেক না’।২ (ধর ২০০৭: ৭-৮)
কবি ইকবালের সংস্রবে দুই কথা যখন বলিতে বাধ্য হইয়াছি তখন কথা দুইটা সামান্য খোলাসা করিতে হয়। ১৯৩০ সালের ২৯ ডিসেম্বর এলাহাবাদে অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত মুসলিম লীগের পঞ্চবিংশ অধিবেশনে সভাপতির ভাষণ দিতেছিলেন স্যার ইকবাল। সেই ভাষণের শেষদিকে তিনি- স্যার ম্যালকম হেয়লি এবং লর্ড আরবিন- দুই ব্রিটিশ মহাপুরুষের দোহাই পাড়িয়া বলিয়াছিলেন, ভারতের মুসলমান সমাজের সামনে দুইটা বড় বিপদ। এক নম্বরে, তাঁহারা তখন পর্যন্ত কোন নেতার জন্ম দিতে পারেন নাই। ‘নেতা’ কথাটির অর্থ কি? স্যার ইকবাল জানাইলেন, নেতাই জনগোষ্ঠীর চালিকাশক্তি। এই নেতা আল্লাহর দানবিশেষ, ইচ্ছা করিলেই কেহ নেতার জন্ম দিতে পারে না। তাঁহার মতে, আল্লাহতায়ালার রহমত কি অভিজ্ঞতার দৌলতে নেতার দুই ধরনের গুণের অধিকারী হইতে হয়। একদিকে এসলামের প্রাণশক্তি ও লক্ষ্যবস্তু কি সে ধারণা যেমন রাখা চাই তাহার, তেমনি চাই এ যুগের ইতিহাস কোন পথে চলিয়াছে সেই সংস্রবেরও সমান পরিষ্কার ধারণা। ভারতীয় মুসলমানের দ্বিতীয় বিপদ- ইকবালের ধারণা- তাহাদের মধ্যকার রাজনৈতিক অনৈক্য। রাজনৈতিক অনৈক্যকে মুসলিম ইতিহাসে সুপরিচিত ধর্মীয় অনৈক্যের সহিত তুলনীয় মনে করিতেন তিনি। ইকবাল বলিয়াছিলেন, কি করিয়া ভারতবর্ষের সকল মুসলমানকে এক পতাকাতলে আনা যায় তাহা তিনি জানেন, তবে নেতার জন্ম দেওয়ার এখতিয়ার মানুষের হাতে নাই। (আনজুম ২০১৪: ২২১-২২২)
স্যার মোহাম্মদ ইকবালের এই ধারণার যুক্তিসঙ্গত পরিণতি গণতন্ত্র হয় নাই- এই পরিণতিরই অপর নাম দাঁড়াইয়াছিল ধর্মবাদী সমাজতন্ত্র বা এককথায় ‘ধর্মবাদ’। ঘটনার গোটা সাত বছর পর- ১৯৩৭ সালের ২১ জুন তারিখে- লেখা একখানি পত্রযোগে সে যুগে মুসলমান সমাজের উদীয়মান নেতা মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ বরাবর স্যার ইকবাল লিখিয়াছিলেন, ‘আপনি বড়ই কর্মব্যস্ত মানুষ। তারপরও আশা করি এত ঘন ঘন পত্র লিখি বলিয়া অপরাধ লইবেন না। লিখিতেছি, কেননা আজিকার ভারতবর্ষে আপনিই একমাত্র মুসলমান যাহার মুখের দিকে এই উত্তর-পশ্চিম ভারত- হইতে পারে গোটা ভারত- জুড়িয়া যে ঝড়টা আসিতেছে সেই ঝড় নিরাপদে পার করাইবার আশায় তাকাইয়া থাকিবার অধিকার গোটা [ভারতীয় মুসলমান] সমাজ রাখে।’ (আনজুম ২০১৪: ২২৬)
এই চিঠির শেষাশেষি স্যার ইকবাল অধিক লিখিয়াছিলেন, ‘ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল এবং বাংলার মুসলমানদের কেন ভারতের এবং ভারতবর্ষের বাহিরের আর আর জাতির মতো আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার-সমৃদ্ধ আলাদা আলাদা জাতি স্বীকার করিয়া লওয়া হইবে না?’ প্রসঙ্গেক্রমে তিনি আবার যোগ করিলেন, ‘আমি নিজে মনে করি, এই মুহূর্তে ভারতের উত্তর-পশ্চিমাংশের এবং বাংলার মুসলমানদের উচিত অন্যান্য মুসলমান (সংখ্যালঘু) প্রদেশের কথা আমলে না নেওয়া। মুসলমান সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘু- উভয় ধরণের- প্রদেশের স্বার্থে এই পথ অবলম্বন করাই শ্রেষ্ঠ পথ।’ (আনজুম ২০১৪: ২২৬-২২৭)
কবি আবদুল কাদির ১৯৪৭ সালেও মনে করিতেছিলেন ফররুখ আহমদের নিকটতম প্রতিতুলনা বোধ করি নজরুল ইসলামই। তবে কাদিরের সহিত সকলেই একমত হইয়াছিলেন- এমন নহে। এমনকি তাঁহার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুহম্মদ এনামুল হকও অবিলম্বে ভিন্ন ধারণা ব্যক্ত করিয়াছিলেন। নজরুল ইসলামের আদর্শ হইতে ফররুখ আহমদ যে অনেকখানি সরিয়া গিয়াছিলেন তাহা নির্দেশ করিয়া আবদুল কাদির ভুল করেন নাই। তাহা সত্ত্বেও এই ঘটনার কিছুদিন পরে লেখা ‘বাঙ্গালী মুসলিম মানসে তুর্কী বিপ্লবের প্রভাব’ নামক এক নিবন্ধে এনামুল হক ধরিয়া লইয়াছিলেন নজরুল ইসলামই ফররুখ আহমদের গুরু, ইংরেজিতে ‘মাস্টার’। কথাটা এনামুল হকের মুখ হইতেই শোনা যাইতে পারে:
‘মানবিকতায় নজরুল ইসলাম ছিলেন বিদ্রোহী, বিশ্বাসে মুসলমান, প্রকাশভঙ্গিতে প্রচলিত নিয়মবিরুদ্ধ, লিখনভঙ্গিতে সম্পূর্ণ নতুন এবং সর্বোপরি পৃথিবীর সর্বহারাদের প্রতি তাঁর ছিল অপরিসীম সহানুভূতি। অচিরেই আদর্শবাদী তরুণ সমাজ সে যুগের সাহিত্যের গতানুগতিক ভাবধারা পালটে দেওয়ার জন্যে নজরুল ইসলামের চতুষ্পার্শ্বে এসে জড় হলেন। এঁদের মধ্যে সন্ত্রাসবাদী কবি বেনজির আহমদ (জন্ম ১৯০৩), কবি মহিউদ্দিন (১৯০৬-১৯৬৭) প্রমুখ ব্যক্তির নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে। এঁরা আদর্শের জন্যে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের হাতে অকথ্য লাঞ্ছনা সহ্য করেছেন। ফররুখ আহমদ নামে অপর একজন কবি মুসলমান আদর্শবাদে বিশ্বাসী তাঁর গুরু নজরুল ইসলামের প্রতি এখনও সশ্রদ্ধ রয়েছেন।’ (এনামুল হক ১৯৯৪: ৬৫৩; ১৯৯৫: ৪৬৭)
আমরা যতদূর দেখিতে পাইয়াছি, নজরুল ইসলামকে ‘গুরু’ স্বীকার করিতে ফররুখ আহমদ অন্তত শেষ পর্যন্ত রাজি ছিলেন না। খানিক বিড়ম্বনায় পড়িলাম যখন দেখিলাম মুহম্মদ এনামুল হকও পদার্থটা যথার্থ এস্তেমাল করেন নাই। ফররুখ আহমদ কতবার বিজ্ঞাপন দিয়া বলিয়াছেন, তিনি মোহাম্মদ ইকবালের ছাওয়াল। অন্য অনেকের মতো ইকবালের কবিতার তর্জমা তিনিও করিয়াছিলেন। যতদূর জানি ফররুখের তর্জমা ইংরেজির দৌত্যে। এ কাজটা সে যুগে অনেকেই করিতেছিলেন। মনে পড়িতেছে, তাঁহার মশহুর ‘সাত সাগরের মাঝি’ (১৯৪৪) উৎসর্গ করা হইয়াছিল ‘বিশ শতকের শ্রেষ্ঠ তামদ্দুনিক রূপকার, দার্শনিক মহাকবি, আল্লামা ইকবালের অমর স্মৃতির উদ্দেশে’। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায়, নজরুল ইসলাম নিজে উর্দু ও ফারসি ভালই জানিতেন- তাঁহার হাফিজ আর ওমর খৈয়াম তর্জমার কথা কে না জানে!- কিন্তু তিনি কদাচ ইকবালের তর্জমা করেন নাই।
ফররুখ আহমদ সম্পর্কে দ্বিতীয় জনপ্রিয় ধারণাটির জন্ম আরেকটু পরকালে। এই কবির অকালমৃত্যুর পরপর ১৯৭৪ সালে আহমদ ছফা লিখিয়াছিলেন, ‘ফররুখ আহমদের অনেকগুলো সফল কবিতা রয়েছে। তাঁর কবিতা বাংলার কাব্য-সরস্বতীর কণ্ঠে ইন্দ্রমণির হারের মত দুলবে। কিন্তু আমি মনে করি তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি এই মৃত্যু।’ আহমদ ছফা আরো লিখিয়াছিলেন, ‘মৃত্যুকে তিনি একেবারে চোখাচোখি দেখেছেন এবং বরণ করেছেন। একটিবারের জন্যও কবির মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হতে দেননি। একটিবারের জন্যও দীন অক্ষম কাঙ্গালের বেশে কারও দোরে হাত পাতেননি। কাব্যাদর্শ যাই হোক লিখেছেন তো কবিতা।’ (ছফা ১৯৭৪)
আহমদ ছফার কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যায় ফররুখ আহমদের প্রথম যৌবনের বন্ধু আবু রুশদের স্মৃতিকথায়ও। রুশদ লিখিয়াছেন, ‘মরবার সময় সে বিনা চিকিৎসায় এবং অর্ধাহারে তাঁর শেষের দিনগুলো কাটিয়েছিল। তাঁর অনেক অনুরাগী তাঁকে সাহায্য করতে চেয়েছিল, সে তা বার বার প্রত্যাখ্যান করেছে। তাঁর আত্মসম্মানজ্ঞান ছিল খুব উঁচু ধরনের।’ (রুশদ ১৯৯৮: ৬৫)
অনেকদিন পর- ১৯৯৫ সালে মুদ্রিত- এক সাক্ষাতকারে আহমদ ছফা আগের ধারণা খানিক পরিমার্জিত করিয়াছিলেন। তাঁহার নতুন ধারণা অনুসারে, ফররুখ আহমদের অহং ছিল অনেক বড়, অথচ সে অহং ‘সময় এবং সমাজের সঙ্গে’ বিকশিত হইতে পারে নাই। ছফা বলিয়াছিলেন: ‘একগুঁয়ে মানুষদের যা হয়ে থাকে ফররুখের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। একগুঁয়ে লোকেরা তাঁদের গোঁটাকেই বিশ্বাস বলে প্রমাণ করতে চায়। ইসলামী আদর্শের কারণে ফররুখ আহমদের এভাবে করুণ মৃত্যু হল, এটাও বলা যাবে না। ইসলামী বিশ্বাস মানুষকে আত্মহত্যার প্রেরণা দেয় না।’ (ছফা ২০০৯: ৬০)
২
নজরুল ইসলাম প্রসঙ্গে ফররুখ আহমদের দুইটা নিবন্ধ আমাদের হাতে পড়িয়াছে। তাহা ছাড়া খবরের কাগজে প্রকাশিত একটি সাক্ষাতকারের মধ্যেও নজরুল ইসলামের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রথমে সাক্ষাৎকারের কথাটা পাড়ি। ১৯৬৮ সালের কথা, প্রশ্নকর্তা কবিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘এখনো কি আমাদের সমাজে প্রকাশনা একটা বড় সমস্যা?’ ফররুখ আহমদ উত্তর দিলেন, ‘বাংলা ভাষাভাষী মুসলিম সমাজের এটা চিরন্তন সমস্যা। এই সমস্যার জন্যই ছোট একখানা বর্ণপরিচয় থেকে শুরু করে বিশ্বকোষ জাতীয় বিরাট গ্রন্থের ব্যাপারে আমাদের পরমুখাপেক্ষী থাকতে হয়েছে।’ প্রশ্নকর্তা জানিতে চাহিলেন, ‘আগেও কি এই সমস্যা ছিল?’ তখন উত্তর হইল, ‘আগেও ছিল। আপনারা বোধ হয় জানেন- যে নজরুল ইসলামকে নিয়ে আমরা এত উচ্ছ্বাস প্রকাশ করি সেই নজরুল ইসলামের প্রায় সব বই-ই প্রকাশ করেছিলেন অমুসলিম প্রকাশক। মাত্র দু’চারখানা বই প্রকাশ করেছিলেন কোন কোন মুসলিম প্রকাশক; তা’ও শেষ অবস্থায়।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [ক]: ৪৩৮)
১৯৫৯ সালে আবদুল কাদির সম্পাদিত ‘নজরুল পরিচিতি’ গ্রন্থে ফররুখ আহমদের একটি নিবন্ধ (বেতার-কথিকা) জায়গা পায়। নিবন্ধের নাম ‘নজরুল সাহিত্যের পটভ‚মি’। দেখা যাইতেছে ফররুখ আহমদ এই জায়গায় নজরুল ইসলামকে মাত্র মুসলমান জাতির কবি ধরিয়া লইয়াছেন। তাহা ছাড়াও তিনি মনে করেন, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে পাকিস্তান আন্দোলনের গোড়াপত্তন হইয়াছিল সেই খেলাফত আন্দোলনের যুগেই। সুতরাং তাঁহার কিছু কৃতিত্ব নজরুল ইসলাম দাবি করিতেই পারেন। ফররুখ আহমদ লিখিয়াছেন, ‘খিলাফত আন্দোলন কালে কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব একাধিক কারণে স্মরণীয়। আত্মবিস্মৃত জাতি বহুদিন পরে শুনল তার আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা। নতুন করে পেল সে তার ঐতিহ্যের পরিচয়।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [খ]: ৩২৮)
নজরুল ইসলামের দোসরা কীর্তি- ফররুখ আহমদের মতে- বাংলা ভাষায় বহুদিন ধরিয়া অবদমিত একটি জগতের পুনরুজ্জীবন, অর্থাৎ আরবি ও ফারসি ঐতিহ্যের পুনপ্রবর্তন। ফররুখ আহমদ লিখিয়াছিলেন, ‘বহু শতাব্দী ধরে বাঙ্গালী মুসলমান আরবী-ফারসী মিশ্রিত যে বাংলা জবান গড়ে তুলেছিল, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ষড়যন্ত্র যে ভাষার কণ্ঠরোধ করেছিল, কাজী নজরুলের বলিষ্ঠ লেখনীতে তার নতুন প্রকাশ দেখে উল্লসিত হয়ে উঠলেন শিক্ষিত সমাজ। এমনকি জনসাধারণের মধ্যেও সাড়া পৌঁছতে দেরী হ’ল না। (ফররুখ [খ]: ৩২৮)
ফররুখ আহমদের বিচারে নজরুল ইসলাম উত্তরাধিকারসূত্রে এসলামের ‘মরমীবাদ ও সুফীবাদ’ হইতে উপকার পাইয়াছিলেন। উত্তরাধিকার হইতে প্রাপ্ত এই প্রাণশক্তির দিকেই দেশের দুর্গত জনসাধারণ ‘বিপুল বেগে’ আকৃষ্ট হইয়াছিল। নজরুল ইসলামের কবিতায় তাহারা একদিকে যেমন আশ্বাসের বাণী শুনিলেন, অন্যদিকে তেমন লাভ করিলেন নতুন চেতনাও। নজরুল ইসলামের মূল ফররুখ আহমদ দেখিয়াছেন এই নতুন চেতনায়। কবিচিত্তে জাগ্রত এই নতুন চেতনার গোড়ায় তিনি দেখিতে পাইয়াছেন ‘ইসলামের মানবতাবোধ, সাম্য ও সামাজিক ন্যায়বিচার’। খেলাফত আন্দোলনের একটি অধ্যায়কে প্রাণবন্ত করিয়া তুলিয়াছিল নজরুল ইসলামের এই নবচেতনা। সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের তাকিদও এই চেতনা হইতে আসিয়াছিল বলিয়া ফররুখ আহমদ মনে করেন।
এই পর্যন্ত বিচার করিলে দেখা যায় ফররুখ দুই জায়গায় অস্ত্রোপচার করিয়াছেন। এক জায়গায় তিনি নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের পুরাতন বা সমকালীন অমুসলমান ঐতিহ্য হইতে কাটিয়া আলাদা করিয়াছেন। তাঁহাকে সীমিত করিয়াছেন শুদ্ধ মুসলমান ঐতিহ্য বলিতে যাহা বুঝায় তাহার মধ্যে। ইহাতে ন্যায় কোথায়? এক্ষণে দেখা যাইতে পারে তাঁহার দ্বিতীয় উপচার কোন জায়গায় লাগানো হইয়াছিল। ফররুখ আহমদ লিখিয়াছেন, ‘বঙ্গভঙ্গ, খিলাফৎ, অসহযোগ ও সন্ত্রাসবাদের পটভ‚মিতে যে কবি-মানস গঠিত হয়েছিল, তার অশান্ত মনের প্রতিচ্ছায়া দেখেছি আমরা তাঁর রচনায়। বাংলা সাহিত্যের একটা বিশেষ অধ্যায়ে রয়ে গেছে তাঁর দ্বন্দ্ব-মুখর মনের ছাপ।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [খ]: ৩২৯)
দ্বিতীয় অস্ত্রোপচারের দৌলতে ফররুখ আহমদ নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের ইতিহাসে ফিরাইয়া আনিলেন তবে তাহাতে ‘অশান্ত’ আর ‘দ্বন্দ্ব-মুখর’ মনের ছাপ ছাড়া আর কিছু দেখিলেন না। আকেলমন্দের দরবারে এই ক্ষমাহীন মন্তব্য অন্যরোগের প্রকাশ বলিয়াও হাজির হইতে পারে। প্রমাণের জন্য অধিক দূর যাইতে হইবে না। ১৯৭৯ সালে- ফররুখ আহমদের এন্তেকালের বছর পাঁচ পরে- ‘নজরুল-প্রসঙ্গ’ নামে তাঁহার একটি নাতিহ্রস্ব লেখা প্রথম প্রকাশিত হইল। ফররুখ আহমদের গোপনরোগ সেই লেখায় ধরা পড়িয়াছিল। এই লেখাতেই তিনি সর্বসমক্ষে অভিযোগ করিয়াছিলেন, ‘নজরুলের শক্তি যেমন বিস্ময়কর তাঁর কাব্যিক স্খলনও তেমনি বিস্ময়কর।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [ক]: ৩২৭)
নজরুল ইসলামের দুইটা বড় বড় দোষ ধরিয়াছিলেন ফররুখ আহমদ। তাঁহার মতে, নজরুল ইসলামের প্রথম দোষটা অদম্য ভাবাবেগের। এই দোষ অবশ্য ফররুখ আহমদ একেলা আবিষ্কার করেন নাই। তাঁহার ঢের আগে কাজী আবদুল ওদুদ, বুদ্ধদেব বসু কিংবা সৈয়দ আলী আহসান সকলেই করিয়াছিলেন। কথাটা শুদ্ধ বানান করিয়া বলিয়াছেন ফররুখ আহমদ এই যাহা, ‘অদম্য ভাবাবেগের জন্য তাঁর অধিকাংশ কবিতাই নিখুঁতভাবে জমাট বাঁধতে পারেনি, শব্দচয়নের দিক দিয়েও তাঁর দুর্বলতা আছে যথেষ্ট।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [ক]: ৩২৭)
দুর্ভাগ্যের মধ্যে, কোন উদাহরণ দেখাইবার অবকাশ পান নাই তিনি। সে যাহাই হোক, তাঁহার দ্বিতীয় অভিযোগটি আরেকটু বড় বটে: ‘অগভীর জীবনবোধ এবং দার্শনিক দৃষ্টিশক্তির অভাব তাঁর সবচাইতে বড় ত্রুটি। শুধু এই একটি কারণেই তিনি সর্বকালের কবি হতে পারেননি। নজরুল নিজেও তা বুঝতেন এবং সে কথা স্বীকার করে গেছেন।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [ক]: ৩২৭)
সে কথা কোথায় স্বীকার করিলেন নজরুল, জানাইলে বড় ন্যায়কাজ হইত। ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতাযোগে নহে তো? যদি তাহা হয় তো সন্দেহের কারণ আছে, ফররুখ আহমদ ব্যাজস্তুতি নামক বাক্যালঙ্কার কি পদার্থ তাহা জানিতেন কিনা। তবে দেখিলাম, ফররুখ আহমদ এখানেই প্রাণ খুলিয়া ব্যাখ্যা করিতেছেন কি কারণে তিনি নজরুল ইসলামের উপর এতখানি ক্ষুব্ধ। বাঙ্গালি মুসলমানের আশা নজরুল ইসলাম পূরণ করেন নাই। তাই তাহাদের নামেই তিনি নালিশ রুজু করিতেছেন, ‘তারা [বাঙ্গালি মুসলমান] আরও চেয়েছিল নজরুলের কাছে, তারা তাদের নিজের দর্শন, জীবনবোধ ও ইতিহাসের অভিব্যক্তি চেয়েছিল কবি নজরুলের কবিতায়।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [ক]: ৩২৭)
নজরুল ইসলামের কাছে বাঙ্গালি মুসলমান যে ‘দর্শন, জীবনবোধ ও ইতিহাসের অভিব্যক্তি’ চাহিয়াছিল তাহা কি পদার্থ ফররুখ আহমদ মোটেও পরিষ্কার করেন নাই। মাত্র একটু ঘুরাইয়া বলিয়াছেন, যে পদার্থের সন্ধান নজরুল ইসলাম দিতে পারেন নাই তাহার নাম ‘আবেহায়াত’। দৃষ্টান্তস্বরূপ: ‘ভারতের পশ্চিম প্রান্তে মহাকবি ইকবাল অবশ্য অনেক আগেই সন্ধান দিয়েছিলেন আবেহায়াতের। তাঁর দেশকালজয়ী প্রতিভার সঙ্গে নজরুলের তুলনা করতে যাওয়া বাতুলতা।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [ক]: ৩২৭)
আমরা কিছু পরে দেখিব, কবি এই জায়গায় আসিয়া কিছুটা দিশাহারা হইয়াছেন। তিনি ইকবাল চিনিতে পারিয়াছেন কিনা সে কথা স্বতন্ত্র, তবে নজরুল ইসলাম কেন দেশজয়ী- এতদিনে আমরা বলিব ‘কালজয়ী’ও- তাহা ধরার চেষ্টা করেন নাই। তিনি স্বীকার করিয়াছেন, ‘পলাশী[র] যুদ্ধের পর নজরুল ইসলাম বাঙ্গালী মুসলমানের জাগরণের প্রথম কবি’। লিখিয়াছেন, ‘নজরুল ইসলামের উন্মত্ত উচ্ছ্বাসময় প্রাণ-প্রবাহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হওয়ার পর বেগবান জলপ্রপাতের মত অকাল বার্ধক্যের যুগসঞ্চিত জরদগব শিলাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল যাদুকরের মত- সমস্ত দেশ তাঁকে অভিবাদন জানাল।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [ক]: ৩২৭)
হাবভাব দেখিয়া মনে হয়, তিনি যেন বলিতেছেন তাহাতে কি হইয়াছে? তিনি তো শেষ পর্যন্ত কাব্যের চরম উৎকর্ষে পৌঁছাতে পারিলেন না। তাহার আগেই ‘অবসর গ্রহণ’ করিতে বাধ্য হইলেন। বলাবাহুল্য, ফররুখ আহমদের হিংসা এখানেই সবচেয়ে বেশি বেয়াব্রু হইয়াছে। নজরুল ইসলামের কবিতায় বাঙ্গালি মুসলমান যাহা আশা করিয়াও পায় নাই প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে যে সংস্কৃতি জাগিয়াও পরিণতিতে পৌঁছে নাই তাহা অবশ্য শেষ পর্যন্ত বৃথা যায় নাই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের রণদামামার মধ্যে সেই হারানো স্বপ্নই সত্য হইল। ফররুখ আহমদ লিখিলেন, ‘পৃথিবীর চলমান স্রোতের সাথে অদ্ভ‚ত সামঞ্জস্য রেখেছে বাঙ্গালী মুসলমান সমাজের প্রাণবন্ত মননের ধারাবাহিকতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে যে সংস্কৃতি জেগে উঠল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মারণাস্ত্রের মধ্যে থেকে সে সংগ্রহ করল জীবনের নতুন পাথেয়।’ (ফররুখ ১৯৯৬ [ক]: ৬৩২৭)
এই নতুন পাথেয়ের মধ্যে ফররুখ আহমদের কবিতাও আছে বৈকি! মুজিবর রহমান খাঁ নামে ফররুখ আহমদের এক ভক্ত ছিলেন। পেশায় সাংবাদিক এই ভদ্রলোক বলিতেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কবি ফররুখ আহমদ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কবি নজরুল ইসলামকে ছাড়াইয়া গিয়াছিলেন। ১৯৬০ সালের দশকে এই খয়ের খাঁ লিখিয়াছিলেন, ‘নজরুলের ভাষায় যে আকরিক ক্লেদ রয়েছে ফররুখ আহমদের ভাষায় তা নাই। ঘষামাজা করেছেন তিনি প্রচুর, এজন্যে ফররুখ আহমদের ভাষা নজরুলের ভাষা থেকে অনেকখানি সুসংহত ও পরিশোধিত।’ মুজীবর রহমান খাঁর এই বিশ্বাসের মধ্যে ফররুখ আহমদের কথার প্রতিধ্বনি পাওয়া যাইতেছে। ফররুখ আহমদ একদা বলিয়াছিলেন নজরুলের ‘স্খলন’, মুজিবর রহমান খাঁ তাহাতে আরেকটি কথা যোগ করিলেন- কথাটা দাঁড়াইল ‘স্খলন ও পতন’। ফররুখ আহমদ ধরিয়া লইয়াছিলেন নজরুল ইসলাম প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে যে সংস্কৃতি জাগিয়া উঠিয়াছিল তাহারই অপর নাম। আর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মারণাস্ত্রের মধ্য হইতে সংগ্রহ করা ‘জীবনের নতুন পাথেয়’ বলিতে শুদ্ধ নিজের নামটা বিনয়ের দায়ে বলিতে সংকোচ করিয়াছিলেন তিনি। মুজীবুর রহমান খাঁর সেই দায় নাই। তিনি লিখিয়াছেন, ‘ফররুখ আহমদের ব্যবহৃত ভাষায় আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার খুবই সুন্দর। নজরুলও আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহারে সুদক্ষ, তবে নজরুলের রচনায় পরিশীলিত পেলবতায়ও মাঝে মাঝে সৌকর্যের অভাব দেখা যায়। নজরুলের ভাষার মধ্যে বহুস্থানে আছে ধৈর্যহীন ও সংস্কারহীন স্খলন ও পতন। কিন্তু ফররুখ আহমদের কবিতা পাঠককে বলে দেয় যে ধৈর্যহীনতা ও অসংযমের দিন কেটে গিয়েছে এবং আমাদের জবানে এসেছে সংহতি ও সংযমের নিয়ম-কানুন।’ (খাঁ ২০০৪: ৩১৫-১৬)
আবদুল মান্নান সৈয়দ জানাইয়াছেন, মুজীবর রহমান খাঁর যে লেখা হইতে আমরা এই উক্তি উদ্ধার করিয়াছি সে লেখা ফররুখ আহমদের ইচ্ছানুসারে ‘সাত সাগরের মাঝি’ গ্রন্থের তৃতীয় [অর্থাৎ মরণোত্তর প্রথম] সংস্করণে জুড়িয়া দেওয়া হইয়াছিল।’ (মান্নান ১৯৯৫: ৫৫৩-৫৬৫; খাঁ ২০০৪: ৩০৫-১৭)
মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহকে যদি বিশ্বাস করা যায় তো কবুল করিতে হয়, ফররুখ আহমদের আরবি ফারসি চৌদ্দ আনা পড়িয়া পাওয়া। দেখা যাইতেছে, ভাবাদর্শের শক্তি নিতান্ত কম নয়। মাহফুজউল্লাহ লিখিয়াছেন:
‘তাঁর কবিতায় আরবী-ফারসী শব্দের ব্যাপক ও নিপুণ ব্যবহার দেখে অনেকের ধারণা ফররুখ আহমদ বুঝি আরবী ও ফারসী ভাষা খুব ভাল জানতেন। কিন্তু ফররুখ আহমদের নিজের মুখে শুনেছি তিনি এ সব আহরণ করেছেন প্রধানত পুথি থেকে, প্যারীচাঁদ মিত্রের আলালের ঘরের দুলাল, নজরুল ইসলামের কবিতা, প্রমথ চৌধুরীর গদ্য এবং অন্যান্য রচনাবলী পাঠ করে। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অসাধারণ। কীটস্, শেলী, গ্যেটে, হুইটম্যান থেকে শুরু করে মাইকেল [মধুসূদন দত্ত], রবীন্দ্রনাথ [ঠাকুর], [কাজী] নজরুল [ইসলাম]- এমনকি পরবর্তী কবিদের রচনাও তিনি অবলীলায় মুখস্থ বলতে পারতেন।’ (মাহফুজউল্লাহ ১৯৭৮: ১৮২)
৩
প্রশ্ন হইতেছে, কখন এবং কিভাবে ফররুখ আহমদ এই পথ ধরিলেন? আরো বলিতে, কোন জায়গায় তিনি নজরুল ইসলামকেও ছাড়াইয়া উঠিলেন? সে যুগে ফররুখ আহমদ যে সাহিত্যিক গোষ্ঠীর অধীন ছিলেন তাঁহারা নিজেদের বলিতেন ‘আধুনিক’। ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত এক স্মৃতিকথাযোগে আধাপুরুষ পরকালের লেখক রশীদ করীম লিখিয়াছেন: ‘আমাদের [কলিকাতার] ২০ কর্নেল বিশ্বাস রোডস্থ বাড়িতে সেকালে সাহিত্যের এক সরগরম আড্ডা ছিল। ফররুখ আহমদ, আবু রুশদ, শওকত ওসমান, আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, গোলাম কুদ্দুস প্রমুখ উদীয়মান আধুনিক মুসলিম কবি ও কথা-সাহিত্যিক এখানে বসেই কি লিখবেন, আধুনিক কালে কি এবং কেমনতর ভাষায় লেখা উচিত তা নির্ণয় করতেন। এই কবি-সাহিত্যিকরা নিঃসন্দেহে বাংলা সাহিত্যে মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সর্বপ্রথম অবতারণা করেন। তাঁরাই আধুনিকতার ভিত্তি স্থাপন করেন।’ রশীদ করীম জানাইতেছেন, ফররুখ আহমদ এই গোষ্ঠীর সেরা কবি বলিয়া গণ্য হইতেন। আর ফররুখ আহমদের খ্যাতি ছিল- অন্তত মুসলমানদের মধ্যে- সবার চেয়ে বেশি। রশীদ করীমের সাক্ষ্য অনুসারে, সৈয়দ আলী আহসান ১৯৪৪ কি ১৯৪৫ নাগাদ আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রে যোগ দিয়াছিলেন। যোগদানের কিছু পরে তিনি ফররুখ আহমদকে নিজের কবিতা পাঠের আর তাঁহার কবিতার আলোচনার আমন্ত্রণ জানাইলেন আবদুল কাদিরকে। শুঁড়ির সাক্ষী রশীদ করীমের ভাষায়, ‘এ নিয়ে বেশ হৈচৈ হয়েছিল।’ (করীম ১৯৯৯: ৩২-৩৩)
বেতারে পঠিত সে কথিকায় আবদুল কাদির স্বীকার করিয়াছিলেন ‘বাংলার নবীন মুসলমান কবিদের মধ্যে ফররুখ আহমদ নিঃসন্দেহে সর্বশ্রেষ্ঠ।’ এই কথিকাই ‘সওগাত’ পত্রিকায় পরে ছাপা হয় ‘নবীন কবি ফররুখ আহমদ’ নামে। নিচে লেখা ছিল ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও-র সৌজন্যে’। আবদুল কাদিরের লেখার প্রভাবও কম ছিল না। অনেকদিন পরে মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ জানাইতেছেন, ‘বিভাগপূর্ব কালে কলকাতা বেতারে পঠিত এবং “সওগাত” পত্রিকায় প্রকাশিত কবি আবদুল কাদিরের “নবীন কবি ফররুখ আহমদ” শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়ে আমি সে সময়ে বিশেষ মুগ্ধ হই।’ কাদিরের দোহাই পাড়িয়া মাহফুজউল্লাহ জানাইয়াছেন, ফররুখ আহমদই প্রথম নজরুল পরবর্তী মুসলমান কবি যাঁহাকে লইয়া কলিকাতা বেতারে একক আলোচনা প্রচারিত হয়। (কাদির ১৩৫৪: ৩০৭-৮; মাহফুজউল্লাহ ১৯৮১: ২১৩)
ফররুখ আহমদের বন্ধুদের মধ্যে শওকত ওসমানও ছিলেন। তাঁহার স্মৃতির উপর যদি নির্ভর করিতে পারিতাম তো বিশ্বাস করিতাম, ফররুখ আহমদ ছিলেন পাকিস্তানের ‘একদম একগুয়ে জিদ্দী সমর্থক’। শওকত ওসমান লিখিয়াছেন:
কানমে বিডি মুহমে পান
লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান।
অর্থাৎ- ‘কানে বিড়ি এবং মুখে পান গুঁজে লড়াই চালিয়ে পাকিস্তান নিয়ে নেব’- এই শ্লোগানটি তৈরি করিয়াছিলেন ফররুখ আহমদ। না বলিয়া না কহিয়া এইটার মালিকানা আত্মসাত করিতেছিলেন পত্রিকা মালিক ও লীগ নেতা মৌলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ। মালিকানার বিষয় লইয়া কলিকাতার আদালতে একটা মামলাও উঠিয়াছিল। দুঃখের মধ্যে, মামলা নিষ্পত্তির আগে বাদী-বিবাদী দুইজনেরই সোয়াদের পাকিস্তান কায়েম হয়। (ওসমান ২০০৭: ২৯২)
খানিক কনিষ্ঠ আবদুল হক জানাইতেছেন তিনি ফররুখ আহমদকে ১৯৪৫ সাল হইতে জানিতেন। কলিকাতাতে তাঁহাদের পরিচয়। আবদুল হকের দাবি, একটা কথা ফররুখ আহমদের কাব্য বিচারকালে সবসময় মনে রাখিতে হইবে: ‘তিনি একান্তভাবে পাকিস্তান আন্দোলনের সৃষ্টি।’ তবে তিনি একথাও স্বীকার করিয়াছেন, ‘কিন্তু এ আন্দোলনের যাবতীয় তাৎপর্য সম্বন্ধে তিনি সচেতন ছিলেন একথা বলা কঠিন।’ আবদুল হকের ভাষ্যানুসারে: ‘পাকিস্তান আন্দোলন ছিল সাম্প্রদায়িক জাতীয়তার আবরণে বিশুদ্ধ রাজনৈতিক আন্দোলন, ধর্মীয় আন্দোলন নয়। এর মূল কথা ছিল প্রতিবেশী সম্প্রদায়ের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতা, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং সেই সঙ্গে সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধের সংঘাত।’ কিন্তু এ সম্বন্ধে ফররুখ আহমদের পরিষ্কার ধারণা ছিল না। হক অকপটে স্বীকার করিয়াছেন, ‘অনেকদিন আমারও ছিল না’। ফররুখ আহমদ বিশ্বাস করিতেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অর্থ আদর্শস্বরূপ ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা। তাঁহার এ বিশ্বাসের গোড়া এতই মোটা ছিল যে সেই গোড়া কাল নামক নিঠুর কাঠুরিয়ার কঠোর কুঠারও ছুঁইতে পারে নাই।
এই প্রশ্নে আবদুল হকের ভাষ্য এই রকম: ‘তাঁর জীবনের শেষ পর্যায়ের তথ্য এখনও অপ্রকাশিত, কিন্তু যতদূর জানা গেছে, তিনি জীবনের শেষ মুহ‚র্ত অবধি আরও একটি রুঢ় বাস্তবকে স্বীকার করতে চাননি: তা হচ্ছে, পাকিস্তানী আমলের পঁচিশ বছরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা মিথ্যা হয়ে গিয়েছিল এবং এদেশ ক্রমে ক্রমে পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। সেই সঙ্গে জাতীয়তার ধারণাও বদলে গিয়েছিল।’ আবদুল হক বিষয়টা আরো প্রাঞ্জল করিয়াছেন: ‘অবিভক্ত ভারতের সাম্প্রদায়িক সংঘাতের মুখে বাঙ্গালি মুসলমান (এবং অবিভক্ত ভারতের অবশিষ্ট মুসলমান) নিজেদের মুসলিম জাতি (এবং পরে পাকিস্তানী জাতি) বলে বিশ্বাস করেছিল; কিন্তু পাকিস্তানী উপনিবেশবাদের শোষণে সেই বাঙ্গালি মুসলমানই বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছে এবং একটা নতুন জাতি, বাঙ্গালি জাতিতে পরিণত হয়েছে।’ (হক ২০০৪: ৫৫)
হকের এই বিচারটাকে মোটেও নাহক বলা যাইবে না। ধরুন এই ঘটনাটার কথা, যুদ্ধশেষে একদিন- ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর তারিখে- সীমান্তের ওপারফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের কাতার হইতে কয়েকজন অনুরাগী ও বেতারকেন্দ্রের সহকর্মী কবিকে দেখিতে তাঁহার বাসায় গিয়াছেন। ব্যক্তিগত কুশল বিনিময়ের ঘোরে কোন এক মেহমান ফররুখ আহমদকে আচমকা প্রশ্ন করিলেন: ‘দেশ স্বাধীন হয়েছে, আপনি খুশি হননি?’ ফররুখ আহমদ উত্তরে যাহা বলিয়াছিলেন তাহাতে বিশেষ শিক্ষার জিনিশ আছে। তিনি বলিয়াছিলেন: ‘আমার ব্যক্তিগত খুশি-অখুশিতে কি আসে যায়! আমি আগে যা ভাবতাম, এখনো তাই ভাবি। আমি মুসলমান, এ কথাটাই আমার কাছে বড়।’ (খোদা ২০০৪: ২১৫)
১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ত এক সহযোগীর নাম আখতার ফারুক। ইঁহার সাক্ষ্যটা বিশ্বাস করিতে হয়তো অনেকের আপত্তি থাকিবে না। ভদ্রলোক লিখিয়াছেন: ‘একাত্তরের সামরিক পদক্ষেপের পর মাঝে মাঝে আমরা [মানে ফররুখ আহমদ ও তিনি] মিলতাম। তিনি একদিকে পাঞ্জাবীদের মূর্খতাজনিত বাড়াবাড়ি ও অন্যদিকে ভারতের ষড়যন্ত্রমূলক কারসাজি দুটারই তীব্র সমালোচনা করতেন। বলতেন, এ শয়তানীর খেসারত দু’পক্ষকেই সুদে-আসলে দিতে হবে।’ (ফারুক ২০০৪: ৭৬)
ফররুখ আহমদের ভবিষ্যদ্বাণী পুরাপুরি ভুল প্রমাণিত হয় নাই। এর আংশিক খেসারত ফররুখ আহমদেরও কিছু কিছু দিতে হইয়াছিল। আহমদ ছফা একবার- কথাটা ১৯৭৪ সালের- রাগে-দুঃখে অভিযোগ করিয়াছিলেন, ফররুখ আহমদকে প্রকারান্তরে খুনই করা হইয়াছিল। কিভাবে? তিনি লিখিয়াছিলেন, ‘আমাদের দেশের বর্তমান শাসকশ্রেণী পণ্ডিত বলে কথিত যে মনুষ্যত্বহীন কলমধারী গুণ্ডাদের কর্তার আসনে বসিয়েছে, তাঁরা স্বাধীনতার পর দীর্ঘকাল কবিকে বেকার থাকতে বাধ্য করেছেন। কবি দেখেছেন চিকিৎসার অভাবে আপন তনয়াকে চোখের সামনে মরে যেতে। আপন সন্তানদের স্কুল-কলেজ থেকে বেরিয়ে এসে হন্যে হয়ে একমুঠা ভাত যোগাড়ের জন্য পথেঘাটে ঘুরে বেড়াতে দেখেছেন। মরবার আগে উপবাস করার সৌভাগ্যও তাঁর যথেষ্ট হয়েছিল।’ (ছফা ১৯৭৪)
ফররুখ আহমদের পুরানা বন্ধু আবু রুশদ অবশ্য আহমদ ছফার এই কথায় পূর্ণ সায় দেন নাই। দ্বিমত করিয়াছিলেন তিনি: ‘দেশবিভাগের পর ফররুখ আমাদের অনেকের মতই পাকিস্তানের খাতায় নাম লিখিয়ে রেডিও পাকিস্তানে চাকরি নিয়েছিল। মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর রাজনৈতিক আদর্শ-বিরোধী বাংলাদেশের জন্ম হওয়ার পরও সে রেডিওর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল।’ আত্মজীবনীর আরেক পাতায় আবু রুশদ প্রসঙ্গক্রমে লিখিয়াছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার তাঁর প্রতি কোন অনুদার বা অন্যায় ব্যবহার করেনি। বরঞ্চ তাঁর বাংলাদেশ দর্শনে কোন আস্থা না থাকলেও স্বাধীনতার পরে তাঁকে চাকরিতে বহাল রাখা হয়েছিল এবং তাঁর জন্য সরকারীভাবে নির্ধারিত একটা ফ্ল্যাটও বরাদ্ধ ছিল। মুজিব আমলের পরে বাংলাদেশের দুটি সর্বোচ্চ সাহিত্যিক পুরস্কারও তাঁকে দেওয়া হয়েছিল।’ আবু রুশদ অধিক গিয়াছেন। প্রসঙ্গক্রমে তিনি আরেক জায়গায়ও স্মরণ করিয়াছিলেন, ফররুখ আহমদ পাকিস্তান যুগে আদমজী পুরস্কার, প্রেসিডেন্ট পদক ইত্যাদি পাইয়াছিলেন। লিখিয়াছেন, ‘কবি প্রতিভার মানদণ্ডে তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া অবশ্যই অসঙ্গত হয়নি (এই পুরস্কার বেশ কয়েকজন অযোগ্য ব্যক্তির হাতে পড়েছে) কিন্তু যেহেতু বাংলাদেশ ভাবাদর্শের প্রতি তাঁর কখনোই কোন প্রবল আনুগত্য ছিল না তাই তাঁকে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া অনেক স্বাধীনতা সৈনিকের দৃষ্টিতে একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হয়েছিল।’ (রুশদ ১৯৯৮: ৬৫-৬৬; রুশদ ২০০৪: ৫৮)
বোধিনী
১. জমহুরিয়াত ইক তরজে হুকুমাত হ্যায় জিস ম্যায়।
বনদোঁ কো গিনা করতে হ্যায়, তোলা নাহিঁ করতে।। [জারবে কলিম]
২. গুরাজে আজ তরজি জমহুরি, গুলামে পুখ্তা করে শোব।
কি আজ মগজে দু শদ খার ফিকরি ইনসানি নামি আয়াদ।। [পয়ামে মাশরিক]
দোহাই
১. মুহম্মদ এনামুল হক, ‘বাঙ্গালী মুসলিম মানসে তুর্কী বিপ্লবের প্রভাব,’ মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, ৩য় খণ্ড, মনসুর মুসা (সম্পাদিত) (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪), ৬৪৩-৬৫৩।
২. Muhammad Enamul Hoque, ‘Cultural Revolution under Ataturk: Its impact on East Pakistan and her literature,’ মুহম্মদ এনামুল হক রচনাবলী, ৪র্থ খণ্ড, মনসুর মুসা (সম্পাদিত), (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫), ৪৫৭-৬৬৮।
৩. আহমদ ছফা, ‘এক সন্ধ্যার সংলাপ,’ আহমদ ছফার সাক্ষাৎকার সমগ্র (ঢাকা: খান ব্রাদার্স, ২০০৯), ৫৭-৮৭।
৪. ফররুখ আহমদ, ‘হাজার বছর পার হয়ে,’ পাকিস্তান আন্দোলন ও মুসলিম সাহিত্য, সরদার ফজলুল করিম (সম্পাদিত) (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৬৮), ১৮১-২।
৫. আবু রুশদ, আত্মজীবনী: ১৯১৯-১৯৮৮ (ঢাকা : এ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ১৯৮৮)।
৬. ফররুখ আহমদ, ‘নজরুল-প্রসঙ্গ,’ ফররুখ আহমদ রচনাবলী, আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত, ২য় খণ্ড (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬ [ক]), ৩২৬-২৭।
৭. ফররুখ আহমদ, ‘নজরুল সাহিত্যের পটভূমি,’ ফররুখ আহমদ রচনাবলী, আবদুল মান্নান সৈয়দ সম্পাদিত, ২য় খণ্ড (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৯৬ [খ]), ৩২৭-২৯।
৮. আবদুল মান্নান সৈয়দ, ‘পরিশেষ,’ ফররুখ আহমদ রচনাবলী, ১ম খণ্ড (ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯৫), ৫৩৯-৬০৫।
৯. মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, ‘ফররুখ আহমদ: কবি ও ব্যক্তি,’ সাহিত্য ও সাহিত্যিক (ঢাকা : মুক্তধারা, ১৯৭৮), ১৭০-১৮৬।
১০. মুজীবুর রহমান খাঁ, ‘নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা,’ ফররুখ আহমদ : ব্যক্তি ও কবি, শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত, তৃতীয় সংস্করণ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০৪), ৩০৫-৩১৭।
১১. মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত : আধুনিক যুগ (ঢাকা : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৬), ২৯৭-৩২৯।
১২. আবদুল হক, ‘ফররুখ আহমদ,’ ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি, শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত, ৩য় সংস্করণ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০৪), ৪৯-৫৬।
১৩. ফজল-এ-খোদা, ‘তাঁর তুলনা তিনি নিজেই,’ ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি, শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত, ৩য় সংস্করণ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০৪), ২১৪-২০।
১৪. শওকত ওসমান, রাহনামা ২ : অন্য রূপান্তর ও ভুবন চত্বরে (ঢাকা : সময় প্রকাশ, ২০০৭)।
১৫. আখতার ফারুক, ‘এক বিস্ময়কর মানুষ,’ ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি, শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত, ৩য় সংস্করণ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০৪), ৭৫-৭৬।
১৬. আবদুল কাদির, ‘নবীন কবি ফররুখ আহমদ,’ সওগাত ২৯ : ৬ (বৈশাখ ১৩৫৪), ৩০৭-৩১০।
১৭. রশীদ করীম, জীবন মরণ (ঢাকা : সাহিত্য প্রকাশ, ১৯৯৯)।
১৮. আহমদ ছফা, ‘একজন সাহসী শক্তিমান কবি,’ গণকণ্ঠ, ১০ নভেম্বর ১৯৭৪।
১৯. আবু রুশদ, ‘আমার বন্ধু ফররুখ,’ ফররুখ আহমদ: ব্যক্তি ও কবি, শাহাবুদ্দীন আহমদ সম্পাদিত, ৩য় সংস্করণ (ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ২০০৪), পৃ. ৫৭-৫৯।
২০. P. N. Dhar, Indira Gandhi, the ‘Emergency,’ and Indian Democracy, Second impression (New Delhi: Oxford University Press, 2007).
২১. Zafar Anjum, Iqbal: The Life of a Poet, Philosopher and Politician (Gurgaon: Random House, 2014).