রুশ ভাষায় বরিশালের গণমাধ্যম নিয়ে গবেষণা
রাশিয়ার অন্যতম সেরা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান লামানোসোভ মস্কো স্টেট ইউনিভার্সিটি (এমএসইউ)। শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞানসহ রুশ সমাজের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়ে থাকে রাশিয়ার এই আদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ২০১৫ সালের কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিংয়ে এমএসইউ ১০৮ নম্বরে স্থান পায়।
গত ২০ মে বিশ্ববিদ্যালয়টির সাংবাদিকতা অনুষদে ‘মিডিয়া গবেষণায় সমসাময়িক সমস্যা’ শীর্ষক এক আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সাংবাদিকতা অনুষদ, জাতীয় গণমাধ্যম গবেষণা অ্যাসোসিয়েশন এবং বেসরকারি গবেষণা কেন্দ্র ভিআই যৌথভাবে দিনব্যাপী ওই সম্মেলনের আয়োজন করে।
সম্মেলনে বহির্বিশ্বের মিডিয়া কাঠামো বিভাগে আমার লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ‘মূলধারার গণমাধ্যম ও নিউ মিডিয়ার সঙ্গে বরিশাল নগরীর স্থানীয় পাঠক বা ব্যবহারকারীদের সম্পর্ক’ শিরোনামের ওই প্রবন্ধে প্রায় পাঁচ মাসের একটি গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়। রুশ ভাষায় বরিশালের স্থানীয় গণমাধ্যমের ওপর এটিই প্রথম কোনো গবেষণাকর্ম।
বরিশাল থেকে পরিবেশিত মেইনস্ট্রিম বা প্রথাগত মিডিয়ার (প্রিন্ট, অনলাইন ও রেডিও) বর্তমান হালচাল, কনটেন্ট বিন্যাস, মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট পরিধি, ইন্টারঅ্যাকটিভিটি, ইউজিসি কনটেন্ট ব্যবহার, পাঠকদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রক্রিয়া ও সাংবাদিকতা পেশায় বিরাজমান সমস্যাবলি গবেষণায় উঠে আসে। প্রচারসংখ্যা আর ব্যবহারকারীর দিক দিয়ে শীর্ষ প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকার একটি তালিকা এতে তৈরি করা হয়।
স্বল্প দাম আর সহজলভ্যতার কারণে স্থানীয় দৈনিক খবরের কাগজের ওপর নির্ভর করেন বরিশালের মধ্য বয়সী পাঠকরা। তা ছাড়া বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পেতে এই গণমাধ্যমটি নিয়ে তাঁদের বেশি ভরসা। সমীক্ষায় দেখা যায়, ৪০ থেকে ৬৫ বছর বয়সী পাঠকদের মধ্যে শতকরা প্রায় ৮০ শতাংশ প্রাত্যহিক জীবনের কোনো এক ফাঁকে স্থানীয় পত্রিকায় চোখ বোলান। তবে তরুণ পাঠকদের মাঝে স্থানীয় পত্রিকা পড়ার প্রবণতা তেমন নেই বললেই চলে।
বরিশালে কবে থেকে অনলাইন পত্রিকা চালু হয়েছে এ নিয়ে অনেক মতবিরোধ থাকলেও ২০০৭ সালে প্রথম এ জনপদে অনলাইন পত্রিকার আত্মপ্রকাশ ঘটে বলে গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া গেছে। বরিশালে বর্তমানে প্রায় ২০টি স্থানীয় অনলাইন পত্রিকা চালু আছে। এ ছাড়া অনলাইন সংস্করণ রয়েছে অন্তত আটটি ছাপা পত্রিকার।
তবে এ অঞ্চলে অনলাইন পত্রিকার সংখ্যা বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়েনি অনলাইন সাংবাদিকতার গুণগত মান। মূল সংবাদ পরিবেশন করা ছাড়াও পাঠকদের আকর্ষণ সৃষ্টিতে পত্রিকাগুলোর নানা রকম মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট ও ইন্টার-অ্যাকটিভ সেবার মান বাড়ানো উচিত।
তা ছাড়া বেশির ভাগ পত্রিকা সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যাপারে অনেক উদাসীন এবং তা ব্যবহারের জন্য তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা নেই। প্রায়ই সময় দেখা যায়, অনুমতি ছাড়াই অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলো জাতীয় পত্রিকার কোনো সংবাদ, কলাম, তথ্য বা ছবি প্রকাশ করে কপিরাইট আইন লঙ্ঘন করছে।
আশার কথা হচ্ছে, এরই মধ্যে মানসম্মত অনলাইন পত্রিকা হিসেবে ‘আমাদের বরিশাল ডটকম’, ‘বরিশাল নিউজ ডটকম’, ও ‘বরিশাল লাইভ টোয়েন্টিফোর ডটকম’ দেশ-বিদেশে বসবাসরত বরিশাল কমিউনিটির মধ্যে বিপুল সাড়া ফেলেছে। ২৪ ঘণ্টা তাৎক্ষণিক তরতাজা সংবাদ পরিবেশনা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় উপস্থিতি আর মাল্টিমিডিয়া কনটেন্ট উপভোগের সুযোগ থাকায় এসব অনলাইন পত্রিকা পাঠক চাহিদা পূরণ করতে পারছে।
বরিশালের স্থানীয় শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ এখন সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকছে। দিনের অনেকটা সময় তাদের কাটে ফেসবুক, টুইটার আর ইউটিউবে ভিডিও দেখে। অবসর সময়টায় বিনোদনের খোরাক জোগাতে তাঁরা এসব অনলাইন মাধ্যমকে বেছে নিচ্ছেন।
নাগরিক সাংবাদিকতা চর্চার প্লাটফর্ম হিসেবে বরিশালের এসব গ্রুপ কিংবা পেজ নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে এখন নিয়মিত আলোচনা হচ্ছে। বিশেষ করে বরিশাল জেলা প্রশাসন কর্তৃক পরিচালিত ‘বরিশাল সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক ফেসবুক গ্রুপটির কথা গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা হয়।
২০১৫ সালের আগস্টে চালু হওয়া এ গ্রুপের মাধ্যমে বরিশালবাসীকে ত্বরিত সেবা নিশ্চিত করার উদ্ভাবনী কৌশল দেশের বিভিন্ন অঙ্গনে সুনাম কুড়িয়েছে।
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমকে প্রশাসন আর নাগরিকদের মাঝে নিয়মিত যোগাযোগের একটি প্লাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করে সেখান থেকে কীভাবে নাগরিক সেবা দেওয়া আর নেওয়া যায় সে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়। গ্রুপ সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা ও সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের পারস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে সম্মিলিত প্রয়াসের মাধ্যমে বরিশালের তিন শতাধিক নাগরিক সমস্যার সমধান করা হয়েছে। নাগরিকদের মনে ইতিবাচক ধারণা তৈরি করতে সৃজনশীল এ উদ্যোগটি বিশেষ ভূমিকা রাখছে।
সাংবাদিকতার আলোকে এ গ্রুপের প্রতিটি সদস্য বস্তুত একজন নাগরিক সাংবাদিকের ভূমিকা পালন করছেন। কনটেন্ট প্রকাশের কাজে তাঁরা অধিকাংশ ক্ষেত্রে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। দ্রুত গুরুত্বপূর্ণ কোনো পোস্ট প্রকাশ করা কিংবা অন্যের দেওয়া পোস্টে মতামত জানানোর কাজে তাদের স্মার্টফোনটি হচ্ছে যেন ‘সুইস আর্মি নাইফ’।
নাগরিক সাংবাদিক সমাজের অনেক অসঙ্গতি, অনিয়ম কিংবা সম্ভাবনার কথা তুলে ধরছেন। কখনো বা ‘ব্রেকিং নিউজ’-এর মতো জরুরি খবর প্রচার করছেন তাঁরা। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষদের সমস্যা ও সম্ভাবনার গল্প বলে তাঁরা দিন বদলের সহযোগী হচ্ছেন, রচনা করছেন ‘ইমপ্যাক্ট জার্নালিজম’ চর্চার অনন্য দৃষ্টান্ত। সাধারণ নাগরিকের এসব পোস্টের লেখা, স্থিরচিত্র, ভিডিও কিংবা অডিও কনটেন্ট যা পেশাগত সাংবাদিকদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ খবরের সূত্র হয়ে উঠছে। তাই নতুন খবরের সন্ধান পেতে গ্রুপটির নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন তাঁরা।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বরিশালের স্থানীয় গণমাধ্যমগুলো নিজেদের অবয়ব, কনটেন্ট সেবার মান ও মিডিয়া প্লাটফর্মের বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করছে। যদিও বিভিন্ন খাতে অনেক সমস্যা বিরাজ করলেও আগামীতে এ অঞ্চলে গণমাধ্যমের উন্নয়ন নতুন এক পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেই সঙ্গে নিউ মিডিয়া ব্যবহারের যে সুফল আজ বরিশালবাসী পেতে শুরু করেছেন তা ভবিষ্যতে সাধারণ মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।
লেখক : নিউ মিডিয়া বিশেষজ্ঞ ও প্রভাষক, গণযোগাযোগ বিভাগ, পিপলস ফ্রেন্ডশিপ ইউনিভার্সিটি, মস্কো। [email protected]