ঢাকার কথা ৪১
পুরান ঢাকার বিয়ের অনুষ্ঠান
ঐতিহ্যগত দিক থেকেই পুরান ঢাকার মানুষ অনন্দ প্রিয়। যেকোনো উপলক্ষে আনন্দ অনুষ্ঠানে মেতে উঠতে পছন্দ করত। পুরান ঢাকার এ ধরনের সরস চিত্রের খোঁজ পাওয়া যায় উনিশ ও বিশ শতকের নানা সূত্রে। ঢাকাবাসীর আনন্দ অনুষ্ঠানের একটি বড় জায়গাজুড়ে রয়েছে বিয়ে উৎসব। এই গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক অনুষ্ঠানটি অত্যন্ত জাঁকালোভাবে উদযাপন করতে পছন্দ করত ঢাকার মানুষ।
বিয়ের নানা আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়ে যেতো অনেকদিন আগে থেকেই। বরপক্ষ কনের বাড়িতে এসে যেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ের প্রস্তাব দিত সেদিন থেকেই মূলত বিয়ের উৎসব শুরু হয়ে যেতো। এটি ‘পানচিনির’ অনুষ্ঠান নামে পরিচিত ছিল। সেকালে পারিবারিক পছন্দে ও আয়োজনেই বেশিরভাগ বিয়ে সম্পন্ন হতো। এ ক্ষেত্রে ঘটকের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। পাত্রপাত্রীর খোঁজ থেকে শুরু করে বিয়ে সম্পন্ন করা পর্যন্ত ঘটকের উপস্থিতি ও মধ্যস্থতা ছিল অপরিহার্য। ঢাকাইয়া ভাষায় ঘটককে বলা হয় ‘মোতাসা’। এঁরা ছিলেন পেশাজীবী ঘটক। পানচিনি বা পাকাকথার অনুষ্ঠানে বর-কনে উভয় পক্ষের কিছু প্রস্তুতি থাকত। বরপক্ষের যাঁরা কনের বাড়িতে যেতেন তাঁরা সাথে করে নিয়ে যেতেন নানা ধরনের মিষ্টি এবং পান-সুপারি। এর পরিমাণ সাধ্য অনুযায়ী হতো। তবে বেশি নেওয়ার সাথে একটি আভিজাত্যের প্রশ্ন ছিল। এরও কারণ আছে। পান-চিনি অনুষ্ঠান শেষে কনেপক্ষ তাদের আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে সেসব মিষ্টি ও পান-সুপারি পাঠিয়ে বিয়ের পাকা কথার সংবাদ জানাত। পানচিনি অনুষ্ঠানে বর নিজে আসতে পরত না। কনে পক্ষ এদিন বরপক্ষের অতিথিদের নানা পদে বিশেষ আপ্যায়নের আয়োজন করত।
ঢাকার বিয়েতে সাধ্যাতিরিক্ত দান সামগ্রী বরের বাড়িতে পাঠানো আভিজাত্যের লক্ষণ ছিল। এখানে কিছুটা লোক দেখানোর বিষয়ও ছিল। দান সামগ্রী কুলির মাথায় সদর রাস্তা দিয়ে মিছিল করে পাঠানো হতো। তবে উচ্চবিত্ত সমাজেই এমন প্রচলন বেশি লক্ষ করা যেত।
বর্তমান নাগরিক সমাজে নানা বাস্তবতায় ‘নাইওর’ প্রথাটি এখন প্রায় হারিয়ে যাচ্ছে। এককালে ঢাকার বিয়েতে বিয়ে অনুষ্ঠানের অনেক আগে থেকে নিকটাত্মীয় নাইওরিরা এসে জমজমাট করে ফেলত বিয়েবাড়ি। মেয়েরা গোল হয়ে বসে বিয়ের গীত গাইত। সে যুগেও বিয়ের আগে গায়ে গলুদ একটি জমজমাট আনন্দ অনুষ্ঠান ছিল। ঢাকার বিয়েতে দুই-তিনদিন ধরে বর-কনের গায়ে হলুদ চলত। ঢাকাবাসী সাধারণত এই আয়োজনকে ‘তেলাই’ বলে থাকে। আধুনিক সময়ে তেলাই নামটি প্রায় অপরিচিত হয়ে উঠছে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানের জন্য বরপক্ষ কনের বাড়িতে মিষ্টি, মাছ এবং কাপড়সহ হলুদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত নানা দ্রব্য সামগ্রী নিয়ে যেত। যত কিছুই নেওয়া হোক না কেন, দই এবং বড় আকারের দুটো মাছ নেওয়া ছিল আবশ্যিক। মাছের একটি হতো বর আর অন্যটি হতো কনের প্রতীক। মাছ দুটোকে সাজানো হতো সেভাবেই। এই মাছ যে কুটবে তার জন্য মজা করে উপহার দেওয়া হতো। মাছের মুখের ভেতর গুজে দেওয়া হতো টাকা। মাছ কুটতে গেলে সেই টাকা বেরিয়ে আসত। নাইওরিতে আসা মেয়েরা উৎসাহের সাথে মাছ কাটা, হলুদ বাটায় অংশ নিত। শুধু বর কনে নয় হলুদ মাখামাখি এবং রং ছিটানোতে আত্মীয়স্বজনরাও অংশ নিত।
সেকালে বিয়ে বাড়ির সাজসজ্জায় কোনো প্রতিষ্ঠান বা ডেকোরেটরের প্রয়োজন ছিল না। আত্মীয়-পরিজন ও পাড়ার যুবকরা উৎসাহের সাথে এ কাজে লেগে যেত। তারা রঙিন কাগজ কেটে ঝালর পতাকা ইত্যাদি বানিয়ে সদর রাস্তা থেকে বাড়ি পর্যন্ত ঝলমলে করে তুলত।
বিত্তশালীদের বিয়ে অনুষ্ঠানে বরযাত্রী টমটম গাড়িতে চড়ে কনের বাড়িতে যেত। কনের বাড়ি বুড়িগঙ্গার ওপারে হলে নৌকা সাজানো হতো। একই সাথে রাতের বিয়েতে অথবা বিয়ে উৎসবের রাতে পোড়ানো হতো হাউই বাজি। ফানুস ওড়ানোর রীতিও ছিল। বর্তমান সময়ে ‘প্রীতি উপহার’ বিতরণের রেওয়াজ প্রায় উঠেই গেছে। আগে এটি ছিল বিয়ের আসরের একটি আবশ্যিক অঙ্গ। রঙিন কাগজে ছাপা এক পক্ষ অন্য পক্ষের উদ্দেশে রঙ্গ-ব্যাঙ্গ করে লেখা কথামামালা থাকত এই উপহারে।