গুলশান ৭/১
বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে আইএস ও আল-কায়েদা
তুরস্ক ও বাংলাদেশের ওপর আঘাত সম্ভবত আইএসের তথাকথিত ইসলামিক খেলাফত জারি রাখার বাসনারই একটি অংশ। সাধারণ মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যদি মূল লক্ষ্য হয়ে থাকে, সে ক্ষেত্রে এই সন্ত্রাসবাদীদের জন্য বিগত সপ্তাহটি ছিল পুরোপুরি সফল।
ব্রেক্সিট-পরবর্তী পরিস্থিতির আলোচনা ছাপিয়েও এই ইসলামী জঙ্গিরা ঠিকই আলোচনায় আসতে পেরেছে। তারা দুটি বড় ধরনের আক্রমণ চালিয়েছে খুব কম সময়ের মধ্যে। তুরস্কের বিমানবন্দরে বোমা হামলায় হত্যা করেছে ৪১ জন মানুষ, আর সেখান থেকে প্রায় চার হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত বাংলাদেশে ২০ জন (২২ জন—অনুবাদক) মানুষকে হত্যা করেছে; যারা অস্থিতিশীল হয়ে ওঠা এই দেশটির রাজধানী ঢাকার কূটনৈতিক এলাকা গুলশানের একটি রেস্তোরাঁয় নৈশভোজ করছিলেন।
একই সময়ে আরো কিছু আক্রমণের ঘটনা বলতে গেলে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে আড়ালে। ক্যামেরুনের দক্ষিণাঞ্চলে আত্মঘাতী বোমা হামলায় ১১ জনের মৃত্যু, কেনিয়ার ঘটনা, আফগানিস্তানে ভয়াবহ বোমা হামলা। জঙ্গি আক্রমণের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি, যেসব ঘটনায় পশ্চিমা নাগরিক বেশি মারা যাচ্ছে, সেগুলোর বিষয়ে ফলাও করে প্রতিবেদন করা হচ্ছে। বাকিগুলো একরকম আবহ সংগীতের মতোই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে।
আপাতদৃষ্টিতে তুরস্ক ও বাংলাদেশের ওপর আক্রমণ আইএসের পরিচালিত বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। রাকা থেকে বোমা হামলাকারীদের নিয়ে নিজেদের প্রধান দপ্তর সিরিয়ায় নিয়ে এসেছিল আইএস—ইস্তাম্বুল আক্রমণের জন্য। তবে ঢাকার ক্ষেত্রে পশ্চিমা কর্তৃপক্ষের বিশ্বাস, স্থানীয় কর্মীরাই ঢাকায় ব্যবহৃত অস্ত্রাদির ব্যবস্থা করেছে।
পশ্চিমা গোয়েন্দা ও বিশ্লেষকরা বহুদিন ধরেই সতর্ক করেছেন, পাল্টা আক্রমণের কারণে আইএস নিজেদের অবস্থান হারাতে শুরু করেছে, এ কারণেই তারা সন্ত্রাসী আক্রমণের ভয়াবহ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। গত মাসে সিআইএর পরিচালক জন ব্রেনান ইউএস সিনেট ইন্টেলিজেন্সকে বলেছিলেন, আইএসের ওপর চাপ বাড়ছে। এ কারণেই আমাদের ধারণা হচ্ছে যে বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের প্রচারণা তারা এখন ভয়াবহভাবে বাড়ানোর চেষ্টা করবে, যাতে তাদের বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ এজেন্ডার আধিপত্য জারি থাকে। তার এই অনুমান এখন সঠিক বলেই মনে হচ্ছে। ইরাকের ফালুজা, লিবিয়া, ইয়েমেন ও আফগানিস্তানে এ পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে। ব্রেনান আরো শঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, কেবল পশ্চিমাঞ্চলে আঘাত হানার দিকেই মনোযোগী আইএস—ঘটনা এমন নয়। বৈশ্বিক ‘জিহাদি’ আগ্রাসনে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারও এখানে একটি বিষয়। আইএসপ্রধান আবু বকর আল-বাগদাদি এবং আল-কায়েদার আইমান আল জাওয়াহিরির মধ্যে ব্যক্তিগত বৈরিতার সঙ্গে সঙ্গে প্রাধান্য বিস্তারের লড়াইয়ে এ দুই সংগঠনের দ্বন্দ্ব আরো ভয়াল হয়ে উঠেছে। সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত করে তোলার ক্ষেত্রে এটি গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়।
উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশের কথা বললে, এই দেশ অনেক দিন ধরেই আল-কায়েদার নজরে ছিল। দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের শুরুর সময় থেকেই হাজির ছিল আল-কায়েদা। সেখানে ঢাকায় আইএসের আক্রমণের বিষয়টি দেখিয়ে দেয়, প্রতিপক্ষের শক্ত ঘাঁটিতেও তাকে টপকে কঠিন হামলা করার ক্ষমতা রাখে আইএস।
তবে এই নতুনদের আগমনে পুরোনোদের কথা মাথা থেকে সরিয়ে দিলে চলবে না। আইএস ভয়াল হলেও ভঙ্গুর। এই সংগঠনের তথাকথিত ‘খেলাফত’ সম্প্রসারণ এক উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য, আর সে কারণেই দুর্বল। বিভিন্ন পরাজয় আর পিছিয়ে আসাকে হয়তো ‘স্রষ্টার পথে আত্মত্যাগে’র মহিমা দেওয়ার চেষ্টা করা হবে, তবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চলে (রাকা, মসুল) আধিপত্য হারানোর বিষয়টি এই সংগঠনের বিভিন্ন দাবি এবং তাদের নেতার নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলেছে।
(সংক্ষেপিত)
জেসন বার্ক : তিনি ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানের আফ্রিকা প্রতিনিধি। তাঁর কর্মকাণ্ড জোহানেসবার্গকেন্দ্রিক হলেও আফ্রিকাজুড়েই কাজ করেন। বৈদেশিক সংবাদ প্রতিনিধি হিসেবে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে বিভিন্ন ঘটনায় কাজ করেছেন। ইসলামী জঙ্গিবাদ নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কিছু লেখা রয়েছে। ২০০১ সালে আফগানিস্তান এবং ২০০৩ সালে ইরাক যুদ্ধের ঘটনা তিনি কভার করেছেন। ওপরের কলামটি দ্য গার্ডিয়ানের অনলাইন সংস্করণে গত ২ জুলাই প্রকাশ হয়। লেখাটি ভাষান্তর করেছেন সামি আল মেহেদী।