দৃষ্টিপাত
ব্রাজিলের অভিশপ্ত অলিম্পিক যাত্রা
‘ফোরা টেমার’ পর্তুগিজ এই কথার অর্থ ‘টেমার বিদায় নাও’। রিও অলিম্পিকে বেলো হরিজন্তের মাঠে যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্স নারী দলের ফুটবল খেলা চলাকালে ১২ দর্শককে এই কথা লেখা টি-শার্ট পরার কারণে বের করে দেওয়া হয়। ওই সময় তাদের হাতে যে প্ল্যাকার্ড ছিল, সেখানে লেখা ছিল তা হলো, ‘গণতন্ত্র ফিরে এসো’।
এখন প্রশ্ন হলো, কে এই টেমার? লোকজন কেনই বা অলিম্পিকের মতো আসরে গিয়ে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে বলে? টেমার ব্রাজিলের অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট। হয়তো এ সময়ে ব্রাজিলের সবচেয়ে বিতর্কিত ও অজনপ্রিয় ব্যক্তিও তিনি। দিলমা রুসেফের বিতর্কিত অভিশংসনের পর এই টেমার ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন।
এ বছরের ১২ মে থেকে ৬ আগস্ট। দিলমা রুসেফের বিদায়ের তিন মাস পূর্ণ হওয়ার আগেই ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে বসেছে ভবজগতের সবচেয়ে বড় ক্রীড়াযজ্ঞ অলিম্পিক। অনেক দিক বিবেচনায় এবারের অলিম্পিক অন্য সব আসরের চেয়ে ভিন্ন এবং এর মাত্রাও আলাদা।
একদিকে রিও অলিম্পিককে নিজের প্রতিশোধের মিশন হিসেবে নিয়েছেন ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট দিলমা রুসেফ। তাঁর সমর্থকরা সুযোগ পেলেই রিওতে ঝামেলা তৈরির করার চেষ্টা করছে। যদিও তারা সেটাকে টেমারবিরোধী প্রতিবাদ বলেই চালাতে চাইছে। অন্যদিকে টেমারও চাইছেন, অলিম্পিককে ব্যবহার করে নিজের ক্ষমতাকে আরো মজবুত করতে। স্পোর্টসকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার এই ধারা বেশ পুরোনো। এর আগেও ’৭৮-এর ফুটবল বিশ্বকাপকে কাজে লাগিয়ে নিজের স্বৈরাচারী শাসনকে জায়েজ করার চেষ্টা করেছিলেন আর্জেন্টিনার সামরিক শাসক জেনারেল ভিদেলা। এমনকি হিটলারও খেলাধুলাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে এতটুকু ছাড় দেননি।
দিনকয়েক আগে রিওতে অলিম্পিকের সঙ্গে সমানুপাতে চলমান রাজনৈতিক বিতর্কের পর প্রশ্ন উঠেছে, কীভাবে অলিম্পিক পলিসির মধ্যে ব্রাজিলিয়ান নাগরিকদের বাকস্বাধীনতাকে স্থান দেওয়া যেতে পারে, তা নিয়েও।
এ বিষয়ে ব্রাজিলের সুপ্রিম কোর্টের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইরেস ব্রিত্তো বলেন, ব্রাজিলের স্থানীয় আইনে এমন কিছু নেই, যা দর্শককে খেলার মাঠে রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার কারণে বের করে দিতে পারে। বিশেষ করে কেউ যদি শান্তিপূর্ণভাবে কারো উদ্দেশ্য নিয়ে ‘আউট’ লেখা প্ল্যাকার্ড নিয়ে দাঁড়ায়, সেটি তাঁর মত প্রকাশের স্বাধীনতা।
তবে ব্রাজিলিয়ানদের এই মত প্রকাশের স্বাধীনতা বিদেশি দর্শকদের মধ্যে আতঙ্ক এবং হতাশা তৈরি করেছে। তাঁরা কেউ কেউ এসব প্রতিবাদ অবিলম্বে বন্ধের দাবিও জানিয়েছেন।
অলিম্পিক কমিটির একজন মারিও আন্দ্রাদা। তিনি বলেন, ‘অলিম্পিকের ইতিহাসে আর কোনো আয়োজক দেশ আয়োজনের এত কাছে এসে এই ধরনের রাজনৈতিক সমস্যার মধ্যে দিয়ে যায়নি। কিন্তু তার মানে এই নয় যে অলিম্পিকের আয়োজনের ওপরে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে অথবা অলিম্পিক আয়োজনে আমরা কোনো আপস করব।’
অলিম্পিকেই হয়তো শেষ নয়। আসল সমস্যা তৈরি হবে অলিম্পিক শেষ হওয়ার পরপর। উৎসব শেষের বিষাদের সঙ্গে সঙ্গে যখন যাবতীয় নাগরিক সমস্যা জ্বালামুখ ফেটে বেরিয়ে আসবে, তখন টেমার কতটা তা সামাল দিতে পারবেন, তার ওপর নির্ভর করছে তার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও।
তবে এ পর্যন্ত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্যটিও এসেছে রিওর কমিউনিকেশন ডিরেক্টর মারিও আন্দ্রাদার কাছ থেকেই। তাঁর মতে, রিওতে যদি ন্যূনতম প্রতিবাদ করতে না দেওয়া হয়, তবে মারাকানার দর্শকসংখ্যা অর্ধেক হয়ে যাবে। যদি সে রকম কিছু হয়, তা আয়োজনের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এমনিতে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত টেমার সরকার অলিম্পিক থেকে কিছু অর্থ তুলে আনতে চাইছে। তাই সম্ভবত এ কাজটি করার সাহস করবে না। একটা মাত্রা পর্যন্ত প্রতিবাদ তাদের সহ্য করে যেতে হবে। এমনকি কেউ কেউ রিওতে সহনীয় মাত্রায় প্রতিবাদ জারি রাখতে অলিম্পিক আইন পরিবর্তনের দাবিও জানিয়েছেন।
তবে বিশ্বকাপ ফুটবলের পর অলিম্পিক—এ দুই আসরের ফাঁদে ব্রাজিলের এরই মধ্যে কম্বল উজাড় হয়ে গেছে। বলা হচ্ছে, ১৮২২ সালে পর্তুগালের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ব্রাজিল এত বড় রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্যে আর পড়েনি।
ব্রাজিলের বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক ভেরাস ডি অলিভিরার মনে করছেন, গত চার বছরে ব্রাজিলে বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে, যা সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছে। যেমন—এর মধ্যে ব্রাজিলে ওয়ার্কার্স পার্টির দুর্নীতির বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু হয়েছে, ধর্ম প্রচারক, চার্চ এবং তাদের রাজনৈতিক ব্যবহারকারীদের সংখ্যাও অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই সঙ্গে ব্রাজিলের মিডলক্লাস জনগোষ্ঠীর মধ্যে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি ফ্যাসিস্ট মনোবৃত্তি দেখা যাচ্ছে।
আসর শুরুর দিন কয়েক আগে বিশেষজ্ঞদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, সাঁতারসহ পানিনির্ভর খেলাগুলাতে যেন অ্যাথলেটরা মুখ বন্ধ রাখেন। ব্রাজিলের পানি এতই নোংরা যে তা পেটে গেলে ভয়ংকর কিছু হয়ে যেতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অ্যাথলেটরা মুখ বন্ধ রেখে খেলার পর যার যার বাড়ি ফিরে যাবে; কিন্তু এর পর জনস্বাস্থ্য যে বিভীষিকার সামনে গিয়ে দাঁড়াবে, তা মোকাবিলা করবে কীভাবে? যার উত্তর হয়তো কারো কাছেই নেই। এ থেকে বোঝা যায়, কেন আগত অতিথি এবং খেলোয়াড়দের উদ্দেশ করে পুলিশ ‘ওয়েলকাম টু হেল’ লেখা ব্যানার নিয়ে এয়ারপোর্টে দাঁড়িয়ে থাকে।
অথচ ২০০৯ সালে ব্রাজিল যখন অলিম্পিক আয়োজনের দায়িত্ব পায়, তখন তাদের অর্থনীতি দারুণভাবে এগিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে তা আর সেখানে স্থির থাকেনি। বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনৈতিক অস্থিরতাসহ নানা কারণে তাদের অর্থনৈতিক গ্রাফ ক্রমে নিচের দিকে নেমেছে। এখন এই প্রশ্নও তোলা যায়, এ রকম দুটি মহাযজ্ঞের চাপ তাদের ওপর ইচ্ছাকৃভভাবে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল কি না? যাতে ব্রাজিলের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারাকে কৌশলে নিচের দিকে নামিয়ে আনা যায়। দক্ষিণ আমেরিকার দেশ হিসেবে ব্রাজিলের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ইউরোপ ও আমেরিকার জন্য সুখকর হবে না। যদি তেমনটা হয়ে থাকে, তবে গ্লোবাল রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে তা মোটেই অবাক হওয়ার মতো নয়। এমনকি অলিম্পিক স্টেডিয়ামের পেছনে যে খরচ করা হয়েছে, এখন তাকে অহেতুক দাবি করছে অনেক ব্রাজিলিয়ান। কেউ কেউ বলেছেন, এ টাকা গণস্বাস্থ্যে ব্যয় করলে বরং বেশি ভালো হতো। এক জরিপে দেখা গেছে, ব্রাজিলের প্রায় ৫১ ভাগ মানুষ তো অলিম্পিকের প্রতি কোনো আগ্রহই বোধ করে না। আর প্রতি একশজনে এমন ৩৩ জন আছেন, যাঁরা মনে করেন অলিম্পিক তাঁদের লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশি করবে। কারো কারো মত এই যে, রিওর হাসপাতালগুলো পর্যন্ত এখন আর নিরাপদ নয়। এ পরিস্থিতিতে রিও-পরবর্তী ব্রাজিলের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা যে ভয়াবহ শঙ্কার মুখে দাঁড়িয়ে, তা বলা বাহুল্য। এরপর এবারের আরেক আলোচিত বিষয় হচ্ছে ব্রাজিলে ক্রমশ ছড়িয়ে পড়তে থাকা জিকা ভাইরাস। শুধু এ কারণেই অনেকে অ্যাথলেট অলিম্পিক থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এরপরও কতজন অ্যাথলেট শরীরে জিকা বাঁধিয়ে ফিরবেন, সে আশঙ্কাও থাকছে।
সবশেষে বলা যায়, অলিম্পিক-পূর্ববর্তী ব্রাজিল এবং অলিম্পিক-পরবর্তী ব্রাজিল একই অবস্থায় থাকবে না। যে সংকটগুলো ব্রাজিলের জন্য সামনে অপেক্ষা করছে, তা প্রশাসন ও জনগণ কতটা সামাল দিতে পারবে তার ওপর নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ। তবে সংকটের বৈচিত্র্য এত বেশি কাজটা মোটেই সহজ হবে না। বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যে ভয়াবহ রকমের বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এখন প্রশ্ন ফুটবলের ইতিহাসে বহুবার খাদের কিনারা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর রেকর্ড আছে যে দেশটির, তারা কি পারবে অলিম্পিকের ইতিবাচক দিকগুলো কাজে লাগিয়ে এইসব সংকট কাটিয়ে আবার ফিরে আসতে?
লেখক : ক্রীড়া সাংবাদিক