ট্রাম্পের বিজয়
মার্কিন ইতিহাসের ট্র্যাজেডি
ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এখন আলোচনা-সমালোচনা-প্রতিবাদ ছাপিয়ে আরও বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে একটি বিষয়— উদ্বেগ। ট্রাম্পের এই বিজয় মার্কিন ইতিহাস বা রাজনীতিতে কেমন নজির হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে বিষয়ে নিজের মতামত জানিয়েছেন ‘দ্য নিউ ইয়র্কার’ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ডেভিড রেমনিক। এনটিভি অনলাইনের পাঠকদের জন্য বিশাল এই লেখাটি সংক্ষেপে ভাবানুবাদ করা হয়েছে। ভাষান্তরের কাজটি করেছেন সামি আল মেহেদী।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্বাচনে বিজয় কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। এই ব্যক্তিটির প্রেসিডেন্ট হওয়ার ঘটনাটি মার্কিন জাতির জন্যই কেবল নয়, সংবিধানের জন্যও একটি ট্র্যাজেডি। অন্যদিকে এই জয় দেশে-বিদেশে অক্ষশক্তির বাহকদের, উগ্র জাতীয়বাদী, কর্তৃত্ববাদী, নারীবিদ্বেষী এবং বর্ণবাদীদের জন্য এক বিজয়োল্লাস। ট্রাম্পের এই চমকে দেওয়া বিজয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার আসন্ন উত্থান— পুরো বিষয়টিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস এবং উদার গণতন্ত্রের পরিসরে এক নিকৃষ্ট নজির হয়ে থাকল। ২০১৭ সালের ২০ জানুয়ারি আমাদের প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ-মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে বিদায় জানানো হবে—যিনি একজন সুসংহত, গর্বিত এবং সহৃদয় চিত্তের নেতা। তাঁরই দেখতে হলো এমন একজন ব্যক্তিকে, যিনি কি না শেতাঙ্গদের আধিপত্য আর অপর জাতিগোষ্ঠীর প্রতি ভয়কে উসকে দিয়ে বাজিমাত করেছেন। এই সময়ে আসলে অস্থিরতা আর উদ্বেগ ছাড়া অন্য কোনো ধরনের অনুভূতি প্রকাশ করা কঠিন।
দুর্ভাগ্য আর ভোগান্তি এখন আসবেই। একটি প্রচণ্ড প্রতিক্রিয়াশীল সুপ্রিম কোর্ট, একটি প্রতাপশালী ডানপন্থী কংগ্রেস আর সেই সঙ্গে এমন একজন প্রেসিডেন্টের উত্থান যাঁর কি না নারী এবং সংখ্যালঘুদের প্রতি বিদ্বেষ, নাগরিক স্বাধীনতা কিংবা যেকোনো বিষয় নিয়ে যিনি ন্যূনতম ভদ্রতা বজায় রেখে কথা বলেন না—এসব মিলিয়ে দুর্বিষহ হয়ে ওঠার পথেই এগোবে পরিস্থিতি। ট্রাম্প হলেন বাঁধভাঙা কদর্য আচরণ এবং জ্ঞানশূন্য মানসিকতার মিশেলে গড়া এক নেতা। তিনি হয়তো অচিরেই অর্থনীতির বাজারকে ধ্বসিয়ে দেবেন আর সেই সঙ্গে দুর্বল, ভঙ্গুর আর অন্য যাদের কারণে এক সময়ে তিনি অপমানিত হয়েছেন; তাদের সবাইকে ভীত করে তোলার চেষ্টা করবেন, ধ্বংস করে দেওয়ায় মত্ত হবেন। এর মধ্যে রয়েছেন আফ্রো-আমেরিকান, হিস্পানিক, নারীরা, মুসলিমরা।
এই পুরো ঘটনায় এখন যেটা দেখার এবং বোঝার রয়েছে তা হলো আগামী বছরগুলো আসলে টিকে থাকার এক চরম লড়াই হতে যাচ্ছে। ফলাফলে কতটা ধ্বংস বা কতটা টিকে থাকার পরিসংখ্যান পাওয়া যাবে তা জানা না হোক, স্রেফ আশাবাদী হওয়াই এখন উপায়। এটা জাতি হিসেবে মার্কিনিদের জন্য একটি বিরাট পরীক্ষা হতে যাচ্ছে।
নির্বাচনী দিনের শুরুর ভাগে ডেমোক্র্যাটদের জন্য আশার আলোই দেখা যাচ্ছিল। পেনসিলভানিয়া, মিশিগান, নর্থ ক্যারোলাইনা, এমনকি ফ্লোরিডাতেও পরিস্থিতি এমনটাই মনে হচ্ছিল যে হোয়াইট হাউজ বুঝি এবারেই তার প্রথম নারী রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানাতে চলেছে। জর্জিয়ায় জয়ের বিষয় নিয়ে তেমন আর মাথাও ঘামাতে হচ্ছিল না। সপ্তাখানেক আগে এফবিআই ডিরেক্টরের চিন্তাহীন এবং ধসিয়ে দেওয়া ‘ই-মেইল’, ‘অ্যানথনি ভেইনার’, ‘১৫ বছরের মেয়ে’ ইত্যাদি মিলিয়ে কংগ্রেসকে লেখা চিঠির পরও বাজির দর ছিল হিলারির পক্ষেই।
তবে এই পুরোটা সময়, ট্রাম্পের আচরণ ছিল এক চনমনে ক্যারিকেচারের মতো। তারপর তিনি তিনি জিতে ছেড়েছেন। এই বিজয় পুরো দেশকে হয়তো এমন একটি অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক অনিশ্চয়তার যুগের দিকে ঠেলে দিচ্ছে যা আমরা কল্পনাও করতে পারছি না। গণতান্ত্রিক আচরণের ন্যূনতম নীতির প্রতি তাঁর যে অবজ্ঞা এটি পুরো জাতিকেই ভোগান্তির দিকে নিয়ে যাবে। আবার এমনটাও কিন্তু দাঁড়াচ্ছে যে নির্বাচনকারীরা ট্রাম্পের আত্মতোষণকারী, ঘৃণিত, উগ্র, মিথ্যা এবং বেপরোয়া জগতটাকেই পছন্দ করে নিয়েছে।
এটা জানা কথা যে আসন্ন দিনগুলোতে মতামত প্রদানকারীরা এই ঘটনাকে সাধারণ, সহনীয় করে তোলার চেষ্টা করবেন। ‘দরকারি জ্ঞান বা ধারণা’ এবং ‘দরকারি ভদ্রতা’ বিষয়ে তাঁরা পাঠকের মনোভাবকে ‘সহনীয়’ হয়ে ওঠার জন্য বলবেন। জাতীয় সংহতি এবং নিরাপত্তার প্রতি এই ভয়াল ব্যক্তিটিকে নির্বাচন করার মতো কাজটিকে মেনে নেওয়ার বা মুখোমুখি হওয়ার কথা বলবেন, যিনি একমুখে জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্য দেশের মাটি ও রক্তের কথাবার্তা আওড়ান, আরেকদিকে সোনায় মোড়ানো এয়ারলাইনারে করে চলাফেরা করেন।
জর্জ অরওয়েল বলেছিলেন যে মানুষের মতামতের মতো দয়ালু আর কোনোকিছুই হতে পারে না। মানুষ যেমন নিজে নিজের আচরণের জন্য বিপদের সম্মুখীন হয়, তেমনি দলগতভাবেও নির্বুদ্ধিতা, বেপরোয়া আর আর স্ববিরোধী প্রবৃত্তিতে আচরণ করতে পারে। মাঝেমধ্যে তাদের ধূর্ত এবং ধ্বংসাত্মক একজন নেতা প্রয়োজন হয় যে এই তাদের এই প্রবৃত্তিটা ধরতে পারে এবং একটা নাটুকে জয়ের পথে এগিয়ে যায়। এখানে বিষয়টা হচ্ছে, আমরা যে স্বাধীনতাটা উভোগ করব, সেটা তো আসলে জনগণের মতামতে ভর করেই গড়ে ওঠে। অরওয়েল নিজের প্রবন্ধ ‘ফ্রিডম অব দ্য পার্ক’-এ এভাবেই লিখেছিলেন। তিনি যে কোনো লিখেছিলেন, ‘আইন কোনো নিরাপত্তা নয়। সরকার আইন বানায় বটে, তবে সেটা টিকবে কি না আর আর পুলিশই কেমন আচরণ করবে—এর সবটাই আচরণ করে মানুষজনের সাধারণ মেজাজের ওপর। যদি বেশির ভাগ মানুষ বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, তাহলে বাকস্বাধীনতা থাকবে; যদি আইন তাতে বাধও সাধে—তাতে কোনো সমস্যা হবে না। জনগণের মতামত যদি আক্রমণাত্মক হয়, তখন সংখ্যালঘুরা বিপদে পড়বে এবং উৎখাত হবে; আইন যদি তাদের বাঁচাতেও চায়—তাও কোনো কাজে দেবে না।’
ট্রাম্প মূলত এই বিষয়গুলো চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন, আর তিনি সেই অনুযায়ীই তাঁর নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিলেন। তিনি শ্বেতাঙ্গ ভোটারদের উদ্বেগ আর চাওয়া ধরতে পেরেছিলেন, প্রধানত। আর এ ছাড়া অনেক ভোটারই এই সুকৌশলী পারফর্মারকে অনুসরণ করেছিলেন তাঁদের ভীতি এবং খোলনলচে বদলাতে থাকা নতুন পৃথিবীর কারণেই। তাঁদের হিসাবটা এমন ছিল যে এই বিলিয়নিয়ার ব্যক্তিটি সেভাবে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াবেন না যেমনটা কি না প্রো-ব্রেক্সিট ভোটাররা বরিস জনসন বা আরো অনেকের কাছ থেকে পেয়েছেন। আরো কিছু বিষয় রয়েছে—সাংস্কৃতিক, সামাজিক। যেসব বিষয়ে উগ্র স্বজাত্যবোধ এবং কট্টর রক্ষণশীলরা নিজেদের সঙ্গে আর কাউকে মেলাতে চাননি, সম পর্যায়ে যেতে চান না। এই বিষয়গুলো ট্রাম্প ধরতে পেরেছেন যুতসইভাবে। তিনি মেক্সিকান অভিবাসীদের ‘রেপিস্ট’ হিসেবে আখ্যায়িত করেই শুরু করেছেন তাঁর ক্যাম্পেইন!
হিলারিও একেবারে নিখুঁত বা সাধু পর্যায়ের প্রার্থী ছিলেন না। তবে তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, শক্তসমর্থ এবং উপযোগী নেতা; যিনি কি না এই অগণিত ভোটারের মধ্যে কখনোই ‘ছাপমারা’ কিংবা ‘বিশ্বাসযোগ্যতাবিহীন’ হয়ে ওঠেননি। বহু বছর ধরে তাঁকে ধাওয়া করা কিছু বিষয় আর স্ক্যান্ডাল তাঁকে এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত করেছে যে তিনি যত বছর ধরেই এতটা দক্ষভাবে দেশের জন্য কাজ করুন না কেন—ট্রাম্পের চেয়ে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা কম হিসেবেই মাপা হয়েছে ফলাফলের দিক থেকে। সেই ট্রাম্পের কাছে তিনি হেরে গেছেন যিনি কি না একজন সস্তা অভিনেতা, ক্রেতা-বিনিয়োগকারীদের ঠকানো ব্যবসায়ী, একজন বেপরোয়া ও অসহনশীল ব্যক্তি। তাঁকে নেতিবাচক সব ধরনের সম্ভাষণেই পরিচয় দেওয়া যাবে।
বিগত আট বছর বারাক ওবামার মতো একজন ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে পেয়েছে এই দেশ। এ সময় বর্ণবাদ আর উগ্রপন্থার মতো বিষয়কে নিশ্চিহ্ন করার মতো চেষ্টা হয়েছে বটে, ফলাফলে কিন্তু তা হয়নি। যা হয়তো এখনো মনের মধ্যে গেঁড়ে বসে আছে, সেগুলো বলা না হলেও নিশ্চিহ্ন হয়নি। এখন সেগুলো প্রকাশ্যে বলবার, ছড়াবার সুযোগ এসেছে। আর এই অসহিষ্ণু কথাবার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার কায়দাতেই বাজিমাত করেছেন ট্রাম্প, হারিয়েছেন হিলারিকে।
পুরো দৃশ্যটাই আসলে বিপর্যস্ত, হতাশাজনক। অনেকে দেশ ছাড়ার জন্য ভাবছেন, যুদ্ধের আশংকা করছেন, দুঃখে-হতাশায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন। তবে পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য এসব করলে তো হবে না। কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে, মিথ্যের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে, মার্কিন নীতি ও নৈতিকতাকে ধারণ করে সংগ্রাম করতে হবে সম্মান নিয়ে। আমাদের জন্য এখন এটাই করবার আছে।