রফিক আজাদ : যতি ও নিয়তি
রফিক আজাদ জীবনের যতি টানিয়াছেন। এখন সঙ্গত প্রশ্নটি তুলিতেই হইবে। তাঁহার নিয়তি কি তাহা কে বলিবে? আমাদের দেশে কবিদের সচরাচর দুই ভাগে ভাগ করিয়া দেখা হয়। এক ভাগে গৌণ কবির দল—আর ভাগে মুখ্য কবি কয়েকজন। রফিক আজাদ কোন ভাগে পড়িবেন? এই প্রশ্নের উত্তর এক কথায় দেওয়া যাইবে না। কারণ এখনও উত্তর দেওয়ার মতো সময় আসে নাই।
১
রফিক আজাদের নাম যখন প্রথম শুনি তখনও তাঁহার সহিত আমার দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই। ১৯৭৪ সালে তাঁহার দোসরা কবিতার বই—‘সীমাবদ্ধ জলে, সীমিত সবুজে’—বাহির হইয়াছিল। ঐ বইয়ের মধ্যে লওয়া একটি কবিতার নাম ‘ভাত দে হারামজাদা’। গুজবে প্রকাশ, এই কবিতাটির কারণে কবির প্রাণ না যাইতে পারে না যাউক—চাকুরি যাইবার সম্ভাবনা তৈয়ার হইয়াছিল। কথায় বলে, বিপদের হাত পা নাই। তবে চাকুরির হাত পা আছে বৈকি! লোকে বলে, তাহাদের কোন একটা ধরিয়া রফিক আজাদকে চাকুরি রক্ষা করিতে হইয়াছিল।
এতদিন পরে ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতাটি আরেকবার ফিরিয়া পড়িলাম। একান্তই নির্দোষ পদ্য। বিপ্লবের, বিদ্রোহের কিংবা সশস্ত্র সংগ্রামের হাঁক-ডাক নাই। ১৯৭৪ সালে আমাদের চাঁদের মতো দেশে একটি দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়াছিল। এই পদ্যের মধ্যে শুদ্ধ তাহার কলঙ্ক আছে। রফিক আজাদ যাহা লিখিয়াছিলেন তাহার অংশবিশেষ এই রকম:
দু’বেলা দুমুঠো পেলে মোটে নেই অন্য কোনো দাবি,
অনেকে অনেক—কিছু চেয়ে নিচ্ছে, সকলেই চায়:
বাড়ি, গাড়ি, টাকাকড়ি—কারো বা খ্যাতির লোভ আছে;
আমার সামান্য দাবি: পুড়ে যাচ্ছে পেটের প্রান্তর—
ভাত চাই— এই চাওয়া সরাসরি— ঠাণ্ডা বা গরম,
সরু বা দারুণ মোটা রেশনের লাল চালে হ’লে
কোনো ক্ষতি নেই— মাটির শানকি—ভর্তি ভাত চাই :
দু’বেলা দুমুঠো হ’লে ছেড়ে দেবো অন্যসব দাবি।
কিন্তু এই সামান্য দাবিও যদি সে মিটাইতে না পারে! ফলাফল কি হইতে পারে? রফিক আজাদ জানাইতেছেন, তাঁহার কোন ‘অযৌক্তিক লোভ’ নাই, এমন কি ‘যৌনক্ষুধা’ও নাই। তাঁহার ভাষায়, ‘নাভিনিম্নে পরা শাড়ি’ কিম্বা ‘শাড়ির মালিকে’ও তাঁহার কোন আগ্রহ নাই। তিনি কহিতেছেন: ‘যে চায় সে নিয়ে যাক—যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে দাও—’। এই সকলে তাঁহার কোনই প্রয়োজন নাই। কিন্তু তাঁহার একটা দাবি আছে। সে দাবিটা মিটাইতেই হইবে।
যদি না মেটাতে পারো আমার এই সামান্য দাবি,
তোমার সমস্ত রাজ্যে দক্ষযজ্ঞ কাণ্ড ঘটে যাবে;
ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, আইনকানুন—
সম্মুখে যা কিছু পাবো খেয়ে যাবো অবলীলাক্রমে
থাকবে না কিছু বাকি—চ’লে যাবে হা-ভাতের গ্রাসে।
যদি বা দৈবাৎ সম্মুখে তোমাকে, ধরো, পেয়ে যাই—
রাক্ষুসে ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপচার হবে।
১৯৭৪ সালের সেই দুর্ভিক্ষ এখন কাহিনী। তাহার কথায় ইতিহাসের বই ভরিয়া গিয়াছে। সেই দুর্ভিক্ষে এদেশে কত মনুষ্য-সন্তান খাইতে না পাইয়া মরিয়া গিয়াছিল তাহা লইয়াও অনেক বই লেখা হইয়াছে। রফিক আজাদ সেদিন সরকারি গোলামখানায় বসিয়াও এই জাতীয় পদ্য কবিতার নামে লিখিয়াছিলেন। ঐ খানার নাম বাংলা একাডেমি। এই কাজটি গৌণ কবিরা করিতে পারেন না।
তো রফিক আজাদ পারিলেন কি করিয়া? নজরুল ইসলামের পরের কালে যে ভাষা বাংলাদেশে কায়েম মোকাম হইয়াছে রফিক আজাদের কবিতার ভাষা সেই ভাষা বৈ নয়। কোন বিকল্প তকমার দেখা পাইলাম না বলিয়া এই ভাষাকেই জীবনানন্দ দাশের ভাষা বলিবার চেষ্টা করিতেছি। এদিকে রফিক আজাদ আবার নজরুল ইসলামকেও ষোল আনা ছাড়িতে পারিতেছেন না। জীবনানন্দ দাশের ভাষায় নজরুল ইসলামের ধর্ম প্রচার করিলে যে সজল পদার্থ তৈয়ার হয় রফিক আজাদ তাহারই কারখানা বসাইয়াছেন বলিয়া ভ্রম হয় আমার।
সর্বপরিবেশগ্রাসী হ’লে সামান্য ভাতের ক্ষুধা
ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে আসে নিমন্ত্রণ ক’রে
দৃশ্য থেকে দ্রষ্টা অব্দি ধারাবাহিকতা খেয়ে ফেলে
অবশেষে যথাক্রমে খাবো: গাছপালা, নদী-নালা,
গ্রাম-গঞ্জ, ফুটপাথ, নর্দমার জলের প্রপাত,
চলাচলকারী পথচারী, নিতম্ব-প্রধান নারী,
উড্ডীন পতাকাসহ খাদ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীর গাড়ি—
আমার ক্ষুধার কাছে কিছুই ফেলনা নয় আজ।
ভাত দে হারামজাদা, তা-না হ’লে মানচিত্র খাবো ॥
২
ইংরেজি ১৯৯৯ সালের কোন এক সময়ে রফিক আজাদ আর একটি কবিতা রচনা করিয়াছিলেন। কবিতার শিরোনাম তিনি রাখিয়াছিলেন ‘জীবনানন্দ জন্মশতবার্ষিকীতে নজরুলের প্রতি’। ঐ বছর এই বাংলাদেশে (এবং এই দেশের বাহিরেও) কোথায়ও কোথায়ও বা নজরুল ইসলাম শতবার্ষিকী পালিত হইয়াছিল। একশত বৎসর আগে এই দেশের চারি সীমানার মধ্যে আরো একজন প্রসিদ্ধ কবি জন্মিয়া দেশ ও দশের অশেষ কল্যাণ সাধন করিয়াছিলেন। অথচ ১৯৯৯ সালে এই দ্বিতীয় কবির শতবার্ষিকী নজরুল ইসলামের বার্ষিকীর মতন অত ঘটা করিয়া কেহ পালন করেন নাই। জীবনানন্দ অনুষ্ঠান দূরের কথা, তাঁহার স্মরণে বা সম্মানে একটি স্মারক ডাকটিকিটও কেহ প্রকাশ করে নাই। এই নৈঃশব্দ্যের বা নীরবতার কথা কাহাকেও মনে হয় দুঃখ পর্যন্ত দেয় নাই।
শুদ্ধ রফিক আজাদ ব্যতিক্রম। তিনি এই কারণ বাবদ একেলাই দুঃখ পাইয়াছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামকে বিবাদী করিয়া তিনি বরং মামলাই টুকিয়া দিয়াছিলেন। তাঁহাকে তাক করিয়া অভিযোগ উত্থাপন করিয়াছিলেন: ‘জন্মশতবার্ষিকী এই উৎসব প্রাঙ্গণ থেকে চুপিসারে তোমাকেই বলি—তোমার উদার্যে আস্থা আছে, তাই বলি’। তিনি অধিক লিখিয়াছিলেন:
নিশ্চুপে, নীরবে যাচ্ছে আজ আরো এক
কবির জন্মের শতবার্ষিকীটি চলে!
কারু তা খেয়াল নেই—
নেই কোনো আয়োজন, নেই উদ্যাপন!
কোনো পৃষ্ঠপোষকতা নেই—
নেই ভক্তজনেরও তো স্মৃতির তর্পণ!
এই উপেক্ষার অপর একটি নাম স্থির করিয়াছিলেন রফিক আজাদ: ‘রূঢ় আচরণ’। তিনি সখেদে জিজ্ঞাসা করিতেছিলেন, জীবনানন্দ দাশের অপরাধটা কোথায়?
যে তিনি বাঙলাকে ভালোবেসে
কোথাও চাননি যেতে চ’লে—
তাঁর প্রতি এই রূঢ় আচরণ বাঙলাকে মানায়?’
রফিক আজাদ নিজেকে চিরকালই গৌণ কবিদের দলে স্থাপন করিয়া আসিতেছিলেন। তাই বুঝি জীবনানন্দ দাশের নিয়তি দেখিয়া তিনিও শিহরিয়া উঠিয়াছিলেন। কবুল করিতে হইবে, এই শিহরণ তাঁহাকে মোটেও অপাত্রে নিক্ষেপ করেন নাই। তাই সংস্কৃত ভাষার বুনিয়াদী কবি ভর্তৃহরি হইতে ধার করিয়া তিনি নিয়তির গতিপথেও একটা যতিচিহ্ন টানিয়াছিলেন।
বিজ্ঞ সমালোচকেরা সরাসরি নাকচ করেন
আমার কবিতা যদি—কিছু যায় আসে না আমার।
আমি তো তাদের জন্যে লিখিনি একটি পঙক্তিও,
ভাবীকালে অবশ্যই কেউ এসে বিহ্বল আঙুলে
তুলে নেবে আমার কবিতা—
কেননা, বিপুল পৃথ্বী আর এই কাল নিরবধি ॥
পরিশেষে একটি প্রাণের কথা বলিয়া রাখি। রফিক আজাদ আমার প্রিয় কবিদের একজন। তাহার কারণ শুদ্ধ কবিতা নয়। তিনি আমার পুত্রের মতন। তাঁহার বাবার নাম সলিমুল্লাহ খান। কিন্তু আধুনিকতার ধোঁকা খাইয়া তিনি বাবার নাম জাহির করিতেন ‘সলিম উ. খান’। হায় আধুনিকতা, তুমি রফিকুল ইসলাম খানকে রফিক আজাদ নামে অমর করিতে পারিয়াছ। তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা।
৭ ডিসেম্বর ২০১৬
দোহাই
১. রফিক আজাদ, ‘ভাত দে হারামজাদা’, কবিতাসমগ্র, দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা : অনন্যা, ২০১৬), পৃ. ১০৩-১০৪।
২. -- ‘জীবনানন্দ জন্মশতবার্ষিকীতে নজরুলের প্রতি’, কবিতাসমগ্র, দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা : অনন্যা, ২০১৬), পৃ.৪২-৪৩।
৩. -- ‘আমার কবিতা', কবিতাসমগ্র, দ্বিতীয় মুদ্রণ (ঢাকা : অনন্যা, ২০১৬), পৃ. ৫১১।