আড়াইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী খেলা হুমগুটি!
পৌষ মাসের শেষ দিনকে ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়া উপজেলায় আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘পুহুরা’। প্রতিবছর এই দিনে একই সময়ে একই স্থানে আড়াই শতাধিক বছর ধরে অনুষ্ঠিত হচ্ছে খেলাটি। পিতলের মোড়কে তৈরি ৪০ কেজি ওজনের একটি বল নিয়ে কাড়াকাড়ি। ময়মনসিংহ অঞ্চলের জনপ্রিয় এই খেলার নাম ‘হুমগুটি’।
খেলা উপলক্ষে মেয়েরা আসে বাপের বাড়ি। দর্শক হিসেবে থাকার আনন্দ থেকে বাদ পড়তে চায় না তারাও। বাড়ি বাড়ি চলে পিঠাপুলির উৎসব। খেলাস্থলে জমে ওঠে গ্রামীণ ‘পহুরা’ মেলা। জবাই করা হয় গরু-ছাগল। উপজেলার লক্ষিপুর,দেওখোলাসহ পাশ্ববর্তী গ্রাম গুলোতে দুইতিনদিনব্যাপী চলে উৎসব আমেজ। কবে থেকে খেলার শুরু, নতুন প্রজন্মের কেউ এই খেলার সময় তারিখ বলতে পারে না, বুড়োদেরও অজানা।
ময়মনসিংহ সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ-ফুলবাড়ীয়া সড়কের লক্ষীপুর ও দশ মাইলের মাঝামাঝি ‘বড়ই আটা বন্দে’ (পতিত জমি) খেলার কেন্দ্রস্থল।
প্রতিবছরই বিকেল চারটার দিকে খেলা শুরু হয়। প্রচারবিহীন এই খেলায় সকাল থেকেই ফুলবাড়ীয়া ছাড়াও পার্শ্ববর্তী ত্রিশাল ও মুক্তাগাছা উপজেলার সব বয়সী লাখো মানুষ জমায়েত হতে থাকে লক্ষীপুর বড়ই আটা বন্দে। কণ্ঠে কণ্ঠে উচ্চারিত হয় ‘জিতই আবা দিয়া গুটি ধররে...হেইও’।
ফুলবাড়ীয়া উপজেলা সদর থেকে ৫ কিলোমিটার উত্তরে লক্ষীপুরের বড়ই আটা বন্দ। খেলা শুরুর আগে ময়মনসিংহ-ফুলবাড়ীয়া সড়কের অদূরে ভাটিপাড়া,বালাশ্বর, তেলিগ্রামের সংযোগস্থল নতুন সড়কে নামে মানুষের ঢল।
জানা যায়, আড়াইশ বছর আগে মুক্তাগাছার জমিদার রাজা শশীকান্তের সঙ্গে ত্রিশাল উপজেলার বৈলরের হেমচন্দ্র রায় জমিদারের জমির পরিমাপ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়। জমিদার আমলের শুরু থেকেই তালুকের প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল ১০ শতাংশে, পরগনার প্রতি কাঠা জমির পরিমাপ ছিল সাড়ে ৬ শতাংশে। একই জমিদারের ভূ-খণ্ডে দুই নীতির বিরুদ্ধে গড়ে ওঠে প্রতিবাদী আন্দোলন। জমির পরিমাপ নিয়ে সৃষ্ট বিরোধ মিমাংসা কল্পে লক্ষ্ণীপুর গ্রামের বড়ই আটা নামক স্থানে ‘তালুক-পরগনার সীমানায়’ এ গুটি খেলার আয়োজন করা হয়। গুটি খেলার শর্ত ছিল গুটি গুমকারী এলাকাকে ‘তালুক’ এবং পরাজিত অংশের নাম হবে ‘পরগনা’।
জমিদার আমলের সেই গুটি খেলায় মুক্তাগাছা জমিদারের প্রজারা বিজয়ী হয়। এ ভাবেই তালুক পরগনার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে ব্রিটিশ আমলে জমিদারী এই খেলার গোরাপত্তন, যা আজো চলছে আড়াই শত বর্ষ ধরে। ৪০ কেজি ওজনের পিতলের গুটি ঢাক ঢোলের তালে তালে নেচে গেয়ে তালুক পরগনার সীমানায় নিয়ে আসা হয়।
প্রতি বছর পৌষের শেষ বিকেলে এই খেলাকে ঘিরে অতি প্রাচীনকাল থেকেই লক্ষ্ণীপুর, বড়ই আটা,ভাটিপাড়া বালাশ্বর,শুভরিয়া,কালীবাজাইল,তেলিগ্রাম,সারুটিয়া, গড়বাজাইল, বাসনা, দেওখোলা, কুকরাইল, বরুকা, ফুলবাড়ীয়া পৌর সদর, আন্ধারিয়াপাড়া, জোরবাড়ীয়া, চৌধার, দাসবাড়ী,কাতলাসেনসহ আশে-পাশের ১৪ থেকে ১৫টি গ্রামে শুরু হয় উৎসবের আমেজ। এ উপলক্ষে ঈদের উৎসবের মতো নতুন জামা-কাপড়ও কিনে।
এ খেলায় কোনো রেফারি থাকে না। বিকেল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলে খেলা। কখনো দুই-তিনদিন পর্যন্ত খেলা চলার রেকর্ড আছে। একেক এলাকার একেকটি নিশানা থাকে। ওই নিশানা দেখে বোঝা যায় কারা কোন পক্ষের লোক। ‘গুটি’ কোন দিকে যাচ্ছে তা মুলত চিহিৃত করা হয় নিশানা দেখেই। নিজেদের দখলে নিতে বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হয় খেলায়। এভাবে গুটি ‘গুম’ না হওয়া পর্যন্ত চলে খেলা।